উত্তর চীনের থিয়েন চিন শহরে তৌ সি চেন নামে একজন কৃষক চিত্রকর আছেন , যিনি কোনো পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করেই চিত্রাংকনের কলা-কৌশল আয়ত্ত করেছেন । তার ছবিতে যেমন চীনের লোক-চিত্রাংকনের ঘোর বৈশিষ্ট্য , তেমনি পাশ্চাত্যের চিত্রাংকনের রীতিনীতিও তুলে ধরা হয় । দেশ-বিদেশের বন্ধুরা তাকে খুব পছন্দ করেন । আজ এই অনুষ্ঠানে কৃষক চিত্রকর তৌ সি চেন সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলছি আমি…
তৌ সি চেনের বয়স পঞ্চাশাধিক বছর। তার শরীর ভাল , ঘন্টাধ্বনির মতো । তাকে দেখতে মনে হয় অনেক অল্পবয়সী । তিনি গ্রামাঞ্চলে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ছোট বেলা থেকেই নববর্ষ সংক্রান্ত ছবি , খোদাইয়ের কাজ , মাটি দিয়ে ভাস্কর্য , কাগজ কাটা প্রভৃতি চীনের লোক হস্তশিল্প চর্চা পছন্দ করেন । কৃষিকর্ম শেষে যখন অন্যরা খোশ-গল্পে বলে ম তখন তিনি হাতে গাছের শাখা নিয়ে মাটিতে গ্রামের পাহাড় , নদ-নদী আর আকাশে উদ্ভীয়মান পাখি আঁকেন । তিনি বলেছেন ,
তখন কাগজ , কালি ও রং ছিলো না । ছবি কেমন করে আঁকা হতো? আমি কাঠের লাঠিকে কলম আর মাটিকে কাগজ হিসেবে ব্যবহার করে প্রকৃতির বস্তু ও দৃশ্য নিয়ে ছবি আঁকতাম । আমি যা যা দেখতাম , তাই আঁকতাম ।
বসন্তকাল চলে যায় আর শরত্কাল আসে । ধীরে ধীরে ছবি আঁকা আমার একটি দৈনন্দিন কৌতূহলে পরিণত হয়েছে । আমার চিত্রাংকনের নৈপুন্যও ক্রমেই উন্নত হয়েছে । আমি ছবি আঁকার ক্ষেত্রে যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছি , তা ধাপে ধাপে আমার জীবণধারার একটি অংশে পরিণত হয়েছে । তৌ সি চেনের ছবিতে যেমন চীনের লোক-চিত্রাংকনের সরলতা আর প্রকৃতিভিত্তিক রংয়ের ঐতিহ্য , তেমনি পাশ্চাত্য দেশগুলোর চিত্রাংকনের বৈশিষ্ট্যও তুলে ধরা হয়েছে । চিত্রাংকনের অনুশীলনে তার ছবি আঁকার অসাধারণ বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলা হয়েছে ।
তৌ সি চেনের ছবি আঁকার সুনাম বেড়ে গেছে । তার ছবি দেশ-বিদেশের বহু চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জয় করেছে । তখন থেকে তার চিত্রাংকনের শীর্ষ পর্যায় শুরু হয় । তার ছবি চীনের রাষ্ট্রীয় কৃষকদের চীনা ঐতিহ্যগত চিত্র প্রতিযোগিতা , চীনের প্রথম ও দ্বিতীয় জাতীয় লিপিকলা প্রতিযোগিতা, নয়া চীনের ৪৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে চীনের জাতীয় লিপিকলা ও চিত্র প্রতিযোগিতা আর দ্বিতীয় চীন-জাপান লিপিকলা ও চিত্র প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পুরস্কার লাভ করেছে । তার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আর চিত্র শিল্পের অবদান চীনের নামকরা লোক-শিল্পীদের তালিকা , তাইওয়ান প্রণালীর দুই তীরের নামকরা ব্যক্তি সম্পর্কিত অভিধান আর প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের লিপিকলা ও চিত্র সংগ্রহে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চীনা শিল্পীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে ।
গত কয়েক বছরে তিনি রাষ্ট্রীয় প্যারসেন্যাল মন্ত্রনালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশের প্রথম শ্রেণীর চিত্র শিল্পীতে পরিণত হয়েছেন । তার পর তার গ্রামের আশেপাশের গ্রামবাসীরা সময় সময় তাকে ছবি আঁকতে আমন্ত্রণ করে থাকেন । এমন কি বিদেশীরাও কৃষক চিত্রকর তৌ সি চেনের নাম জানেন ।
একদিন যখন কৃষি কাজ শেষে বাড়িতে ফিরে আসলেন , তখন তিনি বি বি সি'র একজন সংবাদদাতার টেলিফোন পেয়েছেন । এই সংবাদদাতা বলেছেন , বহু বিদেশী খবরের কাগজে তার সম্পর্কে সংবাদ-প্রতিবেদন পড়েছেন । তারা মনে করেন যে , কোনো পেশাগত প্রশিক্ষণ ছাড়াও একজন চীনা কৃষক যে এত ভালভাবে ছবি আঁকতে পারেন , তা একটি অভাবনীয় ব্যাপার বটে । সুতরাং তিনি তার সংগে দেখা করতে চেয়েছেন । তিনি আশা করেন , তৌ সি চেন পেইচিংস্থ বৃটিশ দূতাবাসে যাবেন । দূতাবাসের কূটনীতিবিদরা আর বি বি সি'র সংবাদদাতা তার আনা ছবি খুব পছন্দ করেছেন । তিনি নিজের প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে যে এত শ্রেষ্ঠ সাফল্য অর্জন করেছেন , তার জন্য তারা খুব মুগ্ধ হয়েছেন । তৌ সি চেন তাদের বলেছেন ,
আমার ছবি আঁকার দক্ষতা গ্রামাঞ্চল আর গ্রামের জীবণযাপন থেকে এসেছে । গ্রামাঞ্চল আর গ্রামবাসী ছাড়া আমার ছবি আঁকার সাফল্য অর্জন একেবারে অসম্ভব । ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে তৌ সি চেন থিয়েন চিন শহরের তাকাং এলাকার ফেইং বিদেশী ভাষা বিদ্যালয়ের খন্ডকালীন চারুকলা শিক্ষক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন । বিদ্যালয়ে তার জন্য বিশেষ করে তৌ সি চেনের কৃষক চিত্রাংকন কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে । তাতে তার ছবি আঁকার জন্য একটি শ্রেষ্ঠ সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে । তার জন্য তিনি খুব সন্তুষ্ট হয়েছেন । তিনি বলেছেন ,
তারা আমার চিত্রকলা চর্চার জন্য একটি ভাল অবকাশ আর পরিবেশ দিয়েছেন । ফলে আমি লোক শিল্পের উত্তরাধিকার গ্রহণ করা আর আরো বিকাশের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে পারবো ।
চারুকলা শিক্ষকের কাজ চালাবার সংগে সংগে তৌ সি চেন বরাবরই কৃষকের রীতিনীতি আর বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে থাকেন । যখন সবাই কৃষি কাজে ব্যস্ত আছেন , তিনি পরিবার পরিজনের সংগে কৃষি ক্ষেতে কাজ করেন । কৃষি কাজ চালাবার সংগে সংগে তিনি কখনোই ছবি আঁকার কাজ ছাড়েন নি । এ পর্যন্ত তার ছবি হংকং , তাইওয়ান , জাপান , ফিলিপিন্স , যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশ ও অঞ্চলের যাদুঘরে দেখানো হয়েছে । মাতৃভূমির সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য তৌ সি চেনকে লালন -পালন করেছে এবং তাকে ছবি আঁকার আবেগ ও অভিজ্ঞতা যুগিয়ে দিয়েছে । এই কৃষক চিত্রকর যে প্রকৃতির সাগরে এত আত্মহারা হয়েছেন , তাতে মাতৃভূমির প্রতি তার স্নেহ ও ভালবাসা কখনো পরিবর্তিত হয় নি ।
যখন দেশের গুরুত্বপূর্ণ উত্সব বা উদযাপনী তত্পরতা পালিত হয় , তখন তৌ সি চেন ছবি আঁকার মাধ্যমে তার মনের আনন্দ ও শুভেচ্ছা প্রকাশ করে থাকেন । মাতৃভূমির কোলে ম্যাকাও'র প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তিনি যে ড্রাগণ নাচ সম্পর্কিত একটি ছবি একেছেন , তার ভিতরে ড্রাগণ , নাচের যুবক , ইয়াংশি নদী , দ্বিগুন সুখা কথাটি বড় চীনা অক্ষরের লিপিকলায় চিত্রণ , সাদা রংয়ের কপোত ইত্যাদি তার মনের আনন্দপূর্ণ অনুভূতি ব্যক্ত করা হয়েছে ।
তৌ সি চেন সম্প্রতি দেশজুড়ে আনন্দপূর্ণ নামের একটি কৃষক চিত্র রচনা করেছেন । এই চিত্র কর্ম গিনিস বিশ্ব রেকর্ডে অন্তর্ভুক্তির আবেদন জানানো হয়েছে। ৩৫ মিটার দীর্ঘ এই চিত্রে চীনের রুপ কথা , লোক কাহিনী আর ঐতিহাসিক গল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ।
|