চীনে এমন একটি ভ্রাম্যমান ছায়াছবি প্রদর্শক দল আছে , গত আট বছরে এই দল ৬০ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্র করে মোট দু' শটিরও বেশী গ্রামে বিনা পয়সায় ছায়াছবি দেখিয়েছে , তাদের একটি শ্লোগান হলো যতদিন গ্রামবাসীরা চলচ্চিত্র দেখতে চান , ততদিন পর্যন্ত আমরা এই কাজ চালিয়ে যাবো । এই চলচ্চিত্র প্রদর্শক দলের আটজন সদস্য অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ।
এই চলচিত্র প্রদর্শক দলের প্রধান হচ্ছেন লিউ ছেন চেন , তিনি নিজের খরচে গ্রামবাসীদের ছায়াছবি প্রদর্শক দল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন ও প্রতিষ্ঠা করেন । লিউ ছেন চিন উত্তর- পূর্ব চীনের চিন চৌ শহরের নাগরিক , ১৯৯৪ সালে তিনি যখন সৈন্যবাহিনী থেকে অবসর নেন , তখন তিনি সরকারী সংস্থায় চাকরী পাওয়ার সুযোগ গ্রহন করেন নি , তিনি আট হাজার ইউয়ান অবসর ভাতা দিয়ে এক ছোট ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৯৬ সালের এক দিন লিউ ছেন চিন কাজের জন্য একটা গ্রামে গিয়েছেন , গ্রামে তিনি দেখেছেন , একটি গ্রামের প্রায় এক শটি পরিবারে মাত্র একটি সাদা-কালো টেলিভিসন সেট আছে , গ্রামবাসীরা বলেছেন তারা দশ-বারো বছর ছায়াছবি দেখেন নি । এই কথা শুনে লিউ ছেন চিনের মনে খুব কষ্ট হলো । তিনি তার সাতজন সহযোদ্ধাকে একত্র করে তাদের বলেছেন , আমি গ্রামবাসীদের ছায়াছবি দেখানোর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও সামগ্রি কিনে নেবো , আমরা এক সংগে একটি ছায়াছবি প্রদর্শক দল গঠন করে ঘুরে ঘুরে গ্রামবাসীদের জন্য চলচিত্র দেখাবো , কেমন ? তার সহযোদ্ধারা রাজী হলেন । তার সাতজন সহযোদ্ধা হচ্ছেন চান সিয়েন লুন , হান ইয়েন পিন , চু চুন ওয়েন , ফেন ইয়ু তে , ছেন ফোন চিউ, চাও ইয়ুন চি ও হান কো সি ।
লিউ ছেন চিন নিজের খরচে এক পুরানো সিনেমা প্রজেক্টোর, রুপালী পর্দা আর কিছু আনুসঙ্গিক সরঞ্জাম কিনে নিলেন এবং ছায়াছবি ও গাড়ী ভাড়া করলেন , তিনি তার সহযোদ্ধাদের সংগে ঘুরে ঘুরে গ্রামবাসীদের চলচিত্র প্রদর্শন করতে শুরু করেন । গ্রামবাসীদের প্রথম ছবি দেখানোর কথা তারা কখনো ভুলবেন না । সে দিন তারা চার ঘন্টা গাড়ী চালিয়ে একটি ছোট গ্রামে পৌছলেন, তারা গ্রামবাসীদের বিনা পয়সায় ছায়াছবি দেখানোর কথা বলেছেন , কিন্তু গ্রামবাসীরা কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারেন না যে বিনা পয়সায় তারা ছায়াছবি দেখতে পারেন । গ্রামবাসীরা মনে করেন এই আটজন লোক মিথ্যা কথা বলছে এবং ছবি দেখানোর অজুহাতে তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায় করবে ।
লিউ ছেন চিন ও তার সাতজন সহযোদ্ধা গ্রামবাসীদের বল্লেন , আমরা আটজনই সৈনিক ছিলাম , আমরা এখানে কথা দিচ্ছি যে আজ আমরা আপনাদের কাছ থেকে এক পয়সা নেবো না । ছবি দেখানোর পর গ্রামবাসীরা হাততালি দিয়ে লিউ ছেন চিন ও তার সহযোদ্ধাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন , তারা সিনেমা প্রজেক্টর ও অন্যান্য সরঞ্জাম গাড়িতে নিতে তুলে নিতে সাহায্য করেন । বিদায়ের সময় গ্রামবাসীরা আনন্দের সংগে তাদের কাছে আবার ছায়াছবি দেখার আশা প্রকাশ করেছেন ।
এই ছায়াছবি প্রদর্শকদলের আটজন সদস্যের নিজস্ব চাকরী ও পরিবার আছে । স্থানীয় অধিবাসিদের ছায়াছবি দেখানোর কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা তাদের প্রায় সব অবসর সময় এই কাজে ব্যবহার করেছেন । তাদের পরিবার পরিজন ও বন্ধুরা প্রথম দিকে তাদের এই ব্রতের তাত্পর্য উপলব্ধি করতে পারেন নি । লিউ ছেন চিন গাড়ী চালিয়ে গ্রামবাসীদের ছবি দেখানোর পর রাতে অনেক দেরীতে বাড়ী ফিরে যান , এ জন্য তার স্ত্রী সন্তুষ্ট নন এবং মাঝে মাঝে অভিযোগও করেন । সমাজের কিছু লোক তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখেন , তারা বলেছে যে লিউ ছেন চিন ও তার বন্ধুরা ছবি দেখানোর মাধ্যমে আত্মপ্রচারের চেষ্টা করছে । তাদের কোনো কোনো আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরাও অভিযোগ করে বলেছেন , লিউ ছেন চিনের হাতে বোধ হয় প্রচুর টাকা -পয়সা আছে , যদি তাই হয় , এই সব টাকা-পয়সা গরীব আত্মীয়কে উপহার দেয়াই ভালো । এই সব কথা শুনে তারা বড় চাপে পড়েন , তাদের মধ্যে কেউ কেউ পিছু হটতে চেয়েছেন । কিন্তু তারা গ্রামাঞ্চলে গ্রামবাসীদের অকৃত্রিম ধন্যবাদ ও আন্তরিকতা ভুলতে পারেন না , তাদের কথা স্মরণ করে লিউ ছেন চিন ও তার সহযোদ্ধাদের মনের সব দ্বিধা ও সংশয় দূর হয় । এই আটজন অবসর নেয়া সৈনিক এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে গ্রামবাসীদের ছায়াছবি দেখানো খুব বড় কাজ নয় , কিন্তু গ্রামবাসীরা আমাদের স্বাগত জানান , আমরা তাদের আকাংখা বিফল করতে পারি না ।
শীতকালের এক দিন , তাপমাত্রা মাইনাস ২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমেছে । ছায়াছবি প্রদর্শক দল তা ইউ পাও গ্রামে গিয়েছে । যাওয়ার সময় তারা মনে করেন , প্রচন্ডশীতে হয়ত খুব কম লোক চলচিত্র দেখতে আসবেন । কিন্ত গ্রামে পৌছে তারা দেখেছেন , গ্রামের প্রায় এক হাজার লোক কনকনে শীতের মধ্যে তাদের অপেক্ষা করছিলেন । কোনো কোনো বৃদ্ধার ভ্রু শীতে সাদা হয়েছে , গ্রামবাসীর আন্তরিকতা দেখে লিউ ছেন চিন ও তার সহযোদ্ধাদের চোখ সজল হয়েছে ।
উয়েন চিয়া কাও হচ্ছে চিন চৌ শহরের উপকন্ঠের একটি গরীব গ্রাম , এই গ্রামের এক পাহাড়ের উপরে প্রতিষ্ঠিতএকটি ভরসা প্রাথমিক স্কুলে মাত্র চারজন ছাত্রছাত্রী ও একজন শিক্ষক । এই প্রাথমিক স্কুলের পাঁচজন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক যাতে ছায়াছবি দেখতে পারে , লিউ ছেন চিন ও তার সহযোদ্ধারা বিশেষভাবে সেই গ্রামে গিয়েছেন এবং তাদের জন্য একটি জাতীয় পতাকা ও খাতা , পেন্সিল প্রভৃতি পড়াশুনায় ব্যবহার্য সামগ্রী নিয়েছে । ছায়াছবি শুরু হওয়ার আগে আটজন অবসর প্রাপ্ত সৈনিক আর পাঁচজন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক এক সংগে স্কুলের উঠানে পাঁচ তারকা খচিত লাল পতাকা উত্তোলন করেন , ছেলেমেয়েরা গম্ভীর মুখে হাত তুলে জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে । এই প্রাথমিক স্কুলের প্রধান ও শিক্ষক একজনই , তার নাম ওয়াং কুই উন । তিনি লিউ ছেন চিনের হাত ধরে আবেগের সংগে বলেছেন , আপনারা ছেলেমেয়ের জন্য আনন্দ এনেছেন, তারা প্রথমবার স্বহস্তে লাল পতাকা উত্তোলন করেছে এবং প্রথমবার ছায়াছবি উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছে । এই চারজন ছেলেমেয়েকে ছায়াছবি দেখানোর জন্য এই আটজন পুরনো সৈনিক মিনিবাস চালিয়ে কয়েক শ কিলিমিটার পথ অতিক্রম করেছে । একটি ছোট নদী পার হওয়ার সময় গাড়িটি পিছলে সেতুর থেকে বরফ জমা নদীতে পড়ে যায় , তারা খালি পায়ে নদীতে নেমে গাড়ী ঠেলেন । গাড়ী উপরে নেয়ার পর তারা শীতে কাপতে শুরু করেন , তাদের দুই পা প্রচন্ড শীতে অবশ হয়েছে । আটজনের মধ্যে হান কো সির শরীর সবচেয়ে দুর্বল , তার দুটি পায়ের উপর বরফের অনেকগুলো কাটা দাগ , সে দিন শহরের বাড়ীতে ফিরে যাওয়ার পর আটজনই অসুস্থ হয়েছেন , ৪১ বছর বয়স্ক হান কো সি বরফের নদীতে বেশীক্ষন থাকার দরুন হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন । আজ পর্যন্ত এই ভ্রাম্যমান ছায়াছবি প্রদর্শন দলের নামের তালিকায় হান কো সির নাম আছে , তাদের নিরলস প্রচেষ্টা তাদের পরিবার পরিজন ও বন্ধুবান্ধবদের মুগ্ধ করেছে । লিউ ছেন চিনের স্ত্রী আগে লিউ ছেন চিনের এই ব্যয়সাপেক্ষ ও ক্লান্তিকর ব্রতকে সমর্থন করতেন না এবং তার সংগে বেশ কয়েকবার ঝগড়াও করেছেন । কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি স্বামীর এই ব্রতের তাত্পর্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন , এখন তিনি তার স্বামীর বলিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছেন । গত আট বছরে লিউ ছেন চিন স্ত্রীর সমর্থন পেয়ে মোট তিন লক্ষ ইউয়ান গ্রামবাসীদের ছবি দেখানো কাজে ব্যয় করেছেন , তার স্ত্রী এর জন্য কোনো আপত্তি করেন নি ।
চু সিয়াও উয়েন হচ্ছেন এই দলের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ সদস্য । তিনি তার বাবাকে খুব যত্ন করেন , ছুটির দিন ও অবসর সময় গ্রামে গ্রামে ছবি দেখানোর দরুণ তিনি বাবার পাশে বেশীক্ষণ থাকতে পারেন না , এর জন্য তিনি মনে কষ্ট পেয়েছেন , কিন্তু তার বাবা তাকে সমর্থন করেন । তিনি বলেছেন , তুমি ভালো কাজ করছো , এটা ভালো কথা , আমার কথা চিন্তা করবে না । তার বাবার মৃত্যুর আগে চু চুন উয়েন পাশে ছিলেন না , তিনি উপকন্ঠের একটি গ্রামে ছায়াছবি দেখাছিলেন , তিনি বাবার সংগে শেষ দেখা সাক্ষাতের সুযোগ হারালেন ।
প্রথম দিকে এই আটজন অবসর প্রাপ্ত সৈনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তারা গ্রামবাসীদের এক শ বার চলচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা করবেন । কিন্তু এক শটি শো হওয়ার পর তারা এই নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে , যতদিন গ্রামবাসীরা আমাদের স্বাগত জানান , আমরা অব্যাহতভাবে তাদের সেবা করে যাবো । এখন পর্যন্ত তারা ইতিমধ্যে গ্রামবাসীদের জন্য বিনা পয়সায় ৪৩০বার ছায়াছবি দেখিয়েছেন ।
|