দক্ষিণ চীনের কুয়াংশি চুয়াং জাতির স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলে শানচিয়াং নামে এক জায়গা আছে । থুং জাতির এই অন্যতম অঞ্চল সবুজ পাহাড় আর স্বচ্ছ নদ-নদীতে ঘেরা, তার প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম । স্বচ্ছ নদ-নদীর তীরে একটির পর একটি থুং গ্রাম সুবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে আছে। থুং গ্রামে প্রবেশ করলে সৌন্দর্যময় বাড়িঘর চোখে পড়বে , সুন্দর সংগীত শোনা যাবে আর টকভিত্তিক সুস্বাদু খাবার আস্বাদন করা যাবে ।
থুং গ্রাম গড়ে তোলার জন্য জায়গা বাছাই করার ক্ষেত্রে খুব কড়াকড়ি আছে। নিয়ম ও রীতি-নীতি অনুযায়ী , তা পাহাড়ের সূর্যমুখী দিক আর নদীর পাশে নির্মাণ করা হয় । পাহাড়ে উঁচু উঁচু বট গাছ আর চায়না ফ্যর্ লাগানো হয় , গ্রাম নিবিড় বনাঞ্চলে ঘেরা। এতে শান্ত পরিবেশ বিরাজমান । ভোর বেলায় ঘন ঘন বাষ্প নদী থেকে উঠে উঠে, যেন সারা গ্রামটি আকাশের মেঘ আর কুয়াশার উপরে বসে আছে । মনে হয় , এখানকার লোকেরা যেন দেবতার জায়গায় বাস করে ।
থুং গ্রামের কাছে আসলে দূরে কালো রংয়ের বাড়িঘর , স্থাপত্য শিল্পের দিক থেকে তার সৌন্দর্য , পরিপাটি টালি , আর আঁকাবাঁকা বারান্দায় সর্বত্রই বিষ্ময়কর দৃশ্য দেখা দেবে । থুং গ্রামে প্রবেশ করতে চাইলে একটি সেতুর উপর দিয়ে পার হওয়া দরকার । এটাও থুং জাতির গ্রাম ডিজাইনের এক ধরণের কৌশল । এই সেতু নদীর উপর নির্মিত একটি বারান্দা । সেতুর দুই প্রান্ত আর কেন্দ্রস্থলে প্যাভিলিয়্যান নির্মিত হয়েছে । এই সব প্যাভিলিয়্যান লোকদের বিশ্রাম আর বৃষ্টি থেকে আশ্রয় নেয়ার জন্য ব্যবহার্য । এই ধরণের সেতুকে বাতাস ও বৃষ্টির সেতুও বলা হয় ।
শান চিয়াং থুং গ্রামের বাতাস ও বৃষ্টি সেতুগুলোর মধ্যে ছেন ইয়াং নামের বাতাস ও বৃষ্টি সেতু সবচাইতে সুবিদিত । ছেন ইয়াং নামের থুং গ্রামের সামনে থুং ইয়াং সেতু নির্মিত হয় । তার ডিজাইন সুন্দর আর জাঁকজমকপূর্ণ । সেতুর দু'পাশের দুটো প্যাভিলিয়্যান আর সেতুর মাঝখানে তিনটি প্যাভিলিয়্যান নির্মিত হয়েছে । ভিন্ন প্যাভিলিয়্যান ডিজাইনও ভিন্ন । দূর থেকে দেখলে এই সব প্যাভলিয়্যান উঁচুনীচু , যার যার বৈশিষ্ট্য আছে । সেতুর বারান্দায় প্রবেশ করলে অন্য ধরণের বিষ্ময়কর দৃশ্য দেখা দেয় । থুং জাতির কয়েক জন বৃদ্ধা রেলিংয়ের পাশে হেলান দিয়ে আরামের সঙ্গে সূচীকর্ম করছিলেন । তাদের পেছনে একটি ছোট মন্দির আছে । ভেতরে সেতুর দেবতা সুরক্ষিত। দেবতা গ্রামবাসীদের নিরাপত্তা রক্ষা করছে ।
শান চিয়াং জেলার থুং জাতির পরিবেশ জাদুঘরের মেয়ে ইয়াং ইয়েন চি ছেন ইয়াং সেতুর ইতিহাস প্রসংগে বলেছেন ,
১৯১২ সালে ছেন ইয়াং সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় । এই সেতু নির্মাণের জন্য ১২ বছর সময় লেগেছে । এই সেতুর নির্মাণ প্রকৌশল খুব জটিল , দেখতে জাঁকজমকপূর্ণ। থুং জাতির গ্রামের ভেতরে দালান আর নদীর উপরে সেতু আছে । আগে এই সেতুকে বাতাস আর পানির সেতু বলে মনে করা হতো । পরে এটা পথচারীদের বৃষ্টি থেকে আশ্রয় নেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় ।
সংবাদদাতা সেতুর উপর দিয়ে পার হয়ে থুং গ্রামে প্রবেশ করলেন । দেখা গেল উঁচুনীচু বাঁশের বাড়িঘর বিশৃংখলভাবে ছড়িয়ে আছে। গ্রামে একটির পর একটি ধান ক্ষেত, পুকুর , বাঁশের বন , শবজি ক্ষেত আছে । সময় সময় এক দল রাজহাঁস নদী থেকে আকাশে উড়ে যায়, দু' একটি শব্দে গ্রামের আরো শান্ত পরিবেশ দেখা দেয়। গ্রামে যেখানে সেখানে নিশ্চিন্তভাবে বেড়াতে গেলে আপনি বহু ঐতিহাসিক চিহ্ন আবিস্কার করতে পারবেন । সময় যেন এক শো বছর আগে ফিরে গিয়েছে। যেন নদীর ধারে থুং জাতির বৃদ্ধারা কাঠের লাঠি দিয়ে পিটাতে পিটাতে কাপড়-চোপড় কাঁচেন, প্রতিটি কৃষক পরিবারে এখনো পেষণপ্রস্তর , সূতী বোনা যন্ত্র , জলশক্তিচালিত কলের চাকা সংরক্ষিত আছে । গ্রামের বয়স্ক নারীদের চুলের খোঁপা যে বাঁধা আছে , তা দেখে লোকেদের মনে সম্ভবতঃ বিগত সময়ের স্মৃতি জেগে উঠে ।
থুং গ্রামে মানুষের শান্তি আর স্বস্তি উপভোগ করা যায় । তা ছাড়া লোকেরা আবিস্কার করতে পারেন , এখানকার সব কিছুর রং হাল্কা আর স্পষ্ট । টালি কালো রংয়ের, দরজা আর জানালার প্রাকৃতিক রং , লোকেরা নীল কৃষ্ণ রংয়ের পোষাক পরে আর অল্পবয়সী মেয়েরা আকাশী নীল রংয়ের পোষাক পরে । মেয়েদের চুল লাল রেশমী ফুলে সাজানো হয় ।
গ্রামের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মহাচত্বর থেকে গানের সুন্দর সুর বেরিয়ে আসে। থুং গ্রামের আয়তন বড় নয় , এক গ্রামে সাধারণতঃ দু' এক শো লোক বাস করে । গ্রামের মাঝখানে একটি ছোট্ট মহাচত্বর নির্মিত হয় । মহাচত্বরের এক পাশে উঁচু ঢোলের দালান আর অন্য পাশে অপেরা পরিবেশনের জন্য নির্মিত মঞ্চ । গ্রামেরযখন বিরাট উদযাপনী তত্পরতার আয়োজন করা হয় , তখন গ্রামবাসীরা এখানে সমাবেশিত হয় । এটাও থুং জাতির যুবক-যুবতীদের পরিচয়ের স্থান ।
ঢোলের দালানও থুং গ্রামের স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন । তার আকার চারকোনা , ছ'কোনা আর আটকোনা এই তিন ধরণের আছে । তাকে দেখতে একটি উঁচু প্যাগোডার মতো । ঢোলের দালান পুরো কাঠ দিয়ে নির্মিত হয় , একটি পেরেকও ব্যবহার করা হয় নি । এতে থুং জাতির মিস্ত্রীদের নৈপুন্য তুলে ধরা হয়েছে ।
থুং জাতির মিস্ত্রী ইয়াং শি ইয়্যু একজন স্থপতির পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন । তিনি বলেছেন , থুং জাতির বাড়িঘর নির্মাণের কোনো নক্সা নেই , তা একেবারে স্থপতির একটি বাঁশের খন্ড ও একটি কাঠের লাঠির ওপর নির্ভর করে ।
আমাদের বাড়িঘর নির্মাণের কোনো নক্সা নেই । একটি ঢোলের দালান নির্মাণের জন্য যে ডিজাইন আর উপকরণ লাগে , তার সব কিছুই বাঁশের দন্ড আর কাঠের লাঠিতে খচিত আছে । এগুলো শুধু মিস্ত্রীরা বুঝে , অন্যরা তা বুঝে না ।
ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। একটি বাঁকা নতুন চাঁদ ঢোলের দালানের উপরের আকাশে টাঙ্গানো হলো । ঢোলের দালানের নীচ থেকে যে সংগীত বেরিয়ে আসল , তা সত্যি মিষ্টি লাগল । সংগীতের সুরের সংগে সংগে গ্রামবাসীদের আনন্দপূর্ণ হাসিও শোনা যাচ্ছিল ।
থুং জাতির গ্রামে যখন গুরুত্বপূর্ণ উত্সব পালিত হয় , তখন 'শত পরিবারের ভোজসভা' আয়োজন করা হয় । সকল গ্রামবাসী গ্রামের মাঝখানের মহাচত্বরে সমাবেশিত হয়ে এক সাথে ভাত খায় আর মদ পান করে । এটাই থুং জাতির 'শত পরিবারের ভোজসভা' । সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত তারা আনন্দের সাগরে ডুবে যায় ।
|