পেইচিং প্রাচীনকালে ত্রয়োদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউয়ান, মিং ও ছিং রাজবংশের রাজধানী ছিল।পেইচিং মহা -নগরে অনেক দশর্নীয়স্থান আছে। যেমন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাসাদ--- রাজকীয় প্রাসাদের সংগ্রহশালা যাকে বর্তমানে প্রাসাদ জাদুঘর বলে ডাকা হয় , সুন্দর রাজকীয় উদ্যান--গ্রীষ্মকালীণ প্রাসাদ, মিং সমাধিস্থান, বিশ্ববিখ্যাত মহাপ্রাচীর এবং পাঁচ লক্ষ বছর আগেকার " পেইচিং মানবের আবাসস্থল " ইত্যাদি ইত্যাদি।
গুয়েই সড়ক পেইচিং মহা- নগরের পূর্বাংশে অবস্থিত।এই সড়কে নানা ধরনের খাবার পাওয়া যায় বলে তা পেইচিংএর বিখ্যাত খাবারের সড়ক নামেও পরিচিত।এই সড়কের সবচেয়ে স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হলো রাত দুপুরের পর ব্যবসা শুরু হয়।প্রত্যেক দিন রাত দুপুর হলেও সড়কে গাড়িঘোড়ার বিরাম নেই এবং যেখানে-সেখানে কেবল মানুষের ভীড়। এই সড়কের দৈর্ঘ্য ১৫০০ মিটারের কম, তবে সড়কের দুই পাশের গাছপালায় এবং ছোট-বড় রেস্তোঁরার দরজার সামনে ৫০০টিরও বেশী লাল রংয়ের লন্ঠন ঝোলানে হয়।চীনের ঐতিহ্যিক আর প্রাচীন রীতি এই আধুনিক মহা নগরের রাত্রের জীবনের সংগে মিশে যায়।এই সড়কে নানা ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন খাবার পাওয়া যায়। সড়কের দুই পাশে প্রায় শতাধিত রেস্তোঁরা আছে। এগুলোতে সিছুয়ান , শানডোং , গুয়াংডোং প্রভৃতি জায়গার খাবার পরিবেশন করা হয়। যদি আপনি এই সড়কের সমস্ত খাবার এক বার করে আস্বাদন করতে চান , তাহলে প্রত্যেক দিন এখানে খেতে আসলেও হয়তো কয়েক মাস লেগে যাবে। রাত দুটা পার হয়ে গেছে, কিন্তু রেস্তোঁরাতে মানুষের গমনাগমনের বিরাম নেই। সংবাদদাতা হুয়াচায়ুইউয়েন নামে একটি রেস্তোঁরায় ঢুকলেন।এই রেস্তোঁরার প্রাচীন শৈলীসম্পন্ন স্থাপত্যে পেইচিংএর পুরানো চক মেলানো বাড়ীর রীতি পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়েছে। চীনের প্রাচীন স্থাপত্য শৈলী অনুসারে এই রেস্তোঁরা সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে।রেস্তোঁরার ম্যানেজার চিয়াং চিন চিয়েন ব্যাখ্যা করে বললেন,
ছিং রাজবংশের শেষ দিকে এই রেস্তোঁরা এক জন জেনারেলের ব্যক্তিগত বাড়ী ছিল। সাধারণত পেইচিংএর চক মেলানো বাড়ীগুলোতে চীনের প্রাচীন স্থাপত্যের শৈলী প্রতিফলিত হয়। আমাদের রেস্তোঁরায় পেইচিংএর চক মেলানো বাড়ীর সংস্কৃতির সংযোগ সাধিত হয়েছে। এখানে ইংরেজী ভাষায় লেখা মেন্যু আছে। তা ছাড়া , রেস্তোরায় দোভাষীও আছে। সুতরাং তাদের মাধ্যমে বিদেশী বন্ধুরা এখানে চীনের ঐতিহ্যিক খাবারের সংস্কৃতি অনুভব করতে পারেন।
এই রেস্তোঁরার খাবার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তা ছাড়া, এখানে চীন আর পাশ্চাত্য খাবার সংস্কৃতির সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়।যেমন ধরুন, একটি মিশ্টির নাম চাইনা পিজাদ। ভূট্রা, ডিম, কলা আর লীক দিয়ে এই মিশ্টি বানানো হয়। খেতে বিশেষভাবে মচমচে লাগে।কিন্তু এই সড়কের সবচেয়ে বিখ্যাত খাবার সম্বন্ধে বলতে গেলে, মরিচ দিয়ে চিংড়ি মাছ ভাজা-করা এক ধরনের খাবার নি:সন্দেহে পেইচিংবাসীদের সবচেয়ে পছন্দ । এই খাবার খুবই জনপ্রিয়।বিপুল পরিমাণ মরিচ দিয়ে ভাজা-করা চিংড়ি মাছের রং লাল , খেতে সুস্বাদু। এই খাবার অজস্র মানুষকে আকর্ষন করে থাকে । জানা গেছে, এই খাবার তৈরীর প্রণালী অত্যন্ত জটিল। প্রথমে চিংড়ি মাছগুলোর মধ্যে যে সব চিংড়ি জীবন্ত সে সব চিংড়ি বেছে নেয়া হয়। আবার এগুলোর মধ্যে যেগুলো মাংসবহুল সেগুলোকে বিশুদ্ধ পানিতে দু দিনের জন্যে রাখা হয়।প্রত্যেক বছরের গ্রীষ্মকালে গুয়েই সড়কে এই ধরনের খাবারের উতসবও আয়োজন করা হয়।তখন হাজার হাজার লোক এখানে এই বিশেষ খাবার উপভোগ করতে জড়ো হয়।প্রায় ৩০ বর্গ মিটার আয়তনের একটি রেস্তোঁয় আধুনিক পোষাক পরা একজন তরুণ এই বিশেষ খাবার উপভোগ করচ্ছিলেন।তার সামনে একটি থালা। থালা মরিচ দিয়ে ভাজা-করা চিংড়ি মাছে ভূরা ।তিনি চটপট চিংড়ি মাছের ছাল ছিঁড়ে ফেলে সাদা টাটকা মাংস মুখে দিচ্ছিলেন। দু হাতে তেল মাখানো । তার এই নিবিষ্ট ভাব দেখে মনে হয় তিনি দুনিয়ার সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার উপভোগ করচ্ছিলেন।হুয়াং ডে ভিয়েন নামে এই ভদ্র লোক সংবাদদাতাকে বললেন,
যখন আমার বয়স ১৮ তখন থেকে আমি এখানে নিয়মিত খেতে আসি।এখন আমার বয়স ২৫ হয়েছে।কোনো কোনো সময়ে সপ্তাহে আমি কয়েক বার এখানে খেতে আসি।সাধারণত তরুণ-তরূণীরা সন্ধ্যার পর বাইরে গিয়ে ফূর্তি করে।ক্ষুধার্ত হয়ে তাদের খাওয়ার রুচি আপনাআপনি বেড়ে যায়।এখানকার খাবার তাদের রুচির সংগে খাপ খায়।উপরন্তু এত দেরিতে অন্যান্য জায়গায় আর কোনো খাবার পাওযা যায় না।এখানে অনেক রেস্তোঁরা আছে। রেস্তোঁরাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই অপেক্ষাকৃত বড় ।যা খুশি তাই পাওয়া যায়।আপনি যদি পেইচিং বেড়াতে আসেন এবং পেইচিংএর বাণিজ্য কেন্দ্র ওয়াংফুচিনের গুয়েই সড়কে না যান তাহলে তা অনুশোচনার ব্যাপার হবে।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুয়েই সড়কের বৈচিত্র্যময় খাবার জনসাধারণকে আকর্ষণ করেছে।ক্রমেই রেস্তোঁরা ছাড়া, এই সড়কে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দোকানের আবির্ভাব হয়েছে।মানুষ সহজেই লক্ষ্য করতে পারে যে , হয়তো যে কোনো একটি ছোট ঘর আধুনিক মহা নগরের সাংস্কৃতিক রসে পরিপুর্ণ। সবাক খালনা নামক একটি ছোট দোকান মাত্র এ বছর খোলা হযেছে। দোকানে নানা খেলনা সাজানো হয়েছে। তা ছাড়া, দোকানে দুটি ছোট কুকুর প্রতিপালন করা হয়।দোকানী একজন লোকসংগীত শিল্পী। তার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি।তিনি সংবাদদাতাকে বললেন, এক ধরনের অবসরপূর্ণ জীবনযাপনের পদ্ধতি অনুসরণ করা তার এই দোকান খোলার উদ্দেশ্য।
সবাক খেলনার অর্থ এই যে, খেলনা দিয়ে খেলার সময়ে মন দিয়ে তার সংগে মত বিনিময় করতে হবে।ফলে খেলনা যেন জীবন্ত প্রাণীতে পরিণত হয়।যেমন ধরুন, এই খেলনা বেকহ্যামের ছেলে , পরনে সাত নম্বর পোষাক। একটি স্তন্যপানের-বোটা তার মুখে আছে। পরে আমরা ধারাবাহিকভাবে আরো খেলনা তৈরী করবো।এ সব খেলনা গাইতে পারে, নাচতে পারে।দেখুন, এই খেলনা ঠেলে দিলে আমি তোমাকে ভালবাসি বলতে পারে।এটা হলো খেলনার ভালবাসা।খেলনার সংগে কথাবার্তা বললে খেলনা আপনার কথা বুঝতে পারে। আসল ব্যাপার হলো এই যে, আপনার নিজের হৃদয় নিজের সংগে কথাবার্তা বলছে।এ ধরনের দোকান এই সড়কে আরো কয়েকটি আছে।রাতে এ সব দোকান খোলা থাকে।অনেক লোক সুস্বাদু খাবার আস্বাদন করার পর এ সব দোকানে বেড়াতে পছন্দ করেন।শ্রোতা বন্ধুরা, আপনাদের কি এই সড়ক পছন্দ হয়েছে।গুয়েই সড়কের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের।হুয়াংজেনের বয়স ৮৮।তিনি সারা জীবন এই সড়কে বসবাস করেছেন।তিনি স্বচক্ষে এই সড়কের পরিবর্তন দেখেছেন।তিনি বলেছেন,
এই সড়কে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। অতীতে এখানে কোনো পরিবহণ ছিল না।১৯৪৯ সালের আগে অর্থাত নয়া চীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে, এই সড়কে এক দিনে একটি গাড়িও দেখা যেত না।এখন প্রত্যেক মিনিটে যে সব গাড়ি এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করে সে সব গাড়ীর সংখ্যা সেই সময়ে এক বছরেরও বেশী ।রাত্রের কোলাহল ক্রমেই উধাও হয়ে যাচ্ছে , পূর্ব দিকে এক ফালি সুর্যের আলো মাটির উপর লুটিয়ে পড়ছে।নতুন এক দিন শুরু হচ্ছে।গুয়েই সড়ক আস্তে আস্তে তার সহিষওতা গোটা মহা নগরের কাছে হস্তান্তর করেছে।শ্রোতা বন্ধুরা, পেইচিং ভ্রমণ করতে আসলে অবশ্যই গুয়েই সড়কে এক বার বেড়াতে আসুন।
|