চীনের চলচ্চিত্র মহলে কয়েকজন ত্রিশ বছর বয়সের যুব পরিচালক আছেন , তাঁরা দর্শকদের জন্য কিছু নতুন স্টাইলের ছবি উপহার দিয়েছেন । চীনে তাদেরকে ষষ্ঠ বংশের পরিচালক বলা হয় । পরিচালক লু ছুয়ান তাঁদের মধ্যে একজন ।
২০০৪ সালের শেষ দিকে লু ছুয়ানের পরিচালিত কাহিনী ছবি ' কোকোসিলি ' চীনের তথা এশিয়ার দর্শকদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ছায়াছবি ' কোকোসিলি ' চীনের প্রথম পশ্চিমাংশের উত্তেজনাপূর্ণ ছবি , এই ছবি কাহিনী ছবি হলেও প্রামান্য ছবির মতো সত্য মনে হয় । এই ছায়াছবিতে আটজন পাহাড় রক্ষী দলের সদস্যের পশ্চিম চীনের ছিংহাই -তিব্বত মালভূমির নির্জন কোকোসিলি অঞ্চলে চীনের বিলুপ্তপ্রায় তিব্বতী এন্টিলোপ শিকার প্রতিরোধের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে । এই আটজন পাহাড়-রক্ষী দলের সদস্য দুরুহ প্রাকৃতিক পরিবেশে হিংস্র ও লোভী শিকারীদের বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে সংগ্রাম চালিয়েছেন , শেষে আটজনের মধ্যে মাত্র তিনজন জীবিত অবস্থায় কোকোসিয়া থেকে ফিরে আসেন ।
এই ছায়াছবি এক সত্যি কাহিনীর ভিত্তিতে তৈরী হয়েছে । এই ছবির রচয়িতা ও পরচালক হিসেবে লু ছুয়ান কোকোসিলিতে ঘটিত এই বাস্তব ঘটনা শুনে বিপুলভাবে অভিভূত হয়েছিলেন । তিনি বলেছেন , ঠিক কোকোসিলির নির্জন এলাকায় পাহাড়রক্ষীদের কাহিনী আমাকে মুগ্ধ করেছে ,তাই আমি এই কাহিনী সবাইকে অবহিত করার আশা রাখি । প্রত্যেক পরিচালকের ছায়াছবি তার নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত । দর্শকরা ছায়াছবি থেকে পরিচালকের মনের আকাঙ্খা , তার স্বপ্ন, তার মনের ব্যথা ও আনন্দ বুঝতে পারেন । আমি যে ' কোকোসিলি' ছবি পরিচালনা করেছি , তা' আমার জীবন ও আতাঙ্খার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ।
৩৩ বছর বয়সের লু ছুয়ান এক ভদ্র লোক , তার ভদ্রতা দেখে কেউ ভাবতেও পারেন না যে তিনি ' কোকোসিলির ' মতো চিত্তাকর্ষক ছবি পরিচালনা করতে পারেন , কিন্তু তিনি কাজ করার সময় চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেন না , তিনি ও তার সহকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই ছবি তৈরী করেছেন ।
কোকোসিলি চীনের ছিংহাই-তিব্বত মালভূমির থানকুরা পর্বত ও কুনলুন পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত , এই জায়গা চীনের দীর্ঘতম নদী ইয়াংসি নদীর উত্পত্তিস্থল । সমুদ্রসমতল থেকে পাঁচ হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই অঞ্চলে শীত বেশী , বায়ুর মধ্যে অক্সিজেনের পরিমাণ মাত্র সমুদ্র সমতল অঞ্চলের অর্ধেক , এই অঞ্চল মানুষের থাকার অনুপযোগী বলে অভিহিত করা হয় । কিন্তু এই অঞ্চলে দুর্লভ তিব্বতী এন্টিলোপ থাকে , তার নরম লোম দিয়ে মূল্যবাণ চাদর তৈরী করা যায় । অনেক বেআইনী শিকারী টাকা-পয়সার জন্য তিব্বতী এন্টিলোপ শিকার করে , পাহাড়রক্ষী দলের অনেক সদস্য তিব্বতী এন্টিলোপ রক্ষার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন করেছেন ।
পরিচালক লু ছুয়ান এই ছায়াছবিতে কোকোসিলির বরফ আচ্ছাদিত পাহাড় , তৃণভূমি , আয়নার মতো সচ্ছ হ্রদ আর তিব্বতী এন্টিলোপেরমালভূমিতে দৌড়ের দৃশ্য দেখানো হয়েছে , ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে জীবজন্তু মানুষের মরদেহ খাওয়া ,মানুষের জীবন্ত কবর দেয়া আর পাহাড়রক্ষী ও শিকারীদের গুলিবিনিময়ের দৃশ্য দর্শকদের মন আন্দোলিত করে । লু ছুয়ান বলেছেন , এই নির্জন মালভূমিতে মানুষ এতো দুর্বল যে মুহুর্তের মধ্যে প্রাণহানি হতে পারে । তিনি আশা করেন এই ছবি দেখে দর্শকরা জানতে পারেন চীনে এমণ বিশাল ও সুন্দর নির্জন ভূমিও আছে ।
ছায়াছবি ' কোকোসিলি ' তৈরী করতে চার মাস সময় লেগেছিল , প্রথম দিকে লু ছুয়ান ও তার সহকর্মীর সংখ্যা ছিল মোট ১০৮জন , কিন্তু ছিংহাই –তিব্বত মালভূমির দুরুহ প্রাকৃতিক অবস্থার দরুণ অনেক কর্মী শারিরীক কারণে শেষ পর্যন্ত কাজ করতে পারেন নি , এই ছবি তৈরীর কাজ সম্পন্ন হওয়ার সময় কর্মী সংখ্যা কমে হয় মাত্র ৬০জন । এই ছবি তোলার সময় লু ছুয়ান ও তার সহকর্মীরা অসহনীয় কষ্ট ভোগ করেছেন । প্রবল বাতাস ও বরফে শুধু মানুষের উপরের অংশ অস্পষ্টভাবে দেখা যায় , নীচের অংশ কিছুই দেখা যায় না , অক্সিজেনের অপর্যাপ্ততার দরুন লু ছুয়ান ও তার সহকর্মীরা সব সময়ই ক্লান্ত মনে করতেন ।এই ছবি তৈরীর সময় লু ছুয়ানের প্রচুর চুল পড়ে গিয়েছে , তার হৃডপিন্ডেরও সমস্যা হয়েছিল । কিন্তু লু ছুয়ান মনে করেন , যদিও এই ছবি তৈরীর সময় অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন , কিন্তু এতে অনুশোচনার কিছু নেই । কারণ এই নির্জন ভূমিতে তিনি জীবন সম্বন্ধে নতুন উপলব্ধি পেয়েছেন । তিনি বলেছেন , শহরাঞ্চলে নিজেকে খুব শক্তিশালী মনে হতে পারে , কিন্তু এই নির্জন মালভুমিতে প্রকৃতির সামনে মানুষ অত্যন্ত দুর্বল । লু ছুয়ান বলেছেন , মানুষের প্রকৃতির মধ্যে অনেক অনির্দিষ্ট উপাদান আছে , পরিবেশ মানুষের প্রকৃতি পরিবর্তন করতে পারে , অস্তিত্ব হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি , ছায়াছবি ' কোকোসিলি ' তৈরীর সময় আমি এই প্রশ্ন উপলব্ধির সুযোগ পেয়েছি ।
লু ছুয়ান একজন সৈনিক ছিলেন , তিনি সৈন্যবাহিনীর বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন । ছায়াছবি পছন্দ করেন বলে তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে পেইচিং সিনেমা ইন্সটিটিউটের পরিচালক বিভাগে স্নাতকত্তোর ছাত্র হিসেবে পড়াশুনা করেছেন । ১৯৯৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত লু ছুয়ান ' বন্দুক অনুসন্ধান ' ও ' কোকোসিলি ' নামে দুটি ছবি পরিচালনা করেছেন , এই দুটি ছবি চীনের দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে । ' বন্দুক অনুসন্ধান ' ছবিটিতে চীনের এক সীমান্ত এলাকার পুলিশ মা শানের নিজের হারানো বন্দুক খোঁজার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে । লু ছুয়ান একজন আদর্শবাদী , তিনি ছায়াছবি ' কোকোসিলি 'তে পাহাড় রক্ষী দলের প্রধানের গায়ে নিজের অনেক অনুভূতি মিশিয়ে দিয়েছেন । ছবির শেষে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করার পর যখন সবাই মনে করেন পাহাড় রক্ষীরা বিজয় লাভ করেছেন , ঠিক এই সময় দলের প্রধান শিকারীর গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন , অপ্রস্তুত অবস্থায় এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে অনেক দর্শকের চোখে জল এসে যায় ।
একজন যুব পরিচালক হিসেবে লু ছুয়ান নিজেকে ধন্য মনে করেন । তিনি বলেছেন , আমি আশির দশকে জন্ম নিয়েছি , আমি চীনের সংস্কার অভিযান নিজের চোখে দেখেছি । সংস্কার অভিযানের কল্যানে আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারি , ইচ্ছানুসারে সাহিত্য রচনা করতে পারি , আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশী স্বাধীনতা পেয়েছি । বর্তমানে লু ছুয়ান এক যুদ্ধ সম্পর্কিত ছবি তৈরীর প্রস্তুতি নিচ্ছেন ।
|