গত বছরের ২৬শে জুলাই চীনের বিখ্যাত পন্ডিত ছি কংয়ের ৯২ জন্মবার্ষিকী । সেদিন পেইচিংয়ের পেইচিং শিক্ষক প্রশিক্ষন বিশ্ববিদ্যালয় তার জন্য বিরাটাকারের অভিনন্দন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে , সমাজের বিভিন্ন মহলের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও অভিনন্দন জানানোর জন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ।
ছি কং চীনের শেষ রাজবংশ—ছিং রাজবংশের রাজপরিবারের বংশধরের ছেলে , তার নামের উপাধি আইসিনচুয়েলো , এটা ছিং রাজবংশের রাজাদের উপাধি , তার পূর্ব পুরুষ হচ্ছেন ছিং রাজবংশের পঞ্চম রাজা ইয়োনচেনের পঞ্চম ছেলে । কিন্তু তার পূর্ব পুরুষের বংশধররা ধীরে ধীরে রাজপরিবার থেকে বিছিন্ন হয় । ছি কংয়ের জন্মের সময় চীন সামন্ততান্ত্রিক দেশ থেকে গণতান্ত্রিক দেশে রূপান্তরিক হচ্ছিল , সমাজ বিশৃঙ্খল ছিল । যদিও ছি কং রাজপরিবারের ছেলে , তবে তখন রাজকীয় শাসন ধ্বংসের পথে বলে রাজপরিবার আর তাকে রক্ষা করতে পারে না । ছি কংয়ের বয়স যখন এক বছর , তার বাবার মৃত্যু হয় , তিনি দাদার দেখাশোনায় বড় হয়েছেন । তার দাদা চীনের ঐতিহ্যিক হস্তলিপিও চিত্রশিল্প পছন্দ করেন , ছি কংও দাদার প্রভাবে কলম হাতে নিতে অনুকরণ করতেন । পরে দাদা তার জন্য চিত্রশিল্প ও হস্তলিপির শিক্ষক নিয়োগ করেন , পড়াশুনার ক্ষেত্রে ছি কংয়ের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই বলে পনেরো-ষোলো বছর থেকেই ছি কংয়ের হস্তলিপি ও আঁকা ছবি সমাজে সুনাম পেতে শুরু করে ।
১৯৩৩ সালে ২১ বছর বয়সি ছি কং বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ছেন হুয়ানের কাছ থেকে চীনের সাহিত্যের ইতিহাস , চীনের চিত্রশিল্পের ইতিহাস , চীনের বিভিন্ন রাজবংশের প্রবন্ধ ও কবিতা সংগ্রহ শিক্ষা ও গবেষনা করতে শুরু করেন । ধীরে ধীরে বিদ্যাগত গবেষনা হস্তলিপি ও ছবি আঁকার স্থলাভিষিক্ত হয়ে ছি কংয়ের প্রধান কাজে পরিণত হয়েছে ।
তার ৯২ নব্বই বছর জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ছি কং হুইচেয়ারে বসে আগে আগেই পেইচিং শিক্ষক প্রশিক্ষন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইং তুং সভাকক্ষে পৌছেন , অনুষ্ঠানে তিনি তার ছাত্র, সহকর্মী ও সাংস্কৃতিক মহলের গণ্যমাণ্য ব্যক্তির অভিনন্দন ও আশির্বাদ গ্রহন করেন । প্রচুর সুন্দর সুন্দর ফূলের তোড়া ও ফুলের ঝুলি ছাড়া ছি কং তার ছাত্রদের উপহার দেয়া একটি খেলনা ভল্লুকও পেয়েছেন , এই খেলনা ভল্লুক পেয়ে ছি কং বাচ্চার মতো হেসেছেন , তার ছাত্ররা বলেছেন , তাদের এই প্রবীন শিক্ষক এখনো বাচ্চার মতো খেলনা খুব পছন্দ করেন । চীনের একজন বিখ্যাত পন্ডিত হিসেবে ছি কং সমাজের বিভিন্ন মহলের ব্যক্তির ব্যাপক প্রশংসা জয় করেছেন । চীনের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হুয়ান মিয়াও চি বলেছেন , গবেষনা ক্ষেত্রে ছি কংয়ের অর্জিত সাফল্য সর্বজন স্বীকৃত । ছি কং চীনের একজন প্রাচীন পুথিপত্র গবেষক , ঐতিহাসিক , সুরকার ও বিখ্যাত হস্তলিপি ও চিত্রশিল্প কর্ম যাচাই বিশেষজ্ঞ , তা ছাড়া ছি কং দীর্ঘকাল শিক্ষকতার কাজ করেছেন , তিনি চীনের একজন আদর্শ শিক্ষাবিদ ।
যদিও ছি কংয়ের পরিচয় কার্ডে চীনের কেন্দ্রীয় পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক তথ্য কেন্দ্রের প্রধান ও চীনের হস্তলিপি সমিতির অবৈতনিক চেয়ারম্যানসহ অনেক পদ আছে , তবে ছি কং এগুলোর মধ্যে শিক্ষকতার কাজকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেন । তিনি বলেছেন , ছবি আঁকা ও হস্তলিপি চর্চা তার আনুষঙ্গিক কর্মমাত্র । ৭০বছর দীর্ঘ শিক্ষকতার প্রক্রিয়ায় ছি কং চীনের প্রাচীন সাহিত্যের বিষয় পড়ানো ও গবেষনা ক্ষেত্রে লক্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন এবং দেশের জন্য অনেক প্রাচীন সাহিত্য বিষয়ের শিক্ষক ও গবেষনা কর্মী প্রশিক্ষন করেছেন । পেইচিং শিক্ষক প্রশিক্ষন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছি কংয়ের সহস্তে লেখা একটি অভিলেখন একটি বড় পাথরের উপর খোদাই করা হয়েছে , এই অভিলেখনে বলা হয়েছে , ' ছাত্রদের আদর্শ শিক্ষক হও , চালচরণ ছাত্রদের দৃষ্টান্ত হও । ' পেইচিং শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে দাড়ানো এই অভিলেখন সম্বলিত বড় পাথর ঠিক ছি কংয়ের জীবনের সারসংকলন ।
গত শতাব্দীর আশির দশকের প্রথম দিকে ছি কংয়ের হস্তলিপি ও চিত্রকর্মের সংগ্রহ ও কবিতার সংগ্রহগুলো প্রকাশিত হয় এবং ব্যাপক পাঠকের সমাদর ও প্রশংসা পেয়েছে । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছি কংয়ের চিত্রকর্ম ও হস্তলিপির প্রদর্শনী জাপান , সিংগাপুর ও দক্ষিন কোরিয়ায় প্রদর্শীত হয় । চীনের বিখ্যাত পুরার্কীতি যাচাই বিশেষজ্ঞ ফু সি নিয়েন ছি কংয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । তিনি বলেছেন , ছি কংয়ের সংগে আমি ও আমার পরিবার- পরিজনের চার পুরুষের বন্ধুত্ব আছে , গত অর্ধ শতাব্দী ধরে আমি তাকে বাবার মতো সম্মান করি । ছি কং প্রাচীন ভাষা তত্ব , ইতিহাস , বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থগুলো , প্রাচীন সাহিত্য , দর্শন , ধর্ম প্রভৃতি ক্ষেত্রে গবেষনা করেছেন , তা ছাড়া বিভিন্ন রাজবংশের নিয়মবিধি , রীতিনীতি , অপেরা ও উপন্যাস সম্পর্কেও তিনি পরিচিত ।
বয়স বেশী হলেও ছি কং নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করতে পারেন না । চীনের সংস্কৃতি মন্ত্রনালয় ও জাতীয় পুরাকীর্তির ব্যুরোর অনুরোধে ছি কং অন্য কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সংগে দেশের বিভিন্ন জায়গার যাদুঘরগুলোতে সংরক্ষিত মুল্যবান চিত্রকর্ম ও হস্তলিপি যাচাই করেছেন , তাদের প্রয়াসের কল্যানে প্রাচীনকালের প্রচুর মূল্যবাণ পুরাকীর্তি জাতীয় পুরাকীর্তি ভান্ডারে স্থান পেল ।
ছি কং এক বিনয়ী ব্যক্তি , তিনি কখনো খ্যাতি ও লাভের জন্য কাজ করেন না । কিন্তু সরকার আর তার ছাত্ররা তার গবেষনার ফল জাতির সম্পদে পরিণত করার জন্য অনেক প্রচেষ্টা করেছেন । তার ৯২ বছর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ছি কংয়ের আত্মজীবনীসহ তার পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে । এই সব বই ছি কংয়ের মৌখিক বর্ণনা অনুসারে সংকলন করা হয়েছে । বই প্রকাশের খবর পেয়ে ছি কং আনন্দের সংগে বলেছেন , আমার পাঁচটি বই প্রকাশের খবর পেয়ে আমি এতো খুশি হয়েছি যে ভায়ায় প্রকাশ করতে পারছি না । আমার বয়স বেশী হয়েছে , আমার দৃষ্টি শক্তি ও শ্রবণ শক্তি দুর্বল , আপনাদের অনুপ্রেরনা আমি ভালো করে মনে রাখবো । বয়স বেশী হলেও যতদিন বেঁচে থাকবো , ততদিন আমি দেশের জন্য অবদান রাখার প্রচেষ্টা করবো ।
|