আপনারা কি এমন একটি গল্প শুনেছেন? অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরা প্রেমে পড়লে মিষ্টি কথা বলার দরকার নেই। তারা শুধু গান গাওয়ার মাধ্যমেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন । দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইউন নান প্রদেশে থাকা ই জাতির লোকেরা গান গাওয়া আর নাচ করা এই ধরনের রোমাণ্টিক পদ্ধতিতে পরস্পরের কাছে প্রেম প্রকাশ করেন । মন খোলা আর উত্সাহব্যঞ্জক ই জাতির লোকেরা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও এমনভাবে নাচ গান করেন । নিত্য পরিশ্রমের কঠোরতা ও আনন্দ মিষ্টি সংগীত আর আনন্দময় নাচের মাধ্যমে দেখা দিয়েছে ।
ইউন নান প্রদেশে চীনের বহু সংখ্যালঘুজাতির বাস । এর মধ্যে ই জাতির লোকসংখ্যা সবচাইতে বেশী । ই জাতির ৪০ লক্ষ লোকসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশী এখানেই থাকে । ইতিহাসে ঘন ঘন স্থানান্তর আর ইউন নানের জটিল ভৌগলিক অবস্থার দরুণ এখানকার ই জাতি বহু শাখায় পরিনত হয়েছে । ভিন্ন শাখার ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পোষাক ও ভাষা আছে । এতে ইউন নানের ই জাতির নাচ গানের রকমারিতাও দেখা দিয়েছে ।
'সিগারেট কেইস নৃত্য' ইউন নানের ই জাতির একটি জনপ্রিয় লোক নৃত্য । গ্রামবাসীরা এক দিকে নাচ করেন , অন্য দিকে হাতে সিগারেট কেইসের উপরে বাজান ।সুতরাং এই নাচকে 'সিগারেট কেইস নৃত্য' বলে । এই নৃত্য সংগীতের সুর স্ফুর্তিপূর্ণ এবং তা ইউন নানের মধ্যাংশের ই জাতি এলাকায় খুব জনপ্রিয় ।
সিগারেট কেইস নৃত্য ই জাতির অন্যতম ঐতিহ্যিক নৃত্য । প্রাচীনকালে ই জাতির লোকদের পশু শিকার তত্পরতার ভিত্তিতএই নাচের জন্ম । তখন ই জাতির লোকেরা পশুর চামড়া পরে শিকার করতেন , ধীরে ধীরে লোকেরা এটা অনুসরণ করে এক ধরনের নৃত্য সৃষ্টি করেছেন । পরে তারা সিগারেট কেইস বাজাতে বাজাতে নাচ করেন ।
চীনের কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘুজাতি তত্ত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মাদাম হো ছিং ইউন নানের ই জাতির লোক । তিনি মনে করেন যে , সিগারেট কেইস নৃত্য এক ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নৃত্য ।
এই নাচ করার জন্য কনুই , কোমর আর হাতুর সমন্বিতভাবে ব্যবহার দরকার । হাটু সোজারাখলে চলে না , নত জানু হয়ে নাচতে হয় । নাচের ভঙ্গী খুবই সুন্দর , তাতে দক্ষিণ এশিয়ার নৃত্যের বৈশিষ্ট্যও দেখা যায় ।
তিনি মনে করেন যে , ইউন নানের মধ্যাংশের ই জাতির এলাকা প্রাচীনকালের দক্ষিণ-পশ্চিম রেশমী পথে অবস্থিত বলে দক্ষিণ-পূর্ব আর দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সংগে এই এলাকার আদান প্রদান ঘনিষ্ঠ ছিল । 'সিগারেট কেইস নৃত্য' দক্ষিণ এশিয় নৃত্যের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য শিখে ই জাতির সাংস্কৃতিক উন্নয়নের একটি চিহ্নে পরিনত হয়েছে ।
চীনের সংখ্যালঘুজাতির নাচের মধ্যে 'সিগারেট কেইস নৃত্য' অন্যতম কঠিনতম নৃত্য । এক শতাধিক ধরনের নৃত্য ভঙ্গীর পরিবর্তনে শিল্পীদের জোরালো সংগীতের তাল আর শরীরের শক্তি দেখানো যায় । ই জাতির গ্রামে যারা ভালভাবে এই নাচ করতে পারেন , তারা গ্রামবাসীদের সমাদর পান । শিল্পীরা নাচের মাধ্যমে আরো বেশী আনন্দ বোধ করেন ।
'সিগারেট কেইস নৃত্য' এক ধরনের পেশাগত নৃত্য । এটা সবাই নাচতে পারেন না । ই জাতির মধ্যে'থিয়াও লো' নামে আরেকটি ধরনের নাচ খুব জনপ্রিয় । তার অর্থ নাচ আর আনন্দ । এই ধরনের নাচ একটু সহজ । ই জাতির গ্রামবাসীরা সবাই এই নাচ করতে পারেন ।
থিয়াও লো নাচ এক ধরনের দলগত নৃত্য । মানুষের করতালির মাধ্যমে তা করা হয় । কখনো কখনো দশ বারো জন , কখনো কখনো দু'জনই এই নাচ করতে পারেন । চীনের কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘুজাতির তত্ত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মাদাম হো ছিং বলেছেন , থিয়াও লো নাচ এক ধরনের জনপ্রিয় আমোদ প্রমোদমূলক নাচ । উত্সব , বিয়ে , উপাসনা প্রভৃতি বহু অনুষ্ঠানে এই নাচ পরিবেশন করা যায় ।
রাতে পাহাড়ী ই জাতির গ্রামবাসীরা সমাবেশিত হয়ে থিয়াও লো নাচ করেন । তরুণ তরুণীরা এই নাচের মাধ্যমে প্রেম করেন । বাচ্চারাও এই নাচ শিখে । তারা ছোট বেলা থেকে এই আনন্দ বোধ করে । বিবাহিতারা এই ধরনের নাচের প্রধান শক্তি। তারা নাচের মাধ্যমে এক দিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি দূর করতে চান।
বৈচিত্র্যময় নাচ আর সংগীতের সুন্দর সুরও ইউন নানের ই জাতির লোকদের আবেগ প্রকাশের এক ধরনের প্রনালী । ইউন নানের ই জাতির লোক সংগীত নানা রকমের । দৈনন্দিন জীবনযাপনে যা যা ঘটে , তা সব কিছু সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় । যেমন , পাহাড়ে উঠা , অতিথিকে স্বাগত জানানো , মদ খাওয়া আর বিয়ে ও শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের পরিবেশ ও অনিভূতিই সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় । ই জাতির লোকেরা প্রায় সবাই গান গাইতে পারেন । ভিন্ন জাযগার লোক সংগীতের ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে । ইউন নানের মধ্যাংশের মালভুমির হ্রদের তীরে থাকা ই জাতির লোকেরা ' হাই ছেই ছাং' লোক সংগীত গাইতে পছন্দ করেন ।
হাই ছেই মানে স্থানীয় হ্রদের এক ধরনের জলজ সবজি। স্থানীয় ই জাতির লোকেরা সাধারনতঃ এই জলজ সবজি উত্তোলনের সময়ে এই গান করেন । এই ধরনের গানের সুর জটিল আর তা গাওয়ার পদ্ধতি রকমারি ।
ই জাতির লোকেরা এক দিকে পরিশ্রম করেন , অন্য দিকে এই গান করেন । মাদাম সি সু লান এই ধরনের গান গাওয়ায় পারদর্শী । তিনি বলেছেন , আমি যেমন ই জাতির নাচ তেমনি ই জাতির লোক সংগীত পছন্দ করি । আমি ছোট বেলা থেকে গান গাইতে পছন্দ করি । আমাদের লোক সংগীত পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে ।
ই জাতির লোক সংগীতের মধ্যে প্রেমভিত্তিক নানা প্রকার বিষয় আছে । ইউন নানের ই জাতির তরুণ তরুণীদের মধ্যে প্রশ্ন করা আর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার এমন এক ধরনের লোক সংগীত খুব প্রচলিত , যার মাধ্যমে তাদের প্রেম ব্যক্ত করা হয় ।
এখন ই জাতির লোকরা সুখী জীবনযাপন করছেন । অর্থনীতির উন্নয়নের সংগে সংগে তাদের পুরানো জীবনধারা ও পরিশ্রমের পদ্ধতিও দূর হয়ে যাচ্ছে । কিন্তু সংগীতের মাধ্যমে মনের কথা ব্যক্ত করার স্বভাবতাদের পরিবর্তিত হয় নি । তাদের নাচ গানে আনন্দ ও সুখী জীবন চাওয়ার আশা-আকাংক্ষা দেখা দিয়েছে।
|