v চীন আন্তর্জাতিক বেতারv বাংলা বিভাগv চীনের বিশ্ব কোষ
China Radio International
চীনা সংবাদ
বিশ্ব সংবাদ
চীনের কণ্ঠ
সংবাদ ব্যক্তিত্ব
সংবাদের প্রেক্ষাপট
নানা দেশ
কুইজ
আবহাওয়া

মহা মিলন ২০০৮ পেইচিং অলিম্পিক গেমস

ভয়াবহ ভূমিকম্প দক্ষিণ-পশ্চিম চীনে আঘাত হেনেছে

লাসায় ১৪ মার্চ যা ঘটেছিল

ইয়ুন নান প্রদেশ

দক্ষিণ এশিয়া

তৃতীয় নয়ন
আরো>>
(GMT+08:00) 2005-05-20 21:33:19    
অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকের ভ্রাম্যমান চলচ্চিত্র প্রদর্শক দল

cri
    চীনে এমন একটি ভ্রাম্যমান ছায়াছবি প্রদর্শক দল আছে , গত আট বছরে এই দল ৬০ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্র করে মোট দু' শটিরও বেশী গ্রামে বিনা পয়সায় ছায়াছবি দেখিয়েছে , তাদের একটি শ্লোগান হলো যতদিন গ্রামবাসীরা চলচ্চিত্র দেখতে চান , ততদিন পর্যন্ত আমরা এই কাজ চালিয়ে যাবো । এই চলচ্চিত্র প্রদর্শক দলের আটজন সদস্য অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ।

    এই চলচিত্র প্রদর্শক দলের প্রধান হচ্ছেন লিউ ছেন চেন , তিনি নিজের খরচে গ্রামবাসীদের ছায়াছবি প্রদর্শক দল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন ও প্রতিষ্ঠা করেন । লিউ ছেন চিন উত্তর- পূর্ব চীনের চিন চৌ শহরের নাগরিক , ১৯৯৪ সালে তিনি যখন সৈন্যবাহিনী থেকে অবসর নেন , তখন তিনি সরকারী সংস্থায় চাকরী পাওয়ার সুযোগ গ্রহন করেন নি , তিনি আট হাজার ইউয়ান অবসর ভাতা দিয়ে এক ছোট ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৯৬ সালের এক দিন লিউ ছেন চিন কাজের জন্য একটা গ্রামে গিয়েছেন , গ্রামে তিনি দেখেছেন , একটি গ্রামের প্রায় এক শটি পরিবারে মাত্র একটি সাদা-কালো টেলিভিসন সেট আছে , গ্রামবাসীরা বলেছেন তারা দশ-বারো বছর ছায়াছবি দেখেন নি । এই কথা শুনে লিউ ছেন চিনের মনে খুব কষ্ট হলো । তিনি তার সাতজন সহযোদ্ধাকে একত্র করে তাদের বলেছেন , আমি গ্রামবাসীদের ছায়াছবি দেখানোর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও সামগ্রি কিনে নেবো , আমরা এক সংগে একটি ছায়াছবি প্রদর্শক দল গঠন করে ঘুরে ঘুরে গ্রামবাসীদের জন্য চলচিত্র দেখাবো , কেমন ? তার সহযোদ্ধারা রাজী হলেন । তার সাতজন সহযোদ্ধা হচ্ছেন চান সিয়েন লুন , হান ইয়েন পিন , চু চুন ওয়েন , ফেন ইয়ু তে , ছেন ফোন চিউ, চাও ইয়ুন চি ও হান কো সি ।

    লিউ ছেন চিন নিজের খরচে এক পুরানো সিনেমা প্রজেক্টোর, রুপালী পর্দা আর কিছু আনুসঙ্গিক সরঞ্জাম কিনে নিলেন এবং ছায়াছবি ও গাড়ী ভাড়া করলেন , তিনি তার সহযোদ্ধাদের সংগে ঘুরে ঘুরে গ্রামবাসীদের চলচিত্র প্রদর্শন করতে শুরু করেন । গ্রামবাসীদের প্রথম ছবি দেখানোর কথা তারা কখনো ভুলবেন না । সে দিন তারা চার ঘন্টা গাড়ী চালিয়ে একটি ছোট গ্রামে পৌছলেন, তারা গ্রামবাসীদের বিনা পয়সায় ছায়াছবি দেখানোর কথা বলেছেন , কিন্তু গ্রামবাসীরা কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারেন না যে বিনা পয়সায় তারা ছায়াছবি দেখতে পারেন । গ্রামবাসীরা মনে করেন এই আটজন লোক মিথ্যা কথা বলছে এবং ছবি দেখানোর অজুহাতে তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায় করবে ।

    লিউ ছেন চিন ও তার সাতজন সহযোদ্ধা গ্রামবাসীদের বল্লেন , আমরা আটজনই সৈনিক ছিলাম , আমরা এখানে কথা দিচ্ছি যে আজ আমরা আপনাদের কাছ থেকে এক পয়সা নেবো না । ছবি দেখানোর পর গ্রামবাসীরা হাততালি দিয়ে লিউ ছেন চিন ও তার সহযোদ্ধাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন , তারা সিনেমা প্রজেক্টর ও অন্যান্য সরঞ্জাম গাড়িতে নিতে তুলে নিতে সাহায্য করেন । বিদায়ের সময় গ্রামবাসীরা আনন্দের সংগে তাদের কাছে আবার ছায়াছবি দেখার আশা প্রকাশ করেছেন ।

    এই ছায়াছবি প্রদর্শকদলের আটজন সদস্যের নিজস্ব চাকরী ও পরিবার আছে । স্থানীয় অধিবাসিদের ছায়াছবি দেখানোর কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা তাদের প্রায় সব অবসর সময় এই কাজে ব্যবহার করেছেন । তাদের পরিবার পরিজন ও বন্ধুরা প্রথম দিকে তাদের এই ব্রতের তাত্পর্য উপলব্ধি করতে পারেন নি । লিউ ছেন চিন গাড়ী চালিয়ে গ্রামবাসীদের ছবি দেখানোর পর রাতে অনেক দেরীতে বাড়ী ফিরে যান , এ জন্য তার স্ত্রী সন্তুষ্ট নন এবং মাঝে মাঝে অভিযোগও করেন । সমাজের কিছু লোক তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখেন , তারা বলেছে যে লিউ ছেন চিন ও তার বন্ধুরা ছবি দেখানোর মাধ্যমে আত্মপ্রচারের চেষ্টা করছে । তাদের কোনো কোনো আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরাও অভিযোগ করে বলেছেন , লিউ ছেন চিনের হাতে বোধ হয় প্রচুর টাকা -পয়সা আছে , যদি তাই হয় , এই সব টাকা-পয়সা গরীব আত্মীয়কে উপহার দেয়াই ভালো । এই সব কথা শুনে তারা বড় চাপে পড়েন , তাদের মধ্যে কেউ কেউ পিছু হটতে চেয়েছেন । কিন্তু তারা গ্রামাঞ্চলে গ্রামবাসীদের অকৃত্রিম ধন্যবাদ ও আন্তরিকতা ভুলতে পারেন না , তাদের কথা স্মরণ করে লিউ ছেন চিন ও তার সহযোদ্ধাদের মনের সব দ্বিধা ও সংশয় দূর হয় । এই আটজন অবসর নেয়া সৈনিক এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে গ্রামবাসীদের ছায়াছবি দেখানো খুব বড় কাজ নয় , কিন্তু গ্রামবাসীরা আমাদের স্বাগত জানান , আমরা তাদের আকাংখা বিফল করতে পারি না ।

    শীতকালের এক দিন , তাপমাত্রা মাইনাস ২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমেছে । ছায়াছবি প্রদর্শক দল তা ইউ পাও গ্রামে গিয়েছে । যাওয়ার সময় তারা মনে করেন , প্রচন্ডশীতে হয়ত খুব কম লোক চলচিত্র দেখতে আসবেন । কিন্ত গ্রামে পৌছে তারা দেখেছেন , গ্রামের প্রায় এক হাজার লোক কনকনে শীতের মধ্যে তাদের অপেক্ষা করছিলেন । কোনো কোনো বৃদ্ধার ভ্রু শীতে সাদা হয়েছে , গ্রামবাসীর আন্তরিকতা দেখে লিউ ছেন চিন ও তার সহযোদ্ধাদের চোখ সজল হয়েছে ।

    উয়েন চিয়া কাও হচ্ছে চিন চৌ শহরের উপকন্ঠের একটি গরীব গ্রাম , এই গ্রামের এক পাহাড়ের উপরে প্রতিষ্ঠিতএকটি ভরসা প্রাথমিক স্কুলে মাত্র চারজন ছাত্রছাত্রী ও একজন শিক্ষক । এই প্রাথমিক স্কুলের পাঁচজন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক যাতে ছায়াছবি দেখতে পারে , লিউ ছেন চিন ও তার সহযোদ্ধারা বিশেষভাবে সেই গ্রামে গিয়েছেন এবং তাদের জন্য একটি জাতীয় পতাকা ও খাতা , পেন্সিল প্রভৃতি পড়াশুনায় ব্যবহার্য সামগ্রী নিয়েছে । ছায়াছবি শুরু হওয়ার আগে আটজন অবসর প্রাপ্ত সৈনিক আর পাঁচজন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক এক সংগে স্কুলের উঠানে পাঁচ তারকা খচিত লাল পতাকা উত্তোলন করেন , ছেলেমেয়েরা গম্ভীর মুখে হাত তুলে জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে । এই প্রাথমিক স্কুলের প্রধান ও শিক্ষক একজনই , তার নাম ওয়াং কুই উন । তিনি লিউ ছেন চিনের হাত ধরে আবেগের সংগে বলেছেন , আপনারা ছেলেমেয়ের জন্য আনন্দ এনেছেন, তারা প্রথমবার স্বহস্তে লাল পতাকা উত্তোলন করেছে এবং প্রথমবার ছায়াছবি উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছে । এই চারজন ছেলেমেয়েকে ছায়াছবি দেখানোর জন্য এই আটজন পুরনো সৈনিক মিনিবাস চালিয়ে কয়েক শ কিলিমিটার পথ অতিক্রম করেছে । একটি ছোট নদী পার হওয়ার সময় গাড়িটি পিছলে সেতুর থেকে বরফ জমা নদীতে পড়ে যায় , তারা খালি পায়ে নদীতে নেমে গাড়ী ঠেলেন । গাড়ী উপরে নেয়ার পর তারা শীতে কাপতে শুরু করেন , তাদের দুই পা প্রচন্ড শীতে অবশ হয়েছে । আটজনের মধ্যে হান কো সির শরীর সবচেয়ে দুর্বল , তার দুটি পায়ের উপর বরফের অনেকগুলো কাটা দাগ , সে দিন শহরের বাড়ীতে ফিরে যাওয়ার পর আটজনই অসুস্থ হয়েছেন , ৪১ বছর বয়স্ক হান কো সি বরফের নদীতে বেশীক্ষন থাকার দরুন হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন । আজ পর্যন্ত এই ভ্রাম্যমান ছায়াছবি প্রদর্শন দলের নামের তালিকায় হান কো সির নাম আছে , তাদের নিরলস প্রচেষ্টা তাদের পরিবার পরিজন ও বন্ধুবান্ধবদের মুগ্ধ করেছে । লিউ ছেন চিনের স্ত্রী আগে লিউ ছেন চিনের এই ব্যয়সাপেক্ষ ও ক্লান্তিকর ব্রতকে সমর্থন করতেন না এবং তার সংগে বেশ কয়েকবার ঝগড়াও করেছেন । কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি স্বামীর এই ব্রতের তাত্পর্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন , এখন তিনি তার স্বামীর বলিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছেন । গত আট বছরে লিউ ছেন চিন স্ত্রীর সমর্থন পেয়ে মোট তিন লক্ষ ইউয়ান গ্রামবাসীদের ছবি দেখানো কাজে ব্যয় করেছেন , তার স্ত্রী এর জন্য কোনো আপত্তি করেন নি ।

    চু সিয়াও উয়েন হচ্ছেন এই দলের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ সদস্য । তিনি তার বাবাকে খুব যত্ন করেন , ছুটির দিন ও অবসর সময় গ্রামে গ্রামে ছবি দেখানোর দরুণ তিনি বাবার পাশে বেশীক্ষণ থাকতে পারেন না , এর জন্য তিনি মনে কষ্ট পেয়েছেন , কিন্তু তার বাবা তাকে সমর্থন করেন । তিনি বলেছেন , তুমি ভালো কাজ করছো , এটা ভালো কথা , আমার কথা চিন্তা করবে না । তার বাবার মৃত্যুর আগে চু চুন উয়েন পাশে ছিলেন না , তিনি উপকন্ঠের একটি গ্রামে ছায়াছবি দেখাছিলেন , তিনি বাবার সংগে শেষ দেখা সাক্ষাতের সুযোগ হারালেন ।

    প্রথম দিকে এই আটজন অবসর প্রাপ্ত সৈনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তারা গ্রামবাসীদের এক শ বার চলচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা করবেন । কিন্তু এক শটি শো হওয়ার পর তারা এই নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে , যতদিন গ্রামবাসীরা আমাদের স্বাগত জানান , আমরা অব্যাহতভাবে তাদের সেবা করে যাবো । এখন পর্যন্ত তারা ইতিমধ্যে গ্রামবাসীদের জন্য বিনা পয়সায় ৪৩০বার ছায়াছবি দেখিয়েছেন ।