গত শতাব্দীর আশির দশকে চীনে সংস্কার ও মুক্তদ্বার নীতি কার্যকরী করার পর দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংগে সংগে সাহিত্য রচনারও প্রানবন্ত পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে । এই সময় আবির্ভুত পেই তাও , সু থিন ও ওয়াং কো চেন প্রমুখ জনপ্রিয় কবির রচিত বিভিন্ন শৈলীর কবিতা পাঠকদের সমাদর পেয়েছে , ৩১ বছর বয়ষ্ক যুব কবি হাই সিয়াও এই সব কবিতা পড়তে পড়তে বড় হয়েছেন ।
দক্ষিণ চীনের হুনান প্রদেশের লুন হুই জেলার এক বুদ্ধিজীবী পরিবারে হাই সিয়াওয়ের জন্ম । ছোট বেলা থেকেই হাই সিয়াও কবিতা পড়তে পছন্দ করেন । ১৯৮৭ সালে ১৩ বছর বয়সের হাই সিয়াও সাহিত্য পত্রিকায় তার রচিত প্রথম কবিতা প্রকাশ করেন , ঠিক সেই সময় থেকে তিনি বড় হওয়ার পর একজন কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন । তিনি বলেছেন , মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমি কবিতা রচনা করতে শুরু করি । ১৩ বছর বয়স থেকে আমি পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ করতে শুরু করেছি , তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার কবিতা রচনা বন্ধ হয় নি । ১৯৯১ সালে হাই সিয়াও সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন । তখন তিনি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্র ছিলেন । তার এই অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে হাই সিয়াও বলেছেন , সেই সময় আমি একজন যুবক , আমি বৈচিত্র্যময় জীবনের অভিজ্ঞতা পেতে চাই , বিশেষ করে সেনানিবাসের জীবনের রহস্য আর সৈনিকের স্বাধীন ও সুদৃঢ মনোবল আমার খুব ভালো লাগে । একটি কবিতায় হাই সিয়াও বলেছেন , লাগামহীন ঘোড়াকেই কেবল সত্যিকার ঘোড়া বলা যায় । এই কবিতার লাইনে তার তখনকার আশা ও মমতা প্রকাশিত হয়েছে । তবে সেনানিবাসের জীবনের মানেই শৃঙ্খলা ও অপেক্ষাকৃত কম ব্যক্তিগত স্বাধীনতা । চার বছরের সেনানিবাসের জীবন তার পক্ষে এক মূল্যবান অভিজ্ঞতা , স্বাধীনতা অন্বেষনকারী কবির পক্ষে এটা সত্যই এক পরীক্ষা । চার বছর পর হাই সিয়াও পরীক্ষার মাধ্যমে সৈন্যবাহিনীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন , ২০০১ সালে স্নাতক হওয়ার পর হাই সিয়াও পেইচিংয়ে কবিতা রচনা করতে শুরু করেন , তিনি সাহিত্য পত্রিকায় সম্পাদকের কাজ করেন এবং ইন্টারনেটে কবিতার উয়েব সাইট স্থাপন করেন , এই সব কাজ তিনি পছন্দ করেন ।
হাই সিয়াওয়ের রচিত কবিতাগুলোর মধ্যে তার শৈলীর প্রতিনিধিত্বকারী কবিতার নাম হচ্ছে ' প্রার্থনার বাণী ' । আট শ' লাইনবিশিষ্ট এই কবিতা প্রকাশের সংগে সংগেই সাহিত্য মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে । সাহিত্য সমালোচকদের মতে এই কবিতা শুধু কবি হাই সিয়াওয়ের শৈলীর প্রতিনিধিত্বকারী কবিতা নয় , কবিতাটি আধুনিক চীনের কবিতা মহলের এক শ্রেষ্ঠ কবিতাও বটে , কাজেই এই কবিতা বিখ্যাত কবি কো মো রো ও আই ছিন প্রমুখ কবির সংগে ' এক শ বছরে চীনের বারোজন শ্রেষ্ঠ কবির কবিতাসংগ্রহে অন্তভুক্ত করা হয়েছে ।
' প্রার্থনার বাণী ' নামে কবিতার নয় অধ্যায় আছে । কবিতায় নিজের পরিবারপরিজনের প্রতি তার সুগভীর মমতা প্রকাশ করা হয়েছে । তিনি তার কবিতায় প্রাঞ্জল ভাষায় মনের অনুভুতি প্রকাশ করেছেন । এই কবিতার একটি লাইন হলোঃ দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের জন্মস্থানের বাতিগুলো মিটি মিটি জ্বলছে , দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের পাহাড়-পর্বতের গাছের পাতায় শিশির পড়ছে , উত্তর দিকে বাতাস বইছে , তাতে তোমার কি শীত লাগবে ? সাহিত্য সমালোচকরা মনে করে , হাই সিয়াও তার এই কবিতায় জীবনের তাত্পর্য অন্বেষনের প্রয়াস চালিয়েছেন । তার এই কবিতা রচনার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে হাই সিয়াও বলেছেন , দু হাজার এক সালে তার জীবনে এক মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে । এই দুঃখজনক ঘটনা তাকে দারুণভাবে আহত করেছে , নিজের মনের কথা প্রকাশের জন্য তিনি এই কবিতা রচনা করেছেন । তিনি বলেছেন , দু হাজার এক সালে আমার মা এক গাড়ী দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন , মাকে হারিয়ে আমি এত দুঃখ পেয়েছি যে এক সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারি না । এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বাড়ীতে বসে বসে কয়েক মাস কবিতা লিখেছি । আমি কবিতায় আমার অনুভুতি লিখেছি ।
অন্যান্য সাহিত্য রচনার তুলনায় বেশীর ভাগ কবিতায় কবির মানসিক অনুভুতি ফুটিয়ে তোলা হয় । হাই সিয়াও বলেছেন , তিনি মানসিক অসুস্থ অবস্থায় এই কবিতা লিখেছেন । কবিতা হচ্ছে কবির মনের গান , কবির নিজের অনুভুতি চেপে রাখতে হয় না , মনের ভালোবাসা ও দুঃখ সাহসের সংগে কবিতায় প্রকাশ করা উচিত । দুঃখের সময় চোখের পানি ফেলা আর আনন্দের সময় জোরে হাসা স্বাভাবিক ব্যাপার । প্রকৃত দুঃখ ও আনন্দের অনুভুতি সবাইকে মুগ্ধ করতে পারে ।
হাই সিয়াও হচ্ছেন 'তৃতীয় ধারা ' বলে পরিচিত চীনের অন্যতমো কবিতা প্রনালীর প্রতিনিধিত্বকারী এক কবি । হাই সিয়াও মনে করেন , যে কোনো লোক কবিতা লিখতে পারেন , কবিতা রচনা কবির সামাজিক আর পারিবারিক অবস্থানের সংগে সম্পর্ক নেই । তিনি আশা করেন কবিতা রচনার ক্ষেত্রে শিল্পকলা ও মানসিক পবিত্রতা বজায় রাখা যায় । ঠিক একই কারনে হাই সিয়াও আজ পর্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করছেন । তিনি বলেছেন , আমি তথ্য মাধ্যম প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েক বছর চাকরী করেছি , পরে আবার একটি বানিজ্য কম্পানিতেও চাকরী করেছি । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমি স্থায়ীভাবে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি না , আমার মতে একটি প্রতিষ্ঠানে এক বছরের বেশী সময় থাকা উচিত নয় , সময় বেশী হলে আমি সহ্য করতে পারি না । কবি হিসেবে স্বাধীনতা আমার প্রাণ , কবিতা রচনার সময় অন্যান্য লোকের অনুসরণ করা চলবে না , কবিকে নিজস্ব শৈলী প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালাতে হবে ।
|