চীনের রাজধানী পেইচিং এমন একটি মহানগরী , যেখানে সুদীর্ঘকালীন ইতিহাস আর সুগভীর সংস্কৃতি রয়েছে । সেখানে বহু দক্ষ হস্ত-শিল্পী বাস করেন । তাদের তৈরী ঘুড়ি , কাঁচের আঙ্গুর , মাটির পুতুল প্রভৃতি হস্তশিল্পপণ্য দৃষ্টি-আকর্ষী, প্রায়োগিক আর চিত্তাকর্ষক। এ সব শিল্প ক্রেতাদের কদর পেয়েছে । বিশেষ ঐতিহাসিক কারণে এই সব শিল্পী সাধারণতঃ মান , মঙ্গোলিয়, হুই প্রভৃতি সংখ্যালঘুজাতির মানুষ।
পেইচিংয়ের এপ্রিল মাসে উচ্ছ্বল সমীরণ। এটি ঘুড়ি উড়ানোর সোনালী মৌসুম । নগর কেন্দ্রে অবস্থিত প্রসিদ্ধ থিয়েন আন মেন মহাচত্বর থেকে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা পর্যন্ত্র সর্বত্রই দেখা যায় শহরবাসীরা আনন্দের সংগে ঘুড়ি উড়ান । আকাশে সোয়ালো পাখি , প্রজাপতি , ঈগল ইত্যাদি নানা আকারের যে বৈচিত্র্যময় ঘুড়ি উড়ে , সে সবের মধ্যে কতকগুলো চীনের ঐতিহ্যিক কাগজ দিয়ে বানানো হয় আর বাকীগুলো কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরী হয় । ঐতিহ্যিক কাগজের ঘুড়ি ডিজাইনের দিক থেকে বৈচিত্র্যময় , রংবেরংয়ের আর তার নিগূঢ় চীনা বৈশিষ্ট্য রয়েছে ।
চীনে ঘুড়ি উড়ানোর ইতিহাস ২ হাজার বছরেরও বেশি পুরানো । যারা নিয়মিতভাবে ঘুড়ি উড়ান , তারা জানেন পেইচিংয়ে চীনা ঐতিহ্যিক ঘুড়ির মধ্যে হা নামে ঘুড়ি সবচাইতে সুপরিচিত । ঘুড়ি হা মানে পেইচিং শহরে হুই জাতির হা বংশের একটি পরিবারের তৈরী ঘুড়ি । তা এখন একটি ট্রেড মার্কায় পরিনত হয়েছে । এই পরিবারের লোকেরা সাধারণতঃ রেশমী কাপড় দিয়ে ঘুড়ি তৈরী করেন । এই ধরনের ঘুড়ির ডিজাইন বৈচিত্র্যময় । শহরবাসীদের তা খুব ভাল লাগে ।
মিঃ হা ইয়ে ছি হা বংশের চতুর্থ প্রজন্মের শিল্পী। তার বংশের ঘুড়ি তৈরীর ইতিহাস প্রসংগে তিনি বলেছেন , ছিং রাজবংশ আমল অর্থাত্ ১৬০ বছর আগে থেকে আমাদের বংশের ঘুড়ি তৈরী শুরু হয় । আমাদের পূর্বপুরুষরা উত্তর চীনের হোপেই প্রদেশের হো চিয়েন জেলায় থাকতেন । এই অঞ্চল একটি হুই জাতি অধ্যুষিত এলাকা । আমার প্র-পিতা-সহ হা বংশের ঘুড়ি বানাতে শুরু করেন। হা বংশের ঘুড়ির প্রথম প্রজন্মের শিল্পী হিসেবে তিনি এই মার্কার ঘুড়ির বিকাশের জন্য ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন । আমার পিতামহ ছিলেন দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী । তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দোকান স্থাপন করে এই ব্যবসা শুরু করলেন ।
গত শতাব্দির প্রথম দিক থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হা বংশের ঘুড়ি খ্যাতনামা হয়েছিলো । ১৯১৫ সালে হা বংশের প্রজাপতি, ফড়িং , সারস আর ফিনিক্স্ এই চারটি ঘুড়িকর্ম পানামায় বিশ্ব মেলায় দেখানো হয়েছিলো । এই সব ঘুড়িকর্ম চীনের ঐতিহ্যিক সূক্ষ্ম হস্তশিল্পের নৈপুণ্যের জন্য দর্শক-সমাদয় এবং রৌপ্য পুরস্কার জয় করেছিলো । হা বংশের ঘুড়ির চতুর্থ প্রজন্মের শিল্পী হিসেবে হা ইয়ে ছি ১০ বছর বয়স থেকে পিতার কাছ থেকে ঘুড়ি তৈরীর প্রযুক্তি শিখতে শুরু করলেন । হা বংশের ঘুড়ির তৃতীয় প্রজন্মের ভিত্তিতে হা ইয়ে ছি আর বংশের অন্যান্য শিল্পীরা আন্তর্জাতিক উন্নত মানের ঘুড়ি-প্রকৌশলের সংগে ঐতিহ্যিক ঘুড়ি তৈরীর প্রকৌশল যোগ করেছেন। ফলে হা বংশের ঘুড়ি তৈরী পেশায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
(আংগুর ছাংয়ের পঞ্চম প্রজন্মের শিল্পী মাদাম ছাং হোং)
ঘুড়ি ছাড়া পেইচিংয়ে রেশমী ফুল , মাটির পুতুল , আঠাল চালের আঠা দিয়ে তৈরী পুতুল , কাচের আংগুর সহ বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যিক হস্তশিল্প পাওয়া যায় । এর মধ্যে কাঁচের আংগুর পেইচিংয়ের এক ধরনের অদ্বিতীয় ঐতিহ্যিক হস্তশিল্প। এই ধরনের হস্তশিল্প দ্রব্য তৈরীর জন্য ভীষণ উত্তাপে কাঁচের কাঁচামাল গলে যাবার সংগে সংগে একটির পর একটি আংগুর তৈরী হয় । রং করার পর সেগুলোকে আংগুরগুচ্ছের মতো যুক্ত করা হয় । আংগুর গুচ্ছের জন্য শাখা ও পাতা যোগানো হয় । অবশেষে বাইরে তুষার-শুভ্র রং স্প্রে করা হয় । বেগুণী ,সবুজ আর সবুজ ও বেগুণী মিশ্রিত এই সব আংগুর চকচকে আর গোলগাল । তা দেখে মনে হয় যেন সত্যিকার আংগুর ।
মঙ্গোলিয় জাতির ছাং বংশের একটি পরিবারের শিল্পীরা এই ধরনের আংগুর তৈরী করেন । লোকেরা তাকে ছাং আংগুর ডাকেন । ছাং বংশের কুটিরে যে সব কাচের খেলনা তৈরী হতো , সেগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল বেগুণী আংগুর । এক শো বছর আগে চীনের শেষ সামন্ততান্ত্রিক রাজবংশ--ছিং রাজবংশের সম্রাজ্ঞী ছি শি ছাং বংশের তৈরী কাঁচের আংগুর দেখার পর তার জন্য বিশেষভাবে অভিলেখন লিখেছেন । তার পর আংগুর ছাং নামে হস্তশিল্প দ্রব্য সুপরিচিত হয়েছে ।
আংগুর ছাংয়ের পঞ্চম প্রজন্মের শিল্পী মাদাম ছাং হোং বলেছেন , কয়েক প্রজন্মের চর্চা আর উন্নয়নের মাধ্যমে এই শিল্পদ্রব্য তৈরীর কৌশল পূর্ণাংগ হয়েছে।
আমাদের পরিবার মঙ্গোলিয় জাতির । ছিং রাজবংশের শেষ দিকে সম্রাট একজন মঙ্গোলিয় রাজকুমারী বেছে নিয়েছিলেন । তার পর আমার পূর্বপুরুষরাও তার সঙ্গে পেইচিংয়ে এসেছেন । আমাদের পরিবারের তৈরী আংগুরের ভিতরে শুন্য । তা খুব হাল্কা । দেখতে স্বচ্ছ, স্ফুর্তিপূর্ণ ।
তিনি বলেছেন, বংশের এই বিশেষ শিল্পদ্রব্য তৈরীর প্রযুক্তি আয়ত্ত করার জন্য ছাং বংশের মেয়েরা বিয়ে করতেন না । পরে আংগুর ছাংয়ের প্রযুক্তি মেয়েকে শেখানো আর ছেলেকে না শেখানো একটি নিয়মে পরিনত হয়েছে ।
যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের আংগুর , মাটির পুতুল , রেশমী ফুল প্রভৃতি ঐতিহ্যিক লোক হস্তশিল্প দ্রব্য ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে । যেহেতু এই সব দ্রব্য প্রধানতঃ ঘরোয়া কুটিরে তৈরী করা হয় এবং সাধারণতঃ ঘুড়ি তৈরীর প্রযুক্তি একজনের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় , সুতরাং বেশ কিছু প্রকৌশল বিলুপ্তির দিকে চলছে । পেইচিং পৌর লোক সাহিত্য ও শিলপকলা সমিতির মহাসচিব ইয়্যু চি হাই বলেছেন , পৌর সরকার আর কতকগুলো বেসরকারী সংগঠন কিছু রক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে ।
বহু ক্ষেত্রের সাহায্যে পেইচিংয়ের বেশ কিছু লোক হস্তশিল্প দ্রব্য তৈরীর প্রকৌশল কার্যকর পুনরুদ্ধার আর রক্ষা পেয়েছে । ইতিপূর্বে যে আংগুর ছাংয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে , তার তৈরীর প্রকৌশল গত বছর পেইচিং লোক সাহিত্য ও শিল্প সমিতির সাহায্যে পুরুদ্ধার হয়েছে । এখন এই প্রকৌশল যাতে প্রজন্মান্তরে চলতে থাকে, তার জন্য বহু লোক-শিল্পী শিশ্যকে শিখাচ্ছেন ।
|