গত দু বছরে চীনের রাজধানী পেইচিংয়ের নাগরিকরা আরো দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল প্রভৃতি দেশের পোশাক , অলংকার , হস্তশিল্পকর্ম পছন্দ করছেন । তাই পেইচিংয়ে এইসব দেশের পন্যসামগ্রীর বিক্রির দোকানপাটও বাড়ছে । এইসব ছোট ছোট দোকান রাজধানী পেইচিংয়ের পন্যবাজার আরো বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে ।
পেইচিংয়ের রাজপ্রাসাদের উত্তরপাশে সিসাহাই নামে একটি লেক আছে । তিব্বতী অধিবাসী লোসান ও তার বোনের দক্ষিণ এশিয়ার পন্যসামগ্রীর দোকান এই লেকের পিছনে অবস্থিত । এই দোকানের নাম ' থিয়েনথানচিচাও '। এর অর্থ হলো স্বর্গে তৈরী পন্য। এই দোকান পেইচিং শহরের একটি বিখ্যাত দোকান ।
একদিন আমাদের সংবাদদাতা সিসাহাই লেকে বেড়াতে গিয়েছিলেন । সেখানে ঘুরে বেড়ানোর সময় তার নজরে পড়ে এই বৈশিষ্ট্যময় দোকানটি । দোকানে কাঠের তৈরী জানালার উপর গাঢ লাল ও সবুজ রংয়ের শাড়ী টাঙানো। দরজার উপর সাদা রংয়ের পর্দা , পর্দার উপর রঙকেরঙের হাতি, ময়ূর প্রভৃতি প্রাণীর ছবি সেলাই করা । দোকানে প্রবেশ করে আমাদের সংবাদদাতা দেখেছেন , ঘরের চার পাশে নানান ধরনের শাড়ী , দেওয়াল চাদর টাঙানো রয়েছে । টেবিলের উপর মনোরম সব সুচিকর্মেররুমাল , চামড়ার বেগ , কাপড়ের বেগ আর সিল্কের স্কার্ট ও পোশাক-আশাক । সবুজ রংয়ের ময়ূরের পালকের পাশে সারি সারি দৃষ্টিকাড়া রুপার অলংকার । ঘরে তিব্বতী সুর ও ধুপের সুগন্ধ ক্রেতাদের এক অদ্ভুত পরিবেশে নিয়ে যায় ।
এই দোকানের মালিক লোসান একজন খোলামনের মানুষ । আমাদের সংবাদদাতার মাধ্যমে তিনি তিব্বতী ভাষায় সি আর আইয়ের শ্রোতাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন , প্রিয় শ্রোতা বন্ধুরা , আমি লোসান , আমরা তুষারাবৃত তিব্বত থেকে এসেছি । আমার এই দোকান অনেকটা যেন তিব্বত ও দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকর্মের একটি প্রদর্শনী কক্ষ । আমি শ্রোতাবন্ধুর সুখশান্তি কামনা করি ।
তিব্বতের খানপা অঞ্চলে লোসানের জন্ম । তার বাবা তিব্বতে রুপার অলংকারের ব্যবসা করেন । সাত বছর আগে লোসান পেইচিংয়ে এসে এই দোকান খুলে তিব্বতী অলংকার বিক্রি করতে শুরু করেন । লোসান বলেছেন , তিব্বত মালভূমিতে অবস্থিত বলে তিব্বতীরা মনে করেন তিব্বত স্বর্গের সবচেয়ে কাছে অবস্থিত। তিব্বতীরা বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাস করেন , তারা মনে করেন তিব্বতের দৃষ্টিনন্দন রুপার অলংকার যেন স্বর্গীয় সামগ্রী । তাই লোসান তার দোকানের নাম দিয়েছেন ' থিয়েনথানচিচাও ' , এর মানে হলো এই দোকানের অলংকার স্বর্গে তৈরী । লোসান পেইচিংয়ে আরেকটি দোকান খুলেছেন । সে দোকানে ভারত ও নেপালের অলংকার ও শিল্পকর্ম বিক্রি করা হয় । লোসান খুব ভালো করে হান জাতির ভাষা বলতে পারেন । তিনি আমাদের সংবাদদাতার কাছে বিস্তারিতভাবে তার দোকানের মালপত্র আর স্থানীয় অধিবাসীর সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাস বর্ণনা করেছেন । তিনি বলেছেন , ছয় বছর আগে যখন ভারত ও নেপালের অলংকার ও শিল্পকর্ম পেইচিংয়ে নিয়ে আসেন , তখন কেউ এইসব পন্য পছন্দ করতো না , কিন্তু এখন এই অবস্থার বিরাট পরিবর্তন হয়েছে । তিনি বলেছেন , এখন ক্রমেই অধিক লোক নেপাল ও ভারতে যেতে শুরু করেছে । তারা এইসব দেশের সংস্কৃতি ও শিল্পকর্ম পছন্দ করেন । চীনের পর্যটকরা মনে করেন , ভারত ও নেপাল বৌদ্ধধর্মের দেশ , সেইসব দেশে গিয়ে মনে শান্তি পাওযা যায় । এইসব দেশের অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত বলে পন্যদ্রব্য পাইকারী ভাবে উত্পাদিত হয় না । সেখানকার অনেক শিল্পকর্ম ও পোশাক হাতে তৈরী বলে সম্পূর্ণ একই শিল্পকর্ম ও পোশাক একাধিক নেই । পর্যটকরা এই ধরনের পোশাক ও শিল্পকর্ম বেশি পছন্দ করেন , এতে নিজের আলাদা বৈশিষ্ট্য দেখানো যায় ।
আমাদের সংবাদদাতা লোসানের দোকানে একজন ক্রেতা মিস উয়ে সিয়াও লিনের সাক্ষাতকার নিয়েছেন । মিস উয়েই বলেছেন , দক্ষিণ এশিয়ার পোশাক পরে আমি নিজেকে আরো আধুনিক মনে করি । তিনি বলেছেন , আমি মনে করি দক্ষিণ এশিয়ার পোশাক আমার চাহিদা মেটাতে পারে , হাতে তৈরী বলে পোশাকের গুনমান ভালো । এইসব পোশাকের রং সুন্দর , আমি পছন্দ করি কালো , নীল , লাল ও হলুদ । এইসব রং পোশাক আছে , তাই আমি দক্ষিণ এশিয়ার পোশাক পছন্দ করি ।
লোসানের দোকান থেকে বেরিয়ে আমাদের সংবাদদাতা পেইচিংয়ের কেন্দ্রস্থলের সিতানে গিয়েছেন । সেখানে নেপালের অলংকারের একটি ছোট দোকান আছে । এই দোকান ছোট হলেও সাজানো অলংকার অনেক বেশী । এই দোকানের সব শিল্পকর্ম দোকানের মালিক সিয়াও থাও নেপাল গিয়ে নিয়ে এসেছেন । সিয়াও থাও একজন চাকুরীজীবী ছিলেন। একবার তিনি তিব্বতে বেড়াতে যান , সেখানে তিনি নেপালের অলংকার দেখে পছন্দ করেন । পেইচিংয়ে ফিরে তিনি চাকরী ছেড়ে দিয়ে নিজের ওয়েবসাইটের নাম দিয়ে এই ছোট দোকান খুলেছেন। তিনি বলেছেন , নেপালের অলংকারগুলো খুবই সুন্দর । আমি টাকা পয়সার জন্য এই দোকান খুলি নি , আমি নেপালের সুন্দর সুন্দর জিনিস চীনাদের দেখাতে চাই । আমি বিশ্বাস করি তারাও পছন্দ করেছেন , কারণ আমার অনেক ক্রেতা আমার বন্ধু হয়েছেন ।
পেইচিংয়ের আরেকটি দোকানের নাম ' স্বর্গীয় চোখ' । দোকানের মালিক মাদাম সুই মান লি সুন্দর ইংরেজী বলতে পারেন , তার গলায়ও ভারতের অলংকার । তিনি বলেছেন , তার দোকানে নেপাল , ভারত, পাকিস্তানের পোশাক বিক্রি হয় । সাংহাই ও সেনচেনে এই দোকানের শাখা আছে । তবে প্রতিটি দোকানের বৈশিষ্ট্য আলাদা । পেইচিংয়ের এই দোকানে প্রধানতঃ ভারতের পোশাক, পাকিস্তান ও নেপালের পিতলের জিনিস বিক্রি হয় । তা ছাড়া রাজধানী পেইচিংয়ে ' মেনচিয়ালান ' নামে একটি দর্জির দোকান আছে । সেখানে ভারত ও পাকিস্তানের পোশাক তৈরী হয় , কাপড়গুলো ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও মালয়েশিয়া থেকে আনা হয় ।
পেইচিংয়ের দক্ষিণ এশিয়ার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দোকানগুলো যেমন তরুণ-তরুণীদের চাহিদা মেটাচ্ছে , তেমনি চীন ও সেই সব দেশের মধ্যে রুচির সংযোগ সেতু স্থাপন হচ্ছে ।
|