শ্রোতাবন্ধুরাঃ এতোক্ষণ আপনারা যে সুর শুনেছেন , তা ওয়া জাতির আয়োজিত ধর্ম ক্রিয়ায় বাজানো কাঠের ঢোলের একটি রেকর্ডিং । ওয়া জাতির লোকেরা চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সীমান্তে অবস্থিত পার্বত্য এলাকায় বাস করে । এ জাতি একটি বীর ও জোয়ান জাতি । তাদের ধর্ম বিশ্বাসে কাঠের ঢোল একটি উল্লোখযোগ্য অবস্থান দখল করে আছে । এটি তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতীক । আজ এই অনুষ্ঠানে ওয়া জাতির কাঠের সংস্কৃতি সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলছি আমি…
ওয়া জাতির লোকেরা নিজেদেরকে আওয়া ডাকে । প্রাচীনকাল থেকেই তারা চীনের ইউন নান প্রদেশ ও মায়ানমারের সীমান্ত পাহাড়ী এলাকায় বাস করে । তাদের লোকসংখ্যা ৩ লক্ষেরও বেশি । ওয়া জাতির পুরুষদের চুল কোঁকড়া , নারীরা লম্বা চুল আঁচড়াতে পছন্দ করে , এরা তাদের মাথা রূপোর জিনিষে সাজাতে পছন্দ করে । ওয়া জাতির লোকদের গায়ের রং শ্যামলা , শরীরের কাঠামো বেশ মজবুত । ওয়া জাতির লোকেরা এমন ধর্ম বিশ্বাস করে যে , পৃথিবীতে সব কিছুতে প্রাণী ও উদ্ভিদের আত্মা আছে , সেখানে দেবতাও বিদ্যমান । এই সব দেবতার রক্ষা ও স্নেহ পাওয়া আর সুখী জীবনযাপন করার জন্য ওয়া জাতির লোকেরা নিয়মিতভাবে উপাসনার তত্পরতার আয়োজন করে । উপাসনা অনুষ্ঠানে কাঠের ঢোল একটি অপরিহার্য সামগ্রী বটে ।
ইউন নানের ওয়া জাতির প্রতি গ্রামে কাঠ , বাঁশ আর খড়-কুটা দিয়ে নির্মিত প্যাভিলিয়্যান দেখা যায় । এই প্যাভিলিয়্যানকে কাঠের ঢোল কক্ষও বলা হয় । তা ওয়া জাতির এমন একটি স্থান , যেখানে কাঠের ঢোলের প্রতি উপাসনা করা হয় । এটাও ওয়া জাতির গ্রামের প্রতীক । কাঠের ঢোল কক্ষ ওয়া জাতির পবিত্র স্থান , তা অন্যান্য জাতির ধর্মীয় মন্দিরের মতোই শ্রদ্ধারস্থান । কাঠের ঢোল কক্ষের ভেতরে সাধারণতঃ পুরুষ লিঙ্গ আর স্ত্রীলিঙ্গ দুটি কাঠের ঢোল আছে । পুরুষ লিঙ্গের কাঠের ঢোল দেখতে খাটো ও পাতলা । স্ত্রীলিঙ্গের কাঠের ঢোল মোটা আর এর আকার বিরাট । কেন না ওয়া জাতি এমন একটি জাতি , যারা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা করে । তারা কাঠের ঢোলকে মায়ের প্রতি বিশেষ প্রতীক বলে মনে করে । রুপ কথা অনুযায়ী , অনেক আগের কথা , ওয়া জাতির গ্রামে সময় সময় দুর্যোগ হতো । দুর্যোগের কবল থেকে রেহাই পাওয়া আর গ্রামবাসীদের স্বস্তি সুকামনা করার জন্য লোকেরা এক ধরণের হাতিয়ার প্রস্তুত করার প্রচেষ্টা চালাতো । প্রথমে লোকেরা যে কাঠের ঢোল প্রস্তুত করেছে , তা থেকে কোনো শব্দ শোনা যেতো না । এই সময় একজন বৃদ্ধা তাদের পরামর্শ দিলেন যে , কাঠের ঢোলের শব্দ শুনতে চাইলে তা নারীর দেহের মতো প্রস্তুত করতে হবে । মিস্ত্রীরা বৃদ্ধার কথা শুনে এক ধরণের কাঠের ঢোল প্রস্তুত করলো। ফলে কাঠের ঢোল থেকে মিষ্টি আর উত্সাহব্যঞ্জক শব্দ বেরিয়ে আসলো ।
ওয়া জাতির লোকেরা যখন কাঠের ঢোল বাজায় , তখন সাধারণতঃ দুই ধরণের শব্দ শোনা যায় । একটি ঢং ঢং শব্দ আর একটি থপ্ থপ্ শব্দ । এই দুই ধরণের শব্দের তালে তালে ওয়া জাতির নর-নারীরা লোক সংগীত আর স্বত্তস্ফূর্তভাবে নাচতে শুরু করে । তারা যথোচিতভাবে নিজেদের ভাব প্রকাশ করে । ওয়া জাতির তরুণ সেনো বলেছেন ,
কাঠের ঢোল আমাদের জাতির সবচাইতে পবিত্র বাদ্যযন্ত্র । তা থেকে যে দুই ধরণের শব্দ বাজানো হয় , তার মধ্যে মোটা ও থপ্ থপ্ শব্দ যুবকদের বীর , হিংসুখ ও দয়ালু স্বভাব এবং তীক্ষ্ণ শব্দ মেয়েদের নাচ গান পরিবেশনের নৈপুন্যের প্রতিনিধিত্ব করে ।
ওয়া জাতির গ্রামে কাঠের ঢোলের অবস্থান অসাধারণ । সুতরাং কাঠের ঢোল বানানোও গ্রামের একটি সবচাইতে বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ কাজ বলে মনে করা হয় । প্রতি বছর যখন নতুন কাঠের ঢোল বানান প্রয়োজন হয় , তখন ওয়া জাতির লোকেরা বনে গিয়ে সবচেয়ে শক্ত গাছ বাছাই করে । গাছটা বাছাই করার পর গ্রামবাসীরা জাদুকরের পরিচালনায় গাছটা কেটে গ্রামে নিয়ে আসেন । তার পর কাঠের ঢোল বানানোর কাজ শুরু হয় ।
কাঠের ঢোল বানানো একটি পবিত্র কাজ । তার বিশেষ কৌশল রয়েছে । ওয়া জাতির মেয়ে ওগুয়েই বলেছেন ,
যেহেতু কাঠের ঢোল বানানো সূর্যালোকের ওপর নির্ভর করে , সেহেতু একদিনে শুধু মাত্র কয়েক ঘন্টা তা বানানো যায় । একটি কাঠের ঢোল বানাতে হলে কয়েক সপ্তাহ ধরে চার পাঁচ জনের শ্রম শক্তি প্রয়োজন ।
কাঠের ঢোল ওয়া জাতির মনে দেবতার সঙ্গে কথাবার্তা আর আদান প্রদানের মাধ্যম বলে মনে করা হয় । তার অবস্থান অদ্বিতীয় । তারা মনে করে যে , দেবতা মানুষের ভাষা বুঝে না , কিন্তু কাঠের ঢোলের শব্দ বুঝে । সুতরাং ওয়া জাতির লোকেরা কাঠের ঢোল বাজানোর মাধ্যমে দেবতার সঙ্গে আত্মার সংযোগ করে । এতে তাদের বিপদ ও দুর্যোগ এড়ানো আর গ্রামবাসীদের সুখ ও শান্তি কামনার ভাব প্রকাশ করা হয় । দেবতার সঙ্গে আদান প্রদানের প্রক্রিয়ায় ওয়া জাতির লোকদের মধ্যে ধীরে ধীরে কাঠের ঢোলের অসাধারণ ভাষা সৃষ্টি হয়েছে ।
মাদাম সিয়ে লিন দীর্ঘকাল ধরে সংখ্যালঘুজাতির সংস্কৃতি সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত আছেন । তিনি বলেছেন ,
কাঠের ঢোল যে ওয়া জাতির লোকদের জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হয়েছে , তাতে মায়ের প্রতি ওয়া জাতির লোকদের শ্রদ্ধা , নারী ও প্রবীণদের প্রতি তাদের মর্যাদা প্রদর্শন ব্যক্ত হয়েছে । কাঠের ঢোল থাকলে ওয়া জাতির গ্রাম সজীব হয়ে উঠে এবং গ্রামের আত্মা থাকে ।
কাঠের ঢোল ওয়া জাতির পবিত্র সামগ্রী । আগে শুধু যখন বিপদ আর দুর্যোগ আবিভূর্ত হতো , তখনই তাকে ব্যবহার করা হতো । এখন কাঠের ঢোল ওয়া জাতির নৃত্যের একটি অবশ্যম্ভাবী বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হয়েছে । কাঠের ঢোলের মতো ওয়া জাতির বহু নৃত্যও উপাসনা তত্পরতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে । এখন ধর্মীয় উপাসনার পরিবেশ ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে গেছে , তা জনসাধারণের আমোদ প্রমোদ আর নৃত্যে পরিণত হয়েছে ।
ওয়া জাতির লোকেরা কাঠের ঢোলের শব্দ শুনলে নাচতে চায় । পুরুষরা বীর আর জোয়ান , মেয়েরা স্ফূর্তিপূর্ণ আর তাদের প্রাণ শক্তি বেশি । নৃত্যের সময় তাদের লম্বা চুল , চুলের রূপোর সাজানো জিনিষ , বড় চোখ আর কালো ভ্রুতে প্রকৃত ভালবাসা আর যৌবন প্রতিফলিত হয়েছে ।
|