চীনের রাজধানী পেইচিংয়ে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা মানুষদের তৈরি মজার মজার সব খাবার পাওয়া যায়। বিশেষ করে চীনের সংখ্যালঘু জাতির বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন রেস্তরাঁগুলো পেইচিংয়ের খাদ্য শিল্পের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এই রেস্তরাঁগুলোতে সংখ্যালঘু জাতির বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন খাদ্য, নাচ-গান এবং খাওয়ার পরিবেশে লোকজনকে সে জাতির বৈশিষ্ট্যময় নানান আয়োজন উপস্থাপন করা হয়।
এইমাত্র আপনারা যে সংগীতটি শুনতে পেলেন, তা উত্তর পেইচিংয়ের একটি রেস্তরাঁ আমাদের সংবাদদাতা রেকর্ডিং করেছেন। এ রেস্তরাঁর নাম "স্বর্ণ লওলান খাদ্য- অভিনয় মহাচত্বর"। প্রতিদিন এখানে সিন চিয়াং জাতির নাচ-গানের মধ্যদিয়ে অতিথিদের অপ্যায়ন করা হয় এবং মুসলিম রীতিতে তাদের আকৃষ্ট করা হয়।
এ রেস্তরাঁয় ঢুকলে মনে হবে যেন উইগুর সংখ্যালঘু জাতির কোনও পরিবারে বেড়াতে গেছেন। এ রেস্তরাঁয় খুবই জাতীয় বৈশিষ্ট সম্পন্ন। সাদা রঙ দেয়ালে সিন চিয়াং-এর নানান দৃশ্যের ছবি টাঙ্গানো রয়েছে। মাটিতে পাতা হয়েছে বিচিত্র রঙের ফুল তোলা গালিচা। সবুজ সবুজ আঙ্গুর লতা জানালার গ্রীল ঘিরে রেখেছে। আর রেস্তরাঁয় মাঝখানে একটি প্রার্থনার স্থান তৈরি করা হয়েছে। যা এখানে আসা মানুষদের খুব আকৃষ্ট করে। মুসলিম ধর্ম অনুযায়ী মুসলমানেরা প্রতিদিন মক্কার দিকে মুখ করে পাঁচ বার নামাজ পড়ে। মুসলিম অতিথিদের প্রার্থনা করার জন্য এ রেস্তরাঁয় বিশেষ করে এই প্রার্থনা কক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। রেস্তরাঁটির ম্যানেজার মাদাম সিয়াও লিন আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন, "এই নামাজ কক্ষটি মুসলিম রীতিতে সাজানো হয়েছে। মুসলমানেরা মক্কার দিকে মুখ করে নামাজ পড়েন। এইজন্য এ কক্ষের সামনে একটি সিল্ক দিয়ে তৈরি কোরানের ছবি আছে। এখানে সাজানো জিনিসপত্রও খুব বৈশিষ্টসম্পন্ন। যেমন, তুর্কী তামার পণ্যসামগ্রী, আরবি পরিবারের সাজানো জিনিসপত্র ইত্যাদি। মেঝে সিন চিয়াং থেকে আনা গালিচা পাতা। অতিথিদের নামাজ পড়ার জন্য আমরা এই কক্ষ স্থাপন করেছি।
এই নামাজ কক্ষ ছাড়াও এ রেস্তরাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট আছে। এখানকার খাবার সিন চিয়াংয়ের বৈশিষ্টসম্পন্নখাবার। সিন চিয়াং থেকে আসা উইগুর জাতির বাবুর্চি আলিচিয়াং "লা টিয়াও জি" ও "নান" ইত্যাদি বৈশিষ্টসম্পন্ন খাবার প্রসঙ্গে অনেক কথা জানালেন। তিনি তার সেরা রান্না অর্থাত্ এ রেস্তরাঁর বিশেষ খাবার " চন্দ্রমল্লিকা দিয়ে ভেড়ার রান" রান্নাটি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলেছেনঃ " চন্দ্রমলিকা দিয়ে ভেড়ার রান" রান্নাটি উইগুর মানুষদের একটি প্রধান খাবার। তরতাজা ও তুলতুলে ভেড়ার রান দিয়ে এই খাবার রান্না করা হয়। রান্নার পদ্ধতিও বেশ কঠিন। দশটির অধিক মসলা-সহ আচার করে আগুনে ঝলসানো হয়। রান্না শেষে এই খাবার দেখতে একদম একটি ফোটা চন্দ্রমলিকা ফুলের মতো। এ রান্নাটি সৌভাগ্য, আর উদারতার প্রতীক।"
এই জাতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন দৃশ্য এবং ঐতিহ্যবাহী খাদ্যদ্রব্য পরিবেশনের কারণে এ রেস্তোরাঁ ভোক্তাদের বেশ আকৃষ্ট করে। এই রেস্তোরাঁয় পেইচিংয়ে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রদেশের মুসলমানরা তাদের নিজ শহরের খাবারের স্বাদ নিতে পারে , গান শুনতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে এ রেস্তরাঁ সিন চিয়াংয়ে সংখ্যালঘু জাতির জীবন-যাপন জেনে নেওয়ার খোলা জানালার ভূমিকা পালন করে।
এই সিন চিয়াং রেস্তরাঁর কথা উল্লেখ করলে সবার চোখের সামনে ভেসে উঠবে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময় রূপ। দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইয়ান নান শহরের তাই জাতির রেস্তরাঁ লিলি ফুলের মতো চুপচাপ এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত। যখন সন্ধ্যা নামতে শুরু করে, তখন উত্তর পশ্চিম পেইচিংয়ে পাও ছিন নামের তাই জাতির রেস্তোরাঁটি ভরে উঠে অতিথিতে। এই রেস্তরাঁয় পরিচালক মা শৌ বিংয়ের বয়স ৬০ বছরেরও বেশি। তিনি একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর তিনি এই রেস্তোরাঁ চালু করেন। তিনি বলেছেন, তার নিজ শহরের বৈশিষ্টসম্পন্ন খাদ্য পেইচিংয়ের অধিবাসিদের সামনে হাজির করতে তিনি এই রেস্তরাঁয় চালু করেছেন। তিনি বললেন, "আমার বাড়ী ইয়ান নান প্রদেশের দে হোং তাই ও চিংপো জাতির স্বশাসন এলাকায়। এই এলাকা মায়ানমারের সঙ্গে সংলগ্ন। সেখানে সব খানে সবুজ সবুজ গাছপালা, উচ্চ পর্বত এবং পরিস্কার নদনদী রয়েছে। তাই জাতির দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সেখানকার মানুষ খুব ভালো গান গাইতে পারে এবং নৃত্য করতে পারদর্শি। ভৌগলিক আবহাওয়ার কারণে তাই জাতির লোকেরা টক ঝাল খুব পছন্দ করে।"
মা শৌ আরও বলেছেন, অনেক শিল্পী, বুদ্ধিজীবি এবং আশপাশের কোম্পানির কর্মকর্তারা এখানে খেতে আসেন। এখানকার পরিবেশ এবং ইয়ান নান প্রদেশের রান্না পছন্দ করেন বলে তাঁরা এখানে আসেন।
মাদাম মা লিং সব সময় এখানে খেতে আসেন। তিনি সংবাদদাতাকে বলেছেন, তিনি এখানকার খাবার খুব পছন্দ করেন। " যদি ইয়ান নানের খাবার খেতে চাই, তাহলে এখানে আসি। এ রেস্তরাঁর পরিচালক ও তাঁর স্ত্রী খুব ভালো মানুষ। তারা শিক্ষিত ও মার্জিত। আর এখানকার রান্নাও অনেক ভালো।"
দক্ষিণ চীনে উত্পাদিত চাল এবং আনারস দিয়ে বানানো "আনারস ভাত" এ রেস্তোরাঁর বিশেষ খাবার। এ খাবারটি দেখতে হালকা হলুদ , সাথে সুগন্ধও পাওয়া যায়, খেতে খুব নরম এবং সুস্বাদু।
সিন চিয়াং রেস্তরাঁয় এবং তাই জাতির রেস্তরাঁয় ছাড়াও পেইচিংয়ে আরও অনেক সংখ্যালঘু জাতির রেস্তরাঁয় আছে। যেমন ঠাণ্ডা নুডল্স, কাবাব এবং সবজি আচার রান্না করা কোরিয় জাতির রেস্তরাঁয়। দুধ চা, হাত দিয়ে খাওয়া মাংস রান্না করার মঙ্গোলীয় জাতির রেস্তরাঁয় এবং পা পা নামে জাতীয় খাবার, ওয়েল টি রান্না করা ইয়াও জাতির রেস্তরাঁয় ইত্যাদি। এই রেস্তরাঁগুলো বড় অথবা ছোটো হতে পারে, কিন্তু রেস্তরাঁগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে এবং নিজেদের নির্দিষ্ট অতিথিও আছে। বলা যায়, এই রেস্তরাঁগুলোতে আসা অতিথিরা শুধু সেখানকার খাবারের জন্য আসেন না, সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রকম সাংস্কৃতিক আয়োজন উপভোগ করার জন্যও আসেন।
খাবার-দাবারকে ছোটখাট জিনিস বলে উড়িয়ে দেওয়ার কিছু নেই। বরং এতে বিভিন্ন জাতির লোকদের বুদ্ধি এবং শৈল্পিক মনোভাব প্রকাশিত হয়। খাবারের সঙ্গে সঙ্গে আপনি চীনের নানান জাতির বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিও উপলব্ধি করতে পারেন। যদি পেইচিংয়ে বেড়াতে আসেন, তাহলে অবশ্যই সংখ্যালঘু জাতির রেস্তরাঁয় খেতে যাবেন। সেখানকার বিশেষ দৃশ্য আপনারা অবশ্যই পছন্দ করবেন।
|