চলতি সাল চীনা জনগণের জাপানী আগ্রাসন বিরোধী যুদ্ধে বিজয় লাভের ষাটতম বার্ষিকী ও বিশ্বের ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধে বিজয় লাভের ষাটতম বার্ষিকী। আজ থেকে ৬০ বছর আগে জাপানী হামলাদার বাহিনী পুর্বচীনের নানচিং শহরে নিষ্ঠুরভাবে তিন লক্ষ চীনাকে হত্যা করেছিল । ৬০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও চীনা জনগণ সেই ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী হত্যাকান্ড ভুলতে পারেন নি।
১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রায় দু লক্ষ জাপানী হানাদার সৈন্য চীনের তদানন্তীন রাজধানী নানচিং দখল করে এবং নির্মমভাবে গণ হত্যা চালায় । ছ' সপ্তাহের মধ্যে জাপানী বাহিনীর সঙ্গিনের ঘায়ে ও গুলিতে নববই হাজার বন্ধী সহ তিন লক্ষেরও বেশী নিরস্ত্র চীনা প্রাণ হারিয়েছিলেন । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে এই নৃশংস হত্যাকান্ড ছিলো একটি বিশ্বকাঁপানো ঘটনা ।
সেই বীভত্স হত্যাকান্ড থেকে যে অল্প সংখ্যক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন ৭৭ বছরবয়সী সিয়া সু ছিন তাদের অন্যতম । ৬৯ বছর আগে শীতকালের এক সকালের কথা স্মরণ করে তিনি অশ্রুভরা চোখে বলেছেন , সেই সকালেই জাপানী হানাদার বাহিনী তাঁর ন'জন সদস্যের সুখী পরিবার ছারখার করেছে ।
তিনি বলেছেন ,শীতকালের সেই সকালে জাপানী সেনারা আমাদের বাড়ির দরজায় প্রচন্ড ঘা মারল ,আমার বাবা কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলে দিলেন। জাপানী সেনারা ঘরে ঢুকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাঁকে মারতে মারতে মেরে ফেলে । কোলে আমার স্তন্যপায়ী ছোটো বোন নিয়ে আমার মা এবং দুটো সন্তান নিয়ে প্রতিবেশীর একজন মহিলা টেবিলের নীচে লুকিয়েছিলেন, জাপানী সৈন্যরা প্রথম সঙ্গিনের আঘাতে আমার ছোটো বোনকে হত্যা করে । । তারপর আমার মায়ের গা থেকে পোশাক ছিঁড়ে ফেলে ।আমরা চার বোন জড়সড় হয়ে খাটে বসেছিলাম , তারা আমরা বড় বোনকে টেনে হেঁছড়ে বাইরে নিয়ে চেপে ধরলো টেবিলে এবং আমার মেজো বোনোকেও খাটের উপর চেপে ধরলো। আমার গায়ের তিনটা জায়গায় সঙ্গিনের আঘাত লেগেছিল।
১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর এক বিভীষিকাময় দিন , এই দিন জাপানী সেনারা বন্য পশুর মত নানচিং শহরের সিনলুখৌ রাস্তার পাঁচ নম্বর বাড়িতে সিয়া সু জিনের পরিবারের ন' সদস্যের মধ্যে সাতজনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে । সিয়া সুজিনের দুজন বোন ও মাকে হত্যা করার আগে তাদের ধর্ষনও করা হয় । । আট বছর বয়সী সিয়া সু জিন ও তাঁর চার বছর বয়সী ছোটো বোন দৈবক্রমেঅবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পায়। পাড়াপড়শীরা তাদের সন্ধান পাওয়ার আগ পর্যন্দ মাত্র দু মুঠো শুকনো ভাত খেয়ে আপনজনের লাশের স্তুপের মাঝে তাঁদের ১৪ দিন কেটেছিল ।
৬০ বছর আগেকার সেই মর্মন্তুদ স্মৃতি মনে জাগতেই বৃদ্ধা সিয়া সু জিনের চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়েপড়ে । অবশেষে তাঁর চোখের ছানি হয়েছে । এখন যার জন্য তিনি ক্ষুব্ধ সেটই হলো , যে দেশ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তাঁর পরিবারের অসহনীয় বেদনার জন্য দায়ী সেই জাপান থেকে ইতিহাস অস্বীকার করার কন্ঠস্বর মাঝে মাঝে ভেসে আসে ।এমন কি, কোনো কোনো দক্ষিণ পন্থী ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধেও মিথ্যা প্রচারনা চালাচ্ছে যে, তিনি নাকি ইতিহাস বানিয়েছেন । বৃদ্ধা সিয়া সু জিন সরোষে বলেছেন , তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন ততদিন নানচিং গণ হত্যাকান্ডের সাক্ষী হয়ে সারা বিশ্বের জনগণের সামনে ইতিহাসের বাস্তবতা বর্ণনা করবেন
বহু ছবি ও প্রামান্য দলিলেও রক্তাক্ত নানচিং হত্যাকান্ডের নির্বাক চিত্রন স্পষ্ট ।কোনো কোনো ছবি জাপানী সৈন্যরা নিজেরাই তুলেছিল । বৃদ্ধ রো জিন এমন কয়েকটি ছবি সংরক্ষণ করেছিলেন । গত বছর মৃত্যু বরণের আগে সি আর আইকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন , জাপানী হানাদার বাহিনী নানচিং দখল করার সময় তিনি শিক্ষানবীস হিসেবে হুয়াতং ফোটো স্টুডিওতে কাজ করছিলেন । একদিন একজন জাপানী সেকেন্ড লেফটন্যান্ট দুটো রোল ফিল্ম ডিভেলপ করতে ফোটো স্টুডিওতে এল । ফিল্ম ডিভেলপ করে ছবি দেখে তিনি আতংকে ঘৃনায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ।
তিনি বলেছেন , ছবিতে জাপানী সৈন্যদের তরোয়াল উচিয়ে চীনাদের মাথা কেটে ফেলার দৃশ্য দেখে আমি আতংকগ্রস্ত হয়ে বাইরে গিয়ে মালিককে জানালাম । তিনি আমার সঙ্গে ডার্করুমে গিয়ে ছবিগুলো দেখে আমাকে সাবধান করে বললেন , রো জিন , এই ছবির কথা কাউকে বলবেন না । জাপানী সেনারা নির্বিচারে চীনাদের হত্যা করে , ধর্ষন করে এবং চীনাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় । আমি স্থির করলাম , এই সব ছবি নিজের কাছে রাখব।
এরপর রো জিন জাপানী সৈন্যদের ফিল্ম সম্বন্ধে বিশেষ সজাগ হয়ে উঠলেন । তাদের ফিল্মের অতিরিক্ত তিরিশাধিক ছবি প্রিন্ট করে তিনি নিজের তৈরী একটি এলবামে সাজিয়ে রাখলেন । চীনের জাপানী আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধে বিজয় লাভের পর তিনি জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের প্রমান হিসেবে তার এলবাম নানচিং সামরিক আদালতে জমা দিয়েছেন ।
ইসপাত কঠিন সাক্ষ্য অস্বীকার করার উপায় নেই , অতীতের ইতিহাস যেমন ভোলা পারা যায় না তেমনই বিকৃত করতেও দেয়া যায় না । ইতিহাস ভুলে গেলে তার বিয়োগান্ত নাটক আবার আবির্ভুত হতে পারে । সুতরাং যখনই জাপান থেকে জাপানের আগ্রাসন অস্বীকার করার শ্রুতিকটু শব্দ ভেসে আসে , যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত চীনা জনগণ ও সেই ইতিহাস সম্বন্ধে সচেতন জাপানীরা তখনই তার প্রতিবাদে সোচ্চার হন এবং অতীতের ইতিহাস সঠিকভাবে মুল্যায়ন করতে জাপানের সরকার ও জনগণকে মনে করিয়ে দেন ।
পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইন্সটিটিউটে অধ্যয়নরত জাপানী ছাত্র ইয়োসি কাজু কাটো সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , চীনা জনগণের জাপানী আগ্রাসন বিরোধী যুদ্ধে বিজয় লাভের ষাটতম বার্ষিকী ও বিশ্বের ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধে বিজয় লাভের ষাটতম বার্ষিকী উপলক্ষে ইতিহাস ভুলে না যাওয়াই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ।
তিনি বলেছেন ,একজন তরুণ হিসেবে আমি মনে করি , জাপান সত্যি সত্যি চীনের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল । এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য ।এই ঐতিহাসিক সত্যকে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার ভিত্তিতে পরিণত করা উচিত । শুধু নির্ভুলভাবে ইতিহাস বিচার করার ভিত্তিতেই দুদেশের ব্যাপক আদানপ্রদান ও সহযোগিতা সম্ভব ।
|