' লাল মোম ' হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের মনে তাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের সবচেয়ে উপযুক্ত উপমা , কেননা শিক্ষকরা ' লাল মোমের ' মত নিজেকে ক্ষয় করার সংগে সংগে অন্যদের আলো দেন । গত ১০ সেপ্টেম্বর চীনের বিংশতিতমো শিক্ষক দিবস । এই উপলক্ষে চীনের শিক্ষা মন্ত্রনালয় সমগ্র দেশের দু হাজার আট শ'জন আদর্শ শিক্ষককে পুরষ্কার দিয়েছে । পুরষ্কৃত আদর্শ শিক্ষকরা ঠিক লাল মোমের মতো কাজ করে এসেছেন । আজকের সংস্কৃতি সম্ভার আসরে চীনের কয়েকজন আদর্শ শিক্ষকের কথা শ্রোতাবন্ধুদের কিছু বলছি ।
চীনের শহরাঞ্চলে আধুনিক স্কুলদালান ও উচ্চমানের সরঞ্জাম আছে , কিন্তু চীনের পল্লী অঞ্চলে , বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও পশ্চাত্পদ পাহাড়ী অঞ্চলে আধুনিক স্কুল নেই , সেই সব অঞ্চলে শিক্ষকদের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় । চীনের অন্তর্মঙ্গলিয়ার খালাছিং জেলার শিক্ষক লি সিং সিয়াও ৩১ বছর ধরে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করে আসছেন । এর মধ্যে ২৯বছর তিনি একা একটি প্রাথমিক স্কুল পরিচালনা করেছেন । তিনি দিনের বেলায় ছেলেমেয়েদের ক্লাস নেন , রাতে ক্লাসের প্রস্তুতির কাজ করেন । প্রতিদিন তিনি ছেলেমেয়েদের সংগে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সংগে সংগে পতাকা উত্তোলন করেন , গত ত্রিশ বছরে তিনি একা আশেপাশের স্কুলবয়সী ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিক্ষিয়েছেন , তার হাতে একটি ছাত্রও স্কুল-ছুট হয় নি । এই গ্রামের মোট ২৪০জন ছেলেমেয়ে লি সিং সিয়ার কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছেন। শিক্ষক লি সিং সিয়াওয়ের মতো শিক্ষক চৌ ইউ ইয়ুও একা একটি গ্রামীন স্কুল চালিয়েছেন । ১৯৭৪ সালে চিয়াং সি প্রদেশের ইউন সিউ জেলার তোলিন মহকুমার হুয়ান লিন গ্রামে এই প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় । শিক্ষক চৌ ইউ ইয়ুন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো ছাড়া বাচ্চাদের জন্য রান্না করেন এবং তাদের দেখাশোনার দায়িত্বও পালন করেন । সময় পেলে স্কুলের টেবিল ও জানালা মেরামতের কাজও করেন । গ্রামের চল্লিশাধিক ছেলেমেয়ে যাতে তার কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা পেয়ে একটু বড় হয়ে জেলা বা প্রদেশের উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করতে পারে , সেজন্য চৌ ইউ ইয়ুন গান , ব্যায়াম ও ছবি আঁকাসহ সব ধরনের বিষয়ের ক্লাসের ব্যবস্থা করেছেন । তিনি আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন , আমি একজন যোগ্য শিক্ষক হতে চাই , ছেলেমেয়ের জন্য আমি সব ধরনের কষ্ট ভোগ করতে পারি ।
পল্লী অঞ্চলের আরেকজন শিক্ষিকার কথাও উল্লেখযোগ্য । তার নাম মা সিয়েন হুয়া । তিনি উত্তর চীনের চিলিন প্রদেশের হুন ছুন শহরের অধীনস্থ কুও শু খামারের কুও শু প্রাথমিক স্কলের শিক্ষক । ১৯৯৬ সাল থেকে রোজ তাকে চারটে পাহাড় ও পাঁচটি নদী পার হতে হতো এবং ১৭ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হতো । তিনি একা ছয় শ্রেনীর ছেলেমেয়ের আটটি বিষয়ের ক্লাস নেন । গত সাত বছরে তিনি মোট দশ হাজার বার পাহাড় অতিক্রম করেছেন , ২৫ হাজার বার নদী পার করেছেন এবং লাল ফৌজের তিনগুন পথ হেঁটেছেন । নিজের শিক্ষকতা জীবন সম্বন্ধে তিনি বলেছেন , আমি ছেলেমেয়েকে ভালোবাসি , সাত বছরে ক্লান্ত হলেও আমি ছাত্রছাত্রীদেএকটি ক্লাসও বাদ দেই নি ।
ঠিক লি সিং সিয়াও , চৌ ইউ ইয়ুন আর মা সিয়েন হুয়ার মতো চীনের বিস্তীর্ণ পল্লী অঞ্চলের ৮০ লক্ষ শিক্ষক নীরবে কষ্ট সহ্য করে প্রতিদিন ছেলেমেয়েদের পড়ান , তাদের নিস্বার্থ পরিশ্রমের কল্যানেই গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনার মাধ্যমে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন , এই আশি লক্ষ পল্লী অঞ্চলের শিক্ষক ছেলেমেয়েদের মনকে জ্ঞানের আলোতে উদ্ভাসিত করেছেন । আধুনিক শিক্ষাবিদ সিয়া কাই চুন বলেছিলেন , ঠিক যেন পুকুরে পানি থাকতে হয় ,শিক্ষকের মনে ভালোবাসা থাকতে হয় । আদর্শ শিক্ষকরা তাদের মনের ভালোবাসা , তাদের নৈতিক শক্তি দিয়ে ছাত্রদের মানুষ করার ভিত্তি স্থাপন করেছেন ।
উত্তর পূর্ব চীনের লিয়াও নিং প্রদেশের হাই ছেন শহরের উয়ান থাই মহকুমার তা লু প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা মেন লি পিং একজন বহুমুত্র রোগী । গত দশ বারো বছরে মেন লি পিং প্রতিদিন দুবার ইনসুলিন ব্যবহার করেন । তার ছেলে জন্ম নেয়ার সংগে সংগেই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয় , তার স্বামী মেন লি পিংকে ছেড়ে চলে গেছেন , জীবনের এই সব দুঃখকষ্ট হলেও মেন লি পিং এক দিনও ছুটি নেন নি । তিনি বলেছেন , আমার ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য আমি সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে পারি । তিনি শুধু লক্ষী ছেলেমেয়েকে ভালোবাসেন , তাই নয় , ক্লাসের দুষ্টু ছেলেদেরও ভালোবাসেন , তার ক্লাসের একটি ছেলে সাপের চামড়া তার টেবিলে রেখে তাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল , কিন্তু তিনি এতে রাগ করেন নি , বরং ধৈর্য্যর সংগে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন , তার ছাত্রছাত্রীরা তাকে খুব পছন্দ করেন , তিনি তার ভালোবাসা দিয়ে ক্লাসের প্রত্যেক ছেলেমেয়ের মন জয় করেছেন ।
ইউনান প্রদেশের হানি জাতি ও ই জাতির স্বায়তশাসিত জেলার হানি জাতির শিক্ষিকা চৌ ইউ চেন নিজের ছাত্র নদীতে পড়েছে দেখে সাতার না জেনেও ছাত্রকে বাচাঁনোর জন্য তত্ক্ষনাত নদীতে ঝাপ দিলেন । তিনি ছাত্রকে পানি থেকে তুলে ধরার পর অজ্ঞান হলেন , ছাত্রছাত্রীর প্রতি সুগভীর ভালোবাসা পোষন করেই সাতার না জানা চৌ ইউ চেন নিজের জীবন উপেক্ষা করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন ।
চেচিয়ান প্রদেশের সাও সিন শহরের সিন ছান মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হুয়ান লিন ও তার সহকর্মীরা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে অনেক সাফল্য অর্জন করেছেন। তাদের পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে ২৩৫টি প্রদেশের পুরষ্কার , ৫৩টি জাতীয় পুরস্কার আর চারটে আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পেয়েছে । শিক্ষক হুয়ান লিনের সাহায্যে ছাত্রদের সৃজন শক্তি বেড়েছে , হাত দিয়ে যন্ত্রপাতি তৈরীর ক্ষমতা বেড়েছে ।
পুরস্কার দেয়ার অনুষ্ঠানে উত্তর পূর্ব চীনের হারবিন শিল্প বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার মা চু কুয়ান পেইচিংয়ের মহা গণ ভবনের মঞ্চে দাড়াতে পারেন নি , তিনি গত বছরের ১৫ই জুলাই চিরকালের জন্য হাতের বই রেখে চলে গেলেন । ঠিক তিনিই সরকারের অর্থবরাদ্দের অপেক্ষা না করে নিজের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজার শিক্ষা বিষয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষনায় সাফল্য অর্জন করেছিলেন ।
চীনের এক লক্ষেরও বেশী শিক্ষক মোমের মতো নিঃস্বার্থভাবে নিজের তাপ ও আলো ছাত্রছাত্রীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ আলোকিত করেছে , তাদের নিরলস প্রয়াসের কল্যানেই চীনের শিক্ষাব্রতের দ্রুত প্রসার হচ্ছে ।
|