v চীন আন্তর্জাতিক বেতারv বাংলা বিভাগv চীনের বিশ্ব কোষ
China Radio International
চীনা সংবাদ
বিশ্ব সংবাদ
চীনের কণ্ঠ
সংবাদ ব্যক্তিত্ব
সংবাদের প্রেক্ষাপট
নানা দেশ
কুইজ
আবহাওয়া

মহা মিলন ২০০৮ পেইচিং অলিম্পিক গেমস

ভয়াবহ ভূমিকম্প দক্ষিণ-পশ্চিম চীনে আঘাত হেনেছে

লাসায় ১৪ মার্চ যা ঘটেছিল

ইয়ুন নান প্রদেশ

দক্ষিণ এশিয়া

তৃতীয় নয়ন
আরো>>
(GMT+08:00) 2005-06-06 20:17:14    
রবীন্দ্র-সাহিত্যের উপরে চীনের প্রথম গবরষনা গ্রন্থ

cri
    চীনে রবীন্দ্র-রচনার অনুবাদ শুরু হয় গত শতাব্দীর বিশের দশকে। চীনের প্রথম রবীন্দ্র-রচনার অনুবাদক ছিলেন চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির প্রথম সাধারন সম্পাপক ছেন তু সিও ,তিনি গীতাঞ্জালির চারটা কবিতা অনুবাদ করেছিলেন।এরপর গীতাঞ্জালি, ক্রিসেন্ট মুন , স্ট্রড বার্ড, ,গার্ডানার প্রভৃটি আটটি কাব্য গ্রন্থ ইংরেজী থেকে চীনা ভাষায় অনুদিত হয়। চীনের বিদেশী সাহিত্য গবেষকরা প্রধানতঃ অনুবাদ-কর্ম পড়ে রবীন্দ্র-সাহিত্য গবেষনা করেন, যেহেতু রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ রচনা ইংরেজীতে অনুদিত হয় নি ,সেহেতু চীনা অনুবাদ কর্ম নিয়ে যে গবেষনা করা হয় তা নিঃসন্দেহে অসম্পুর্ণ । আনন্দের ব্যাপার এই যে , দু হাজার এক সালে চীনের হোপেই শিক্ষা প্রকাশনালয় থেকে হিন্দী ও বাংলা থেকে অনুদিত ২৪ খন্ড বিশিষ্ট রবীন্দ্র-রচনাবলীর চীনা সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত রবীন্দ্র-কাব্য সবই বাংলা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে । ফলে চীনে সাবিকভাবে রবীন্দ্র- সাহিত্য গবেষনার পথ সুগম হয়েছে।

    রবীন্দ্র-রচনাবলীর চীনা সংস্করণকে ভিত্তি করে চীনের পন্ডিতদের লেখা প্রথম গবেষনা গ্রন্থ গত বছরের সেপ্টেম্বার মাসে চীনের খুন লুন প্রকবশনালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে । রবীন্দ্র- সাহিত্য গবেষনা নামে ৫৩৪ পৃষ্ঠার এই গবেষনা গ্রন্থের চীনা শব্দসংখ্যা চার লক্ষ সাতাশ হাজার । গবেষনা গ্রন্থটির আটটি অধ্যায় হলো: রবীন্দ্র-রচনাবলীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, রবীন্দ্রনাথ ও চীন , রবীন্দ্র-কাব্য সৃষ্টি, রবীন্দ্র-কাব্যের সাংস্কৃতিক উপাদান ,রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্প,  রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথের নাটক এবং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সমালোচা ।

    সম্প্রতি থিয়ানজিন প্রশিক্ষণ কলেজে চীনের ভারতীয় সাহিত্য গবেষনা সমিতির বার্ষিক অধিবেশন ও ভারতীয় সাহিত্য বিযয়ক সেমিনার চলার সময়ে সি আর আইয়ের বাংলা বিভাগের কর্মী পাই খাই ইউয়ান এই গবেষনা গ্রন্থের চারজন লেখকের সাক্ষাতকার নিয়েছেন । রবীন্দ্রনাথ ও চীন এবং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সমালোচা, এই দুটো অধ্যায় লিখেছেন পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ওয়ে লি মিং।

    শিক্ষিকা ওয়ে লি মিং বলেছেন , রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয় লেখক , ইস্কুলে পড়াশোনা করার সময়ে আমি গীতাঞ্জালি পড়েছিলাম এবং তাঁর কবিতায় চিত্রিত সৌন্দর্যের আদর্শলোকে মুগ্ধ হয়েছিলাম । পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা বিভাগে অধ্যয়নের সময়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত যত বই পাওয়া যায় তা সব্ই পড়েছি ।এই গবেষনা গ্রন্থে আমি অপেক্ষাকৃত বিস্তারিতভাবে চীনের সংস্কৃতির সংগে রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধ,চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধী,অনুরাগ ও মুল্যায়ন বিবৃত করেছি।১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনথের চীন সফরের সময়ে তাঁকে নিয়ে যে ভুল বোঝাবুঝি উদ্ভুত হয়েছিল আমার বিচার বিশ্লেষন তা দুর করতে পারবে বলে আমি আশা করি।

    শিক্ষিকা ওয়ে লি মিং বলেছেন, সাহিত্য সৃষ্টি ও সাহিত্য সমালোচনায় বিধৃত রয়েছে তাঁর তীব্র সৌন্দর্যপিপাসা ,চীনে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সমালোচনার নিবন্ধের উপরে তেমন নজর দেয়া হয় নি। আমি মনে করি , সাহিত্য সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভংগী সম্পর্কে জানা থাকলে ললিতকলার দিক থেকে তাঁর রচনাবলির শিল্পরস আস্বাদন করা সহজ হবে , এবং তাঁর সুস্দর আদর্শ কীভাবে তাঁর রচনাবলিতে ফুটেছে তাও সহজে বোঝা যাবে।

    এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত রবীন্দ্রনাথের নাটকের উপরে নিবন্ধ লিখেছেন পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দী ভাষা সেক্সনের পরিচালক ও দক্ষিণ এশিয়া গবেষনাগরের উপপ্রধান ডক্টর চিয়াং জিন খুই।

    ডক্টর চিয়াং জিন খুই বলেছেন , বহু বছর আগেই চীনে রবীন্দ্রনাথের নাটক অনুবাদ করা হয়েছে , তবে তা অসম্পুর্ণ ,চীনে কেউ কেউ বলেন , রবীন্দ্রনাথ মাত্র ৩০টি নাটক লিখেছেন , কেউ কেউ বলেন ৪০টি কিন্তু আসলে তিনি ৬০টিও বেশী নাটক লিখেছেন । আমরা সামগ্রিকভাবে বিষয়বন্তু ও রচনাশৈলীর দিক থেকে তাঁর নাটক মুল্যায়নের চেষ্টা করেছি ।

    ডক্টর চিয়াং জিন খুই স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোন থেকে রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন, এগুলো হলো এক, বাস্তব নাটক, যেমন, রক্তকবরী ও মুক্তধারা,দুই, উপকথা আশ্রিত নাটক ,যেমন বাল্মীকির প্রতিভা ও মায়ার খেলা, তিন ,ইতিহাস আশ্রিক নাটক ,যেমন, রাজা ও রানী এবং প্রায়শ্চিত।তিনিএই তিন দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের নাটকের বিশ্লেষন করেছেন।

    রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্প ও উপন্যাসের উপরে নিবন্ধ লিখেছেন পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য বিভাগের প্রফেশার থাং রেন হু ।

    প্রফেশার থাং রেন হু বলেছেন, ভারতের সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্প ও উপন্যাস গুরুত্বপুর্ণ স্থান অধিকার করেছে।তাঁর ছোটো গল্প " ক্ষুধিত পাষান " বিশ্ব সাহিত্যাঙগের দুলর্ভ শ্রেষ্ঠ রচনা । তাঁর উপন্যাস "নৌকা ডুবী " বিশেষ উপভোগ্য ।

    প্রফেশার থাং রেন হু মনে করেন , নারীদের ভাগ্যের উপরে বিশেষভাবে মনোযোগ দেয়া রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের বৈশিষ্ট্য । ধনী পরিবারে কবির জন্ম হলেও তাঁর চিন্তাভাবনা প্রগতিশীল ,তিনি পুরুষের মত নারীদের সমান অধিকার ভোগের পক্ষপাতী ।তিনি ছোটো গল্পে নারীদের প্রতি গভীর সহানুভুতি জানিয়েছেন ।

    প্রফেশার থাং রেন হুর দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস "গোরা"কে রাসিয়ার টোর্সটাইয়ের প্রখ্যাত উপন্যাস " যুদ্ধ ও শান্তি "র সংগে তুলনা করা যায় । মহাকাব্যধর্মী এই উপন্যাসে প্রবল দেশপ্রেম ব্যক্ত করা হয়েছে এবং হিন্দু ধর্মের দুরাচারের সমালোচনা করা হয়েছে।

    প্রফেশার থাং রেন হু বলেছেন যে , একটি মজার ব্যাপার এই যে ,চীনে"গোরা" চেয়ে "নৌকা ডুবী "র পাঠক অনেক বেশী ,চীনের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়র চীনা ভাষা বিভাগে গোরার বদলে"নৌকা ডুবী " পড়ানো হয় । চীনা পাঠকদের কাছে "নৌকা ডুবী " যে অত্যধিক সমাদৃত হয় তার কারন ,এই রোমান্টিক উপন্যাসের ঘটনাপরম্পরা আকর্ষনীয়, "নৌকা ডুবী "তে কাব্যিক ভাষায় যে নায়কনায়িকার জটিল মনোজগত ও অনুভুতি অভিব্যক্ত করা হয়েছে । "নৌকা ডুবী "র আছে পাঠকদের মনকে সম্মোহিত করার অপুর্ব শৈল্পীক শক্তি ।

    এই গবেষনা গ্রন্থে রবীন্দ্র কাব্য নিয়ে আলোচনা করেছেন , সেন জেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়ো লং য়ো ।

    অধ্যাপক ইয়ো লং য়ো বলেছেন : রবীন্দ্র-সাহিত্য গবরষনা , চীনের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের নির্ধারিত একটি গুরুত্বপুর্ণ গবেষনা প্রকল্প। এই গবরষনা গ্রন্থের প্রধান সম্পাদক পেইং বিশ্ববিদ্যালয়র প্রফেশার থাং রেন হু ।তাঁর আমন্ত্রনে আমি রবীন্দ্র-কাব্যের মুল্যায়নের চেষ্টা করে রবীন্দ্র-কাব্য সম্পর্কে অনেক নতুন জ্ঞান পেয়েছি ।

    অধ্যাপক ইয়ো লং য়ে রবীন্দ্রনাথের ৫২টি বাংলা কাব্য গ্রন্থ বিষ্লেষন করেছেন এবং রাজনীতি, প্রকৃতি, জীবনদর্শন ও শিশু বিষয়ক কবিতা , প্রেমের কবিতা ও রহস্যময় কবিতার উপরে বুদ্ধিদীপ্ত মত প্রকাশ করেছেন ।

    সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি কবিগুরুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেছেন :রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিশ্রুত মহান কবি, সাহিত্যশাখাগুলোর মধ্যে তাঁর কাব্যকীর্তি সর্বাপেক্ষ উল্লেখযোগ্য । তাঁর লেখা কবিতার সংখ্যা ও গুণের দিক থেকে বিচার করলে বলা যায়া,তিনি পৃথিবীতে অতুলণলীয় ।তিনি যে এত বেশী কবিতা লিখতে পেরেছেন তার মূলে রয়েছে, তাঁর গভির দার্শনিক উপলব্ধী ও সুক্ষ্ম ললিতকলাভিতিক চিন্তাভাবনা ।তাঁর কাব্যসৃষ্টি চিন্তাধারার প্রশস্ততা ও প্রগাঢ়তায় হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময় ও রসমাধুর্যে পরিপূর্ণ ।

    অধ্যাপক ইয়ো লং য়োর বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ যে নবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন তাতে তাঁর কাব্য কীর্তি স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু অন্য দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় ,তিনি নবেল পুরস্কারকে পাশ্চাত্যের সংকীর্ন গন্ডী থেকে বের করে ধাপে ধাপে প্রাচ্য তথা সারা দুনিয়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি নবেল পুরস্কারের খ্যাতি বৃদ্ধির ব্যাপারে অনন্য অবদান রেখে গেছেন ।ভারত এমন কী প্রাচ্য ও পৃথিবীতে বোধহয় কয়েক শো বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মত একজনই মহান কবির জন্ম হতে পারে।

    বলা বাহুল্য , কয়েক শো বছরের মধ্যে আবির্ভুত এমন একজন মহান সাহিত্যিকের রচনাবলীর বিচার বিশ্লেষন যেমন কঠিন দায়িত্ব তেমন পরম সম্মানজনক ব্যাপার। বস্তুতঃ দায়িত্ববোধ ও সম্মানবোধই চীনের এই চারজন পন্ডীতকে অফুরন্ত শক্তি যুগিয়েছে। অবশেষে তাঁরা তাঁদের বিজ্ঞতা ও অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে একটি নতুন চিহ্নফলক বানিয়ে চীনের রবীন্দ্র-সাহিত্য গবেষনার পথে তা বসিয়ে দিলেন ।