দক্ষিণ পশ্চিম চীনের সি চুয়ান প্রদেশের রাজধানী ছেং তু শহরের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ , শীতকালেও ছেং তু শহরের সর্বত্র সবুজ গাছ দৃষ্টিগোচর হয় , শহরবাসীরা উপকন্ঠের পল্লীগ্রামে গিয়ে ছুটি কাটাতে অভ্যস্ত ।
ছেং তু শহরের উপকণ্ঠে দশ হাজারেরও বেশী কৃষক পরিবার তাঁদের বাড়িঘর ও আঙগিনাকে হোটেলে রুপান্তরিত করে শহরবাসীদের ছুটি কাটানোর প্রয়োজনীয় শর্ত সৃষ্টি করেছে । ফলে শীতকাল ও বসন্তকালের বড় বড় উত্সব উপলক্ষে ছুটি কাটাতে আসা শহরবাসীদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে তিন চার লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে ।
বসন্তকালের একদিন সকালে। মি:চেন জির পরিবারের সঙ্গে সি আর আইয়ের সংবাদদাতা গাড়িতে করে যখন সিংফুমেই লিন নামে পুর্ব উপকণ্ঠের একটি গ্রামে গিয়ে হাজির হন, তখন নির্মেঘ আকাশ থেকে সুর্যকিরণ গলেগলে পড়ছে । রৌদ্রস্নাত গায়ে বেশ আরাম বোধ হয় । শোনা যায় , প্লাম ফুলের চাষ স্থানীয় কৃষকদের ঐতিহ্যিক জীবিকা । চার দিকে দেখা যায় ,গুচ্ছ গুচ্ছ প্লাম ফুল ফুটেছে । প্লাম ফুলের জন্য এই স্থানের নাম হয়েছে সিংফুমেই লিন । চীনা ভাষায় সিংফুর মানে সুখ , আর মেই লিন মানে প্লাম ফুলের বন ।
মি: ছেন সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , ছুটি পেলে শহরবাসীরা সপরিবার এখানে বেড়াতে আসে । তাঁরা প্লাম ফুলের গাছের তলায় বসে প্লাম ফুল উপভোগ করছেন ,তাস খেলেন , গল্পগুজব বা আড্ডা করেন , অথবা কৃষিক্ষেতে পায়চারী করেন আর রোদ পোহান । আকাশচুম্বী আবাসিক ভবন থেকে বেরিয়ে খোলামাঠে এসে টাটকা হাওয়া ও সোনালি রোদ উপভোগের বিরল সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে রাজী নন । মি: ছেন বলেছেন , এখানকার বসতবাড়ি , রংবেরংয়ের ফুল , গাছগাছালি এবং খাবার সবই দেখবার মত ।
তিনি বলেছেন ,প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত স্থানীয় বসতবাড়ির রয়েছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য । প্রতিটি বসতবাড়ির চারপাশে প্লামফুলের সমারোহ । কৃষকদের তৈরী খাবার খুবই সুস্বাদু ।
সিংফু মেই লিনের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোহর । বাতাসে মন-মাতানো ফুলের সৌরভ । প্লাম ফুলবনের পাশে হ্রদের নীল স্বচ্ছ পানি টলটল করছে । ছোটো পাহাড়ের পাদদেশে টালি ছাওয়া পুরনো বসতবাড়ি। । কাঁচা রাস্তার দুপাশে ফুল , ঘুড়ি , স্থানীয় খাদ্যদ্রব্য , হস্তশিল্পজাত দ্রব্যের পশরা। চঞ্চল ছেলেরা ছুটাছুটি করছে । মি: ছেন তাঁর নাতনি নিয়ে হ্রদের ধারে ঘুড়ি উড়াতে গেলেন , তাঁর স্ত্রী প্লাম গাছের তলায় সুয়েটার বুনতে বুনতে রোদ পোহাচ্ছেন । তাঁর পরিবারের সবাই বসন্তকালের সৌন্দর্যের পুজারী ।
মি: ছেনের সঙ্গে সি আর আইয়ের সংবাদদাতার যে কয়েক ঘন্টা কেটেছে সেই সময় দেখা গেলো মেইলিন বনে পর্যটকদের অবিরাম সমাগম । পর্যটকদের মধ্যে কেউ বাসে করে এসেছেন , কেইবা ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে এসেছেন । গ্রামের মুখে পড়ে গেছে ব্যক্তিগত গাড়ির লাইন ।
পল্লীগ্রামে এক দিনের ভ্রমণ ব্যয়বহুল নয় , দুবেলার খাবার আর চা খেতে মাথাপিছু খরচ হয় মাত্র বিশ ইউয়ান ।
পর্যটকদের মধ্যে রয়েছেন অনেক তরুন। তারা হাঁটতে হাঁটতে টেপরেকর্ডার বাজিয়ে গান জুড়ে দিয়েছেন।
গ্রামীন পর্যটন যেমন ছেন তু শহরের নাগরিকদের আনন্দরস যুগিয়েছে ,তেমনই স্থানীয় কৃষকদের আয়ের নতুন পথ খুলেছে । ৬১ বছর বয়সী মাদাম লিউ সান ফাংয়ের পরিবার অতীতে শুধু ফুলের চাষ করত । গত বছর যখন তিনি টের পেলেন , ছেং তু শহরের নাগরিকরা দলে দলে গ্রামে বেড়াতে আসেন , তখন তিনি স্থির করলেন, তিনি পর্যটন শিল্পে আত্মনিয়োগ করবেন । তিনি পুরনো বাড়িঘর নতুন করে সংস্কার করে সাজালেন ।তারপর স্থানীয় সরকারের অফিস থেকে রেঁস্তোরা চালানোর সার্টিলিকেট নিলেন ।তিনি তার রেঁস্তোরার নাম দিয়েছেন " সুগন্ধি প্লাম ফুল " তাঁর পরিবারের সরলপ্রাণ সদস্যরা ক্লান্তিহীনভাবে রেঁস্তোরা চালাচ্ছে।
মাদাম লিউ সান ফাং বলেছেন , আমার রেঁস্তোরার খাবার খেতে পর্যটকদের খুবই ভালোলাগে। মাছ ও শাক-সবজি রান্নার পদ্ধতি শহর থেকে আলাদা । রেঁস্তোরার শাক সবজি টাটকা , মসলা উন্নত মানের , মুরগি আমাদের নিজদের পালিত ।গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা খাবার এবং শীতকালে গরম খাবার সরবরাহ করা হয়।খদ্দেররা আমাদের তৈরী খাবারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ।
মাদাম লিউ সান ফাঙ আরো বলেছেন, প্রতিদিন একশোজনেরও বেশী পর্যটক তাঁর রেঁস্তোরায় খেতে আসেন , তাই রোজ তাঁকে দশ ঘন্টা কাজ করতে হয় । তিনি খুবই ক্লান্ত, কিন্তু মন তাঁর প্রসন্ন । কারণ তাঁর রোজগার তিনচার গুণ বেড়েছে।
মি: ছেনকে নিয়ে ছেং তু শহরের উপকন্ঠে একদিন ভ্রমণের পর আমাদের সংবাদদাতা প্রত্যক্ষভাবে ছেংতু শহরবাসীদের জীবন উপভোগ ও ভ্রমণ-অনুরাগের পরিচয় পেয়েছেন । মি: ছেন সগর্বে বলেছেন, অন্যান্য শহরের যারা ছেংতু শহর ভ্রমন করে গেছেন তারা একবাক্যে বলেছেন , অন্যান্য শহরের তুলনায় ছেনতু শহরের চায়ের দোকান, চিত্তবিনোদনের স্থান ও গ্রামীন হোটেলের সংখ্যা অনেক বেশী ।তবে এক সময় তাঁদের মনে প্রশ্ন উঠেছিল যে, গ্রামে গিয়ে তাঁদের ভ্রমণের এতবেশী সময় পাওয়া গেল কোথা থেকে । তাঁদের এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলেন ছেংতু শহরের ৫৪ বছর বয়সী নাগরিক মাদাম রি গুই চেন।তিনি বলেছেন ,ছেন তু শহরের মানুষ ভ্রমন অনুরাগের জন্য প্রসিদ্ধ। অফিসে কাজ সেরে দু চার জন বন্ধু নিয়ে টাটকা হাওয়া খেতে উপকন্ঠে গিয়ে ছুটি কাটানো নি:সন্দেহে একটি আরামদায়ক ব্যাপার । আমিও গ্রামে গিয়ে ছুটি কাটাতে পছন্দ করি ।
ছেংতু শহরের মানুষ যে পরিশ্রম করতে পছন্দ করেন না , তা সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে জীবন সম্বন্ধে তাঁদের দৃষ্টিভংগী স্বতন্ত্র ।তাঁদের মতে চাকরি নিশ্চয় করতে হবে ,তবে চাকরি করার চুড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো হালকা মনে জীবন উপভোগ করা । সুতরাং কাজের সময় তাঁরা একাগ্রচিত্তে কাজ করেন । কাজ শেষ করার পর জীবনের আনন্দরসের আস্বাদ নেন ।
|