চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের কুইচৌ , কুয়াংশি , ইউনান প্রভৃতি প্রদেশ আর স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল মিয়াও জাতির প্রধান বসবাসের অঞ্চল । ওখানে আছে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি, নদীতে পানি স্বচ্ছ আর প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোরম । মিয়াও জাতির লোকদের আনন্দময় লুসেনের মূর্ছনা আর তাদের রংবেরংয়ের পোষাক পর্যটকদের খুব আকৃষ্ট করে ।
মিয়াও জাতির গ্রামে যখন তরুণরা সুন্দর লুসেন বাদ্যযন্ত্রের সুর বাজায় , তখন তরুণীরা সংগীতের তালে তালে নাচ করে । মিয়াও জাতির দুঃখ-সুখ লুসেনের সুরে সুরে ব্যক্ত করা হয় ।
লুসেন বাঁশের নল দিয়ে তৈরী হয় । দক্ষিণ চীনের বহু সংখ্যালঘুজাতি তা দিয়ে সংগীত বাজাতে পছন্দ করে । তবু অন্যান্য জাতির চেয়ে মিয়াও জাতি ভিন্ন । লুসেন বাজানোর সময়ের ক্ষেত্রে তাদের কড়াকড়ি নিয়মবিধি আছে । মিয়াও জাতির একজন প্রবীণ শিল্পী থাং ফে বহু বছর ধরে লুসেন পরিবেশনের চাকরিতে নিয়োজিত থাকেন । তিনি বলেছেন, লুসেন বাজানোর সময়ের ক্ষেত্রে নিয়মবিধি আছে । প্রতি বছরের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে শরত্কালীন ফসল কাটার পর আর ছুটি কাটানোর সময়ে লুসেন বাজানো হয় । রীতি-নীতি অনুযায়ী , ভাল ফলন না হওয়ার ভয়ে প্রতি বছরের মে মাসের পর লুসেন বাজানো হয় না ।
সুতরাং মিয়াও জাতির গ্রামে যখন লুসেনের সুর বেজে উঠে , তখন সবাই সংগীতের সুরের তালে তালে নাচ করে । যখন বিরাট উত্সব আসে , তখন কয়েক ডজন বা শতাধিক লোক লুসেন বাজান । চড়া সুরের সংগে সংগে বহু লোক নাচ করে । এর দৃশ্য খুবই জাঁকজমকপূর্ণ। মিয়াও জাতির ঐতিহ্যিক উত্সব- শতো পাখীর পোষাক উত্সবে এই ধরনের আড়ম্বরপূর্ণ লুসেন পরিবেশনের দৃশ্য দেখা যায় । শতো পাখীর পোষাক উত্সব এমন একটি উত্সব , যে সময় মিয়াও জাতির লোকেরা হৈ চৈ করে । এই তত্পরতা সাধারনতঃ বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হয় । তখন উত্সবের পোষাক পরা মিয়াও জাতির নরনারী পর্বতে যান । কালো পোষাক পরা তরুণরা আনন্দের সংগে মিষ্টি সুর বাজায় , বাজানোর সংগে সঙ্গেতারা নানা রকম অঙ্গ-ভঙ্গীও প্রদর্শন করে । সূচী কর্মে তৈরী রংবেরংয়ের পোষাক পরা মেয়েরা নাচ করে । নাচ পরিবেশনের সংগে সংগে তাদের মাথার উপরে রুপার অলংকারের ধাক্কার শব্দও স্পষ্ট শোনা যায় । স্ক্যার্টের নীচের রঙ্গিণ ফিতাও নাচের সংগে সংগে উড়ে যায় । এই দৃশ্য যে এত চিত্তাকর্ষক হয় , তাকে ঠিক যেন একটি মনোজ্ঞ ফ্যাশন শো বলে মনে করা হয় ।
মিয়াও জাতির পোষাক রংবেরংয়ের আর বৈচিত্র্যময় বলে বিশ্ববিশ্রুত । মিয়াও জাতির প্রতিটি উত্সবে মেয়েরা পরিপূর্ণভাবে তাদের পোষাক বানানের নৈপুন্যও দেখায় । মিয়াও জাতির পোষাক বানাতে দক্ষ এই জাতির একজন মেয়ে উয়ে ইয়েন ইয়েন বলেছেন, মিয়াও জাতির পোষাককে একটি মহা ঐতিহাসিক গ্রন্থ বলে মনে করা হয় । কারণ এখন যে মিয়াও জাতি আছে , আসলে তা নানা দিক থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে । উত্তর থেকে দক্ষিণে আসার প্রক্রিয়ায় নারীরা সূচী কর্মের মাধ্যমে নিজেদের ইতিহাস পোষাকের উপরে বানিয়েছে । তারা যেখানে গিয়েছে , সেখানেই এই সংস্কৃতি সম্প্রসারিত করেছে ।
প্রকৃতি-প্রেমী মিয়াও জাতির লোকেরা নিজেদের পোষাকের উপরে পাখী , প্রজাপতি , গরু , ড্রাগণ , পাহাড় ও পানি , গাছ প্রভৃতি নক্সা বানিয়েছে । তারা মনে করে যে , এই কাজ প্রীতি ও সৌন্দর্যের প্রতীক । মিয়াও জাতির পোষাক সাধারনতঃ বেগুণী ও লীল রঙভিত্তিক । স্ক্যার্ট হলো তাদের সবচাইতে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পোষাক। মেয়েদের মাথার সাজানোর জিনিসও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন । তাদের রুপালী টুপিতে লাল ও লীল রং সাজানোর জিনিস দেখা যায় ।
মিয়াও জাতির বহু উত্সব আছে । যখন আপনি মিয়াও জাতির গ্রামে যাবেন, তখন লুসেনের মিষ্টি সুর শ্রবন শুনতে পাবেন আর রংবেরংয়ের পোষাক ও রুপার অলংকার দেখেন , তখন আপনি উত্সবের আনন্দ বোধ করতে পারেন । কুয়াংশি রুন স্যুই মিয়াও স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের প্রধান উয়ে মিন সান বলেছেন , রুন স্যুই মিয়াও জাতি জেলা ' শতো উত্সবের থানা' বলে আখ্যায়িত হয় । ওখানে সারা বছরে উত্সব আছে । বহু বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সংখ্যালঘুজাতির চাল-চলন বিবিধ উদযাপনী তত্পরতায় দেখানো হয়। যেমন ঘোড়া প্রতিযোগিতা, লুসেন বাজানো ইত্যাদি ।
রুনস্যুই জেলা কুয়াংশি অঞ্চলের উত্তরাংশের পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত । এটা মিয়াও জাতির একটি স্বায়ত্ত শাসিত জেলা । এখানে এই জাতির আচার ব্যবহার সংরক্ষিত আছে । এই জেলায় আপনি মিয়াও জাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন লুসেনের সুর শ্রবন করতে পারেন এবং এই জাতির সবচাইতে সুন্দর সূচিকর্ম দ্রব্য ও রুপার অলংকার দেখতে পারেন ।
বৈচিত্র্যময় সংখ্যালঘুজাতির রীতি-নীতি আর স্থানীয় মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য বিপুল সংখ্যক পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে । পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন মিয়াও জাতির লোকদের জীবনধারার জন্য বিপুল পরিবর্তন বয়ে এনেছে । যেমন অতীতে রুপার অলংকারকে সম্পত্তির চিহ্ন বলে মনে করা হতো । এখন তা মেয়েদের দৈনন্দিন সাজানোর জিনিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আগে শুধু গুরুত্বপূর্ণ উত্সবে লুসেনের নৃত্য ও সংগীতের পরিবেশন দেখা যেতো , এখন তা মিয়াও জাতির লোকদের অতিথিদের স্বাগত জানানো আর মিয়াও জাতির আন্তরিকতা প্রকাশের এক বিশেষ ধরনের প্রনালীতে পরিনত হয়েছে । মিয়াও জাতির নারীরা অবসরকালে যে একটির পর একটি সুন্দর সূচীকর্মজাত দ্রব্য বানান আর গ্রামের রুপার মিষ্ত্রীরা যে ঝকঝকে রুপার অলংকার তৈরী করেন , তা পর্যটকদের সবচাইতে পছন্দনীয় স্মারক দ্রব্যে পরিনত হয়েছে । এটা যেমন মিয়াও জাতির লোকদের জন্য আয় বয়ে এনেছে , তেমনি মিয়াও জাতির সংস্কৃতি বিশ্বকে জানতে সহায়তা করেছে ।
|