কিছু দিন আগে চীনে পীলু পাথর ভাস্কর্যের মহা শিল্পী বিষয়ক একটি দেশব্যাপী নির্বাচন তত্পরতায় হুই জাতির শিল্পী মা স্যু উ এক শো পঞ্চাশাধিক প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্য থেকে চীনের পীলু পাথর ভাস্কর্য মহা শিল্পীর মর্যাদা জয় করেছেন । এবারকার নির্বাচন তত্পরতায় মা স্যু উ সহ শুধু ২১জন লোক এই মর্যাদা পেয়েছেন । সিনচিয়াংয়ে মাত্র মা স্যু উ এই মর্যাদা জয়ী হয়েছেন ।
সিনচিয়াংয়ের রাজধানী উরুমুচিতে অবস্থিত একটি পীলু পাথর ভাস্কর্যদ্রব্য কর্মশালায় সংবাদদাতা মা স্যু উকে দেখেছেন । তখন তিনি একাগ্রচিত্তে শিষ্যদের পীলু পাথর ভাস্কর্যকর্মের নৈপুন্য শেখাচ্ছিলেন। মা স্যু উ দেখতে শান্ত আর নমনীয় । তার চোখের দৃষ্টি থেকে পীলু পাথর ভাস্কর্যকর্মের প্রতি তার অসীম ভালবাসা দেখা যায় । পেশা আর চাকরি তার গায়ে সবচাইতে স্পষ্ট চিহ্ন দিয়েছে যে , দীর্ঘকাল ধরে পানি আর এম্যারির পালিশে তার হাত দুটো কর্কশ হয়েছে ।
চীনাদের মনে পীলু পাথর ভদ্রতা আর বিশুদ্ধতার প্রতীক । তা মানুষের সুচরিত্রের পরিচায়ক । এই প্রসংগে মা স্যু উ অনুভূতির সংগে বলেছেন , পীলু পাথর মানুষের চরিত্রের সংগে নিবিড়ভাবে জড়িত। পীলু পাথরে ভাস্কর্যকর্ম করার জন্য সুচরিত্র না থাকলে চলে না । চরিত্র ভাল না হলে এই কাজ করা অসম্ভব। আমি সব সময় শিষ্যদের এই পরামর্শ দিই যে , মানুষের চরিত্রবান হওয়া উচিত , লোভী হওয়া উচিত নয় ।
মা স্যু উর বয়স ৪৮ । ছোট বেলায় তিনি মাটি দিয়ে বিড়াল আর কুকুরের মূর্তি বানাতেন অথবা লোহার তার খেলনা পিস্তল তৈরী করতেন । সহপাঠীদের মধ্যে তিনি সবচাইতে দক্ষ। তিনি চিত্রাংকন করতে পছন্দ করেন , তার চিত্র খুবই স্ফুর্তিপূর্ণ । ছেলের এই সখ আবিস্কার করে তার বাবা তাকে পীলু পাথর ভাস্কর্য শিখতে পাঠিয়েছেন । মা স্যু উ সৌভাগ্যসক্রমে প্রসিদ্ধ পীলু পাথর ভাস্কর্য মহা শিল্পী হান চি লিয়াংয়ের কাছে এই শিল্প শিখেছেন । হান চি লিয়াংয়ের দাদা পেইচিংয়ে রাজপুরীতে যসম ভাস্কর্যকর্ম করেন । তিনি রাজবংশপন্থী পীলু পাথর ভাস্কর্য শিল্পীর মর্যাদা পেয়েছেন ।
বিংশ শতাব্দির আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে মা স্যু উ একটি পীলু পাথর ভাস্কর্য দ্রব্যের তৈরী কারখানা স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন । তিনি দুই শিষ্যকেও শিখান ।
তার ব্যবসা কোনো রকম চলতো । পরে পেইচিংয়ের একজন পর্যটকের কথা শুনে তিনি পেইচিংয়ে পীলু পাথর ভাস্কর্য কারখানা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন ।
সিনচিয়াংয়ের কারখানাটি বন্ধ হয়েছে । মা স্যু উ পেইচিং আর শাংহাইয়ে একটি করে' কারখানা গড়ে তুলেছেন। এই দুই কারখানা পীলু পাথর ভাস্কর্যের নৈপুন্যের দিক থেকে দেশের প্রথম সারিতে অন্তর্ভুক্ত । দু'বছরে তিনি বহু নৈপুন্য শিখে নিয়েছেন ।
পেইচিং আর শাংহাইয়ে শিল্পের অধ্যয়ন আর অনুশীলনের মাধ্যমে মা স্যু উ'র পীলু পাথর ভাস্কর্যের নৈপুন্য অনেক উন্নত হয়েছে । তার ভাস্কর্যকর্ম দ্রুত , গুণগত মান উত্কৃষ্ট এবং নক্সাও বৈচিত্র্যময় ।
এক বার মা স্যু উ একটি পীলু পাথর পেয়েছেন। তার আকার অধ-গোলাকার চাঁদের মতো , উপরে একটু ভাঙ্গা ছিল । তা দিয়ে ডিজাইন আর ভাস্কর্য করা খুব কঠিন । ভিন্ন পীলু পাথরের আকার ভিন্ন । সুতরাং ভিন্ন পীলু পাথর দিয়ে ভাস্কর্যের নক্সাও ভিন্ন । পীলু পাথরটি দিয়ে যে কি ধরনের ভাস্কর্য বানান হবে , মা স্যু উ তা বাসায় নিয়ে বেশী ক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করেছেন ।
একদিন এই পীলু পাথর অনুসারে ভাস্কর্যের একটি ডিজাইন তার মনে আসল । তিনি পাথরটির আকারের ভিত্তিতে লাউয়ের মতো একট মদ রাখার কেটলি তৈরী করার সিদ্ধান্ত নেন । ফলে এই ভাস্কর্যকর্মে যেমন একটুও কাঁচামাল অপচয় হয় নি , তেমনি শিল্পের দিক থেকে তা খুবই উত্কৃষ্ট । ক্রেতা তা কেনার জন্য ১ লক্ষ ২০ হাজার ইউয়ান খরচ করেছেন , কিন্তু তা বিক্রি করার সময়ে তিনি ২ লক্ষ ৩০ হাজার ইউয়ান পেয়েছেন ।
মা স্যু উ যেমন পীলু পাথরের ভাস্কর্যের ডিজাইন , তেমনি প্রক্রিয়াকরণের দিক থেকে বিশেষজ্ঞদের প্রশংসা পেয়েছেন । পীলু পাথর বাছাই করার ব্যাপারেও তিনি অভিজ্ঞ । এই বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হান ছান ছিং বলেছেন , উত্কৃষ্ট ভাস্কর্যকর্ম বানাননোর জন্য তিনি সযত্নে কাঁচামাল বাছাই করেন । তিনি ভাস্কর্য দ্রব্য তৈরীর জন্য উপযোগী কাঁচামাল ব্যবহার করেন । তার হাতে পীলু পাথরের কখনো কখনো অপচয় হয় নি এবং কোনো অমূল্য পীলু পাথর তার সামনে হারাবে না ।
সিনচিয়াংযের হো থিয়েন অঞ্চল তার অসাধারণ ভৌগোলিক কাঠামোর দরুণ পীলু পাথরে সমৃদ্ধ । ওখানকার পাথরের রং বৈচিত্র্যময় আর তার উত্কৃষ্টতা খুবই ভাল । একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে , আন্তর্জাতিক বাজারে হো থিয়েনের পীলু পাথরের বার্ষিক লেনদেনের মূল্য ১ বিলিয়ন ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে । ব্যবসার এই ভবিষ্যত-সম্ভাবনা দেখে ১৯৯৭ সালে তিনি সিনচিয়াংয়ে একটি সংখ্যালঘুজাতির পীলু পাথর ভাস্কর্য দ্রব্য উন্নয়ন কোম্পানি গঠন করেছেন । তিনি কোম্পানির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন । এই কোম্পানি কাঁচামাল সংগ্রহ , প্রক্রিয়াকরণ আর বিক্রির দিক থেকে সার্বিকভাবে কাজ চালায় । এখন তার ফলপ্রসূতা খুব ভাল হয়েছে । মা স্যু উ যেমন পীলু পাথরের একজন মহা ভাস্কর্য শিল্পী , তেমনি প্রায় ১০ কোটি ইউয়ান পুঁজিসম্পন্ন একজন শিল্পপতিতে পরিনত হয়েছেন ।
দীর্ঘকাল ধরে চীনে পীলু পাথরের ভাস্কর্যকর্ম দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চল ভিন্ন দুই ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে । উত্তর চীনের বৈশিষ্ট্যঃ ভাস্কর্যকর্ম কড়াকড়ি ও ঐতিহ্যিক আর দক্ষিণ চীনের বৈশিষ্ট্যঃ ভাস্কর্যকর্মের নৈপুন্য সূক্ষ্ম ও নমনীয় । বহু বছর ধরে অনুশীলনে সংখ্যালঘুজাতি আর অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে পীলু পাথরের নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভাস্কর্যকর্ম বানানের পরিকল্পনা প্রনয়ন করেছেন । ২০০৩ সালে মা স্যু উ সিনচিয়াং পাই ইউ শহরের হো থিয়েন সংস্কৃতি ও শিল্পকলা গবেষনাগার গড়ে তুলেছেন । উইগুর জাতির যুবক আস্কার ইয়াসিন তার একজন শিষ্য । তিনি বলেছেন , হো থিয়েনে বেশি পীলু পাথর পাওয়া যায় । কিন্তু উইগুর জাতির মধ্যে পীলু পাথর ভাস্কর্য শিল্পী কম । আমি মাস্টার মার কাছ থেকে ভালভাবে এই শিল্পের নৈপুন্য শিখবো । যাতে এই শিল্প আরো সম্প্রসারিত করা যায় ।
|