চীনের অনুবাদক মহলে ৪১ বছর বয়স্ক কং চিয়ে সির খ্যাতি আছে , তিনি হংকং ও ম্যাকাওয়ে চীনের সাবর্ভৌম অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা আর পেইচিং মহানগরের ওলিম্পিক গেম্স অনুষ্ঠানের আবেদন জানানোসহ বিভিন্ন বড় বড় ঐতিহাসিক ঘটনায় অনুবাদকের কাজ করেছেন এবং চীন সরকারের ১৭টি শ্বেতপত্রের অনুবাদ ও শুদ্ধ করেছেন ।
মধ্য চীনের হোনান প্রদেশের এক কৃষক পরিবারে কং চিয়ে শির জন্ম। ১৯৮১ সালে তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে রাজধানীর বিখ্যাত পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন , তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসী ভাষা শিখেছেন । কং চিয়ে সি বলেছেন , এক কৃষক পরিবারের ছেলে বিশ্ববিখ্যাত পেইচিং বিশ্বিবিদ্যালয় ভর্তি হওয়া এক সহজ ব্যাপার নয় , তাই গ্রামের সবাই তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন , পড়াশুনার এই সুবর্ণসুযোগ পেয়ে তিনি খুব খুশী । তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সংগে সংগেই কং চিয়ে শি শহরাঞ্চলের সহপাঠীদের সংগে নিজের ব্যবধান অনুভব করেছেন । শহরাঞ্চলের সহপাঠীদের তুলনায় নিজের জ্ঞানের পরিধি সীমিত , কথা বলার সময় নিজের আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণ শুনতে একটু অন্য রকম মনে হয় । তিনি বলেছেন , আমি গ্রামাঞ্চলের স্কুল থেকে এসেছি , গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোর শিক্ষার মান সাধারনতঃ উঁচু নয় , পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে সহপাঠীদের সংগে আলাপ করার সময় আমি কোনো মতেই নিজের হীনম্মন্যতা দূর করতে পারি না । যেমন সহপাঠীরা চীনের বিখ্যাত উপন্যাস 'লাল দালানের স্বপ্নের ' চরিত্রগুলো আলোচনা করেন অথবা প্রয়াত নেতা মাও সে তুঙয়ের মূল্যায়ন করেন , আমি যথেষ্ট বই পড়ি নি বলে এই ধরনের আলাপে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না । আমি নিজেকে বলি সহপাঠীদের সংগে স্বাভাবিকভাবে মেলামেশার জন্য অবশ্যই আরো বেশী বই পড়তে হবে । যদিও সহপাঠীদের সংগে ব্যবধান বেশী দিন স্থায়ী হয় নি , তবে কং চিয়ে শি এ থেকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে জ্ঞান ও পারস্পরিক আদান-প্রদান কত গুরুত্বপূর্ণ । তাই বেশী জ্ঞান আয়ত্ত করা আর নিজের শক্তি দেখানোর জন্য কং চিয়ে শি পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে একাগ্রচিত্তে পড়াশুনা করেছেন , অবসর সময় তিনি প্রচুর বই পড়েছেন , ১৯৮৫ সালে পড়াশুনা শেষ করে তিনি পেইচিংয়ের বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়ে ফরাসী ভাষার অনুবাদক হিসেবে যোগ দিয়েছেন । পরে তিনি আবার ফ্রান্সের মাসেইল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং এক বছরের মধ্যে ভাষা তত্ত্ব বিষয়ের মাস্টারস ডিগ্রী পেয়েছেন ।
গত বিশ বছরে কং চিয়ে শি চীনের নেতৃবৃন্দের রচনা ও সরকারী দলিল অনুবাদ করেছেন এবং চীনের ফরাসী ভাষা ছাত্রছাত্রীর জন্য পাঠ্যবই ও ক্যাসেট তৈরী করেছেন । কং চিয়ে শির অনুদিত বইগুলোর মধ্যে যেমন চীনা ভাষা থেকে ফরাসী ভাষায় অনুদিত চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির বই , তেমনি আছে ফরাসী ভাষা থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করা ফ্রান্সের বিখ্যাত বই ' কালো গুহা ' আর নতুন তিনতিন সিয়েচি ' । তিনি আট বছর সময় নিয়ে যে ফরাসি-চীনা আর চীনা-ফরাসি অভিধান তৈরী করেছেন , তা' ফরাসী বিশেষজ্ঞদের স্বীকৃতি পেয়েছে । অনুবাদের কাজ সম্বন্ধে কং চিয়ে শি বলেছেন , অনুবাদের কাজ সহজ নয় । প্রথমে আপনাকে এই প্রবন্ধের অর্থ জানতে হবে , তার পর অর্থ অনুসারে অনুবাদ করতে হবে , আক্ষরিক অনুবাদ বিদেশীরা বুঝবে না । অনুবাদের কাজ করার সময় আমি প্রায়ই দুটি দেশ ও দুদেশের সংস্কৃতি ও অভ্যাসের তফাত জনিত সমস্যার সম্মুখীন হই , যেমন চীনা ভাষার একটি শব্দ ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করার পর ফরাসীরা যদি বুঝতে পারেন না , তাহলে অবশ্যই এই শব্দ পরিবর্তন করতে হবে । তিনি বলেছেন , অনুবাদক ও দোভাষীরকাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ , ঠিক যেন মানুষ বায়ু ছাড়া বাঁচতে পারেন না , বাস্তব জীবনে দোভাষী বা অনুবাদক ছাড়া মানুষ আদান প্রদান করতে পারেন না । প্রতিটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও রীতিনীতি আছে , একজন যোগ্য অনুবাদক দুটি সংস্কৃতির সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন , অনুবাদকের সাহায্যে দুটি জাতির জনগন পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে পারস্পরিক সমঝোতা ও বন্ধুত্ব বাড়াতে পারেন । এই ধরনের কাজ তাত্পযময় । ঠিক এই কারনে কং চিয়ে শি ফরাসি ভাষা ছাড়া অবসর সময় ইংরাজী ভাষা , লাতিন ভাষা ও কোরিয় ভাষা শিখেছেন ।
এখন কং চিয়ে শি চীনের বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়ের ফরাসী বিভাগের প্রধান , অনুবাদ ছাড়া ফরাসী ভাষার বই অনুবাদ , সম্পাদনা ও প্রকাশের কথা বিবেচনা করাও তার দায়িত্ব । তা ছাড়া তিনি চীনের অনুবাদক কমিটির ফরাসী ভাষা শাখার মহাসচিব এবং জাতীয় অনুবাদক যাচাই কমিটির সদস্য । গত বছর চীন ও ফরাসী সরকারের যৌথ উদ্যোগে একে অপরের রাজধানীতে সাংস্কৃতিক বর্ষ পালিত হয়েছে । চীনে পালিত ফরাসী সংস্কৃতি বর্ষের অনেক কর্মসুচীর সাংগঠনিক কাজে কং চিয়ে শি অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেছেন , চীনে অনুষ্ঠিত ফরাসী সংস্কৃতি বর্ষের জন্য আমরা কিছু চীনা ভাষা ও ফরাসী ভাষার বইয়ের প্রস্তুতি নিয়েছি , এই সব বইয়ের মধ্যে আছে ফ্রান্সের সারারণ জ্ঞান সংক্রান্ত ' প্যারিসের সংগে মিলন ' , চীনের সংস্কৃতি ও রীতিনীতি সংক্রান্ত 'চীনা সংস্কৃতি ও মনোরম দৃশ্য ' নামক আট খন্ডের এক সেট বই আর 'চীনা সাহিত্য ' নামক পাঁচ খন্ডের এক সেট বই । এই সব বইতে চীনের বিখ্যাত সাহিত্যিক পা চিং , ওয়াং মোন আর সেন ছুন ওয়েনের রচনা ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে ।
কং চিয়ে শি বলেছেন , চীন ও ফ্রান্স যে একে অপরের রাজধানীতে সাংস্কৃতিক বর্ষ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে , তা দুটি দেশের জন্যেই হিতকর । দুদেশেরই সুগভীর ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি আছে , তবে দু দেশের জনগনের মধ্যে পারস্পরিক আদান প্রদান যথেষ্ট নয় , সাংস্কৃতিক বর্ষ পালনের মাধ্যমে দুদেশের জনগণের আদান প্রদান ও সহযোগিতা আরো জোরদার হয়েছে ।
|