(আছিমোগুয়া)
চীনের ইউন নান প্রদেশের লি সু জাতির একটি বিখ্যাত নৃত্যের নাম 'আছিমোগুয়া' । এ নৃত্যে ছাগলের ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয়েছে । এই ধরনের নৃত্যে প্রকৃতির উপকারের প্রতি লি সু জাতির কৃতজ্ঞতা আর জীবন যাপন ও প্রকৃতির প্রতি তাদের ভালবাসার অনুভুতি প্রকাশিত হয়েছে । তার বৈশিষ্ট্য হলো বাদ্য যন্ত্র ছাড়া আগাগোড়া নাচ করা । লি সু জাতির মতো ইউন নান প্রদেশে বসবাসকারী তিব্বতী জাতি , নাসি জাতি , পাই জাতি প্রভৃতি সংখ্যালঘুজাতিও নিপুনভাবে নাচ গান করতে পারেন । তারা নৃত্যের মাধ্যমে জীবনযাপনের প্রতি তাদের ভালবাসা প্রকাশ করেন ।
স্যুয়ান চি উ নামে এক ধরনের নৃত্য আছে। স্যুয়ান চি উ এমন এক ধরনের নৃত্য যে , স্যুয়ান চি নামে বাদ্য যন্ত্রের বাজনার তালে তালে নরনারীরা নাচ করেন । এই ধরনের বাদ্য যন্ত্র স্থানীয় লোকেরা আবিস্কার করেছেন । তা চীনের ঐতিহ্যিক আড় হু'র মতো এক ধরনের দো-তারা। নাচের সময়ে পুরুষদের কোমরে স্যুয়ান চি বাদ্যযন্ত্র বাঁধা থাকে। তাদের পরিচালনায় লোকেরা নাচ করেন । এই দৃশ্য প্রানবন্ত পরিবেশে পরিপূর্ণ ।
(স্যুয়ান চি উ)
স্থানীয় লোকেরা স্যুয়ান চি উ নাচের মাধ্যমে মনের ভাব ব্যক্ত করেন । কাজের অবসরকালে তারা যখন নাচতে চান , তখনই নাচতে পারেন । নাচের বেশীর ভাগ ভাবমূর্তি জীব-জন্তুকে নকল করা হয় । যেমন ময়ুরের পানি খাওয়া , খরগোসের দৌড়ানো ইত্যাদি , তা জীবনযাপনের নিবিড় পরিবেশে ভরপুর ।
(ইট পা নৃত্য)
ইউন নান প্রদেশের দি ছিং তিব্বতী জাতি স্বায়ত্ত শাসিত বিভাগের তে ছিং জেলা স্যুয়ান চি নৃত্য শিল্পকলার জন্মস্থল বলে আখ্যায়িত করা হয় । এই জেলায় বসবাসকারী তিব্বতী জাতি , নাসি জাতি, হুই জাতি প্রভৃতি বেশ কয়েকটি সংখ্যালঘুজাতি সময় সময় সমাবেশিত হয়ে স্যুয়ান চি উ নাচ করেন । স্থানীয় তিব্বতী জাতির লেখক আবুসিনান বলেছেন , স্যুয়ান চি নৃত্যে সাধারণতঃ তিন ক্ষেত্রের বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত। এক, অতিথিদের স্বাগত ও ধন্যবাদ জানানো আর প্রশংসার নৃত্য; দুই, প্রবীণদের শ্রদ্ধা নিবেদন করা আর জন্মস্থলের প্রতি ভালবাসা জ্ঞাপনভিত্তিক প্রশংসামূলক নাচ গান এবং তিন, তরুণ-তরুণীদের প্রেমভিত্তিক নৃত্য সংগীত ।
(ইট পা নৃত্য)
স্যুয়ান চি নৃত্যের জনপ্রিয়তা ও আন্তরিকতার চেয়ে ইট্ পা নৃত্যে পবিত্রতা আর ভদ্রতা দেখানো বহু জাতির সংস্কৃতির ভিত্তিতে সৃষ্ট স্যুয়ান চি নৃত্যের মধ্যে প্রাচীন সংগীত ছাড়া অন্য সবসংগীত তাত্ক্ষনিকভাবেরচিত হয় । জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও পরিবর্তনের চাহিদা মেটানোর জন্য স্থানীয় বিভিন্ন জাতির জনগণ নিরন্তর এই নৃত্যের বিকাশ ঘটিয়েছেন ।
(কৌ জুয়াং উ)
স্যুয়ান চি নৃত্যের জনপ্রিয়তা ও আন্তরিকতার চেয়ে ইট্ পা নৃত্যে পবিত্রতা আর ভদ্রতা দেখানো হয়। এই ধরনের নৃত্য প্রাচীন উপজাতির উপাসনা আনুষ্ঠান থেকে এসেছে । তার ইতিহাস প্রায় এক হাজার বছর পুরানো । পরিবেশনের সময় মেয়েদের মাথায় পদ্মফুল আকারের পাগড়ি জড়িয়ে আছে , কোমরে রংবেরংয়ের স্ক্যার্ট আর ব্রঞ্জ ঘন্টী বেঁধে রাখা, তাদের বাম হাতে সূর্য ও চাঁদ আকারের রংবেরংয়ের ঢোল আর ডান হাতে ঢোলের হাতুড়ি ধরা আছে । পুরুষরা লম্বা জামা পরে , গায়ে হাদা নামে এক ধরনের শুভেচ্ছামূলক সাদা বা হলুদ রঙের রেশমী ওড়না জড়িয়ে আছে , পায়ে বুটজুতা , হাতে ধূলি ঝাড়ার জন্য ব্যবহার্য গাইয়ের লেজ দিয়ে বানান বুরুশ । তারা প্রাচীন ও চড়া স্বরে সংগীতের তালে তালে নাচ করেন । ঢোল ও ঘন্টির আওয়াজ বেজে উঠে , দূর থেকেও তা শোনা যায় । ইট্ পা নৃত্য প্রধানতঃ দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইউন নান প্রদেশ , সিছুয়াং প্রদেশ , তিব্বত স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল প্রভৃতি তিব্বতী জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে প্রচলিত। বিশেষ করে ইউন নান প্রদেশের উই সি অঞ্চলের লি সু জাতি স্বায়ত্ত শাসিত জেলার একটি জেলা শহর-থাছেং থানায় ইট্ পা নৃত্য সব চাইতে জনপ্রিয় । লি সু জাতির মাদাম ইয়েন ছুং লি বলেছেন , ভিন্ন ব্যবহার অনুসারে ইট্ পা নৃত্য ভিন্ন তিন প্রকারের নৃত্যে বিভক্ত । প্রথম ধরনের নৃত্য উপাসনা অনুষ্ঠান আর বাকী দুটো নৃত্য বানিজ্যিক পরিবেশনের জন্য ব্যবহৃত । থাছেং থানায় যে ইট্ পা নৃত্য প্রচলিত , তা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দেখানো হয় । এর উদ্দেশ্য প্রাচুর্যময় ফসল আর স্বস্তির প্রার্থনা । তিনি বলেছেন , থাছেংয়ের ইট্ পা নৃত্যে প্রাচীনকালের রেওয়াজ সংরক্ষিত আছে । তার সংগীতের সুর আর পরিবেশনের জন্য পরা পোষাক পরিবর্তিত হয় নি । তার উত্তরাধিকার সুত্রে গ্রহণ করার জন্য কোনো লিখিত ভাষা নেই , মৌখিকভাবে এই কাজ করা হয় । থাছেং থানায় তিব্বতী জাতি ছাড়া নাসি জাতি , পাই জাতি , লি সু জাতি প্রভৃতি বেশ কয়েকটি সংখ্যালঘুজাতি থাকেন । তিনি বলেছেন , এখানে বাড়িতে বাড়িতে বিশেষ ধরণের পোষাক আর সামগ্রী আছে। সবাই ইট পা নৃত্য করতে পছন্দ করেন । স্থানীয় অধিবাসীদের পক্ষে এটা যেমন এক ধরনের আমোদ প্রমোদ , তেমনি এক ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানও। তারা বিশ্বাস করেন , তাতে তারা বিপদ ও দুর্যোগের কবল থেকে রেহাই পান ।
(কৌ জুয়াং উ)
নৃত্যের মাধ্যমে প্রকৃতি ও দেবতার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন করা যায় , তা ছাড়া হাসি-খুশী , দুঃখ-দুর্দশা প্রভৃতি বিবিধ আবেগ ও অনুভূতিও ব্যক্ত করা যায়। সিছুয়ান প্রদেশের কতকগুলো অঞ্চলে বসবাসকারী তিব্বতী জাতি , ছিয়াং জাতি প্রভৃতি সংখ্যালঘুজাতি কৌ জুয়াং উ নৃত্যের মাধ্যমে তাদের আনন্দের অনুভুতি প্রকাশ করেন । কৌ জুয়াং মানে তিনটি পাথরের ওপরে বসানো একটি উনুন । তা দিয়ে রান্না বান্না করা হয় । এই অঞ্চলের শীত্কালের সময় বেশী , ভীষণ শীত্ পড়ে । ঘরের মাঝখানের দিকে উনুন , তার আশেপাশে বিছানা । খাওয়া শেষে যখন লোকেরা খুশি , তখন সবাই উনুনের আশেপাশে সমাবেশিত হয়ে নাচ করেন । মাদাম ইয়াং লি সিছুয়াং প্রাদেশিক নৃত্য সংগীত্ গবেষনাগারের প্রধান । তিনি বলেছেন , কৌ জুয়াং উ দুই ধরনের নৃত্যে বিভক্ত । একটি পশুপালন অঞ্চল আর আরেকটি কৃষি অঞ্চলে প্রচলিত । পশুপালন অঞ্চলের কৌ জুয়াং উ খুব উদার । কারণ এই অঞ্চলের লোকেরা অশ্বারোহী জাতি , তারা তৃণভুমির সংস্কৃতি দেখান । তাদের নৃত্য দেখে আপনি মনে করবেন , এখানে প্রকৃতির সঙ্গে মানব জাতির মিলন হয়েছে ।
|