চীনের মঙ্গলিয় জাতি এক নাচ ও গানের জাতি , চীনে অনেক মঙ্গলিয় জাতির কন্ঠশিল্পী আছে , বিখ্যাত কন্ঠশিল্পী হাজাবু তাদের মধ্যে একজন । কেউ কেউ বেঁচে থাকার জন্য গান গান , কেউ কেউ কিন্তু গান গাওয়ার জন্য বেঁচে থাকেন । কন্ঠশিল্পী হাজাবু নিজের জীবন তার গানের সংগে মিশিয়ে দিয়েছেন । ৮৩ বছর বয়সী হাজাবুর জন্ম উত্তর চীনের অন্তর্মঙ্গোলীয় স্বায়তশাসিত অঞ্চলের আপাগা জেলায় , চীনের মঙ্গলীয় জাতির ঐতিহাসিক বীর চেন্গিস খান তার পরিবারের পূর্ব পুরুস । তার হাজাবু নামটি তিব্বতী ভাষা থেকে নেয়া হয়েছে , নামটির অর্থ আল্লার দান , তার বাবা মা তাকে খুব ভালোবাসেন ।
হাজাবুর বয়স ৮৩ বছর হলেও তিনি এখনো খুব স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন , তার স্মরণ শক্তিও ভালো । তিনি বাবা গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন। বাবা যখন তাকে প্রথমবার কোলে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে বসে তৃণ ভুমিতে ঘুরে বেড়ান , তখন হাজাবু বাবার গান ও সীমাহীন তৃণভুমির জন্য অভিভুত হন । তিনি বলেছেন , আমার বাবা মা দুজনই লোকসংগীত গাইতে পারেন , আমি তাদের একমাত্র ছেলে । তাদের প্রভাবে আমি ছোট বেলা থেকেই গান গাইতে পছন্দ করি। ছয়-সাত বছর থেকে আমি বাবা-মার কাছ থেকে গান শিখতে শুরু করি , তারা যখন বাদ্যযন্ত্র বাজান , তখন আমি তার সুরে সুরে গান গাই । সতের-আঠারো বছর বয়সে আমি তাদের কাছ থেকে অনেক গান শিখেছি এবং কিছু খ্যাতিও লাভ করেছি । পরে হাজাবু স্থানীয় মঙ্গলীয় জাতির গায়কদের কাছ থেকে গান শিখেছেন এবং মঙ্গলীয় জাতির বৈশিষ্ট্যময় দীর্ঘ সুরের গান শিখে লোক সংগীতের গায়কে পরিনত হয়েছেন ।
দীর্ঘ সুরের গান হলো মঙ্গলীয় জাতির লোকসংগীতগুলোর এক বৈশিষ্ট্যময় গান , অন্তমঙ্গলীয়ার চারণ ভুমিতে এই ধরনের সুর খুবই জনপ্রিয়। দীঘসুরের গানের সুর উদাও ও প্রানবন্ত , গানের সুর তীব্র হলে শুনতে ঘোড়ার পায়ের খুরের শব্দ বলে মনে হয় , সুর লম্বা হলে আকাশের সাদা মেঘের মতো শান্ত । দীর্ঘ সুরের গানের প্রতি তার সুগভীর উপলব্ধি অনুসারে দীর্ঘ সুরের বৈশিষ্ট্যময় কম্পন আয়ও করে হাজাবু নিঃশ্বাস , মন ও স্বর সুন্দরভাবে সমন্বিত করতে পারেন । চীনের বিখ্যাত লেখক ইয়ে সেন থাও হাজাবুর গানের বর্ণনা করে বলে বলেছিলেন , হাজাবুর গান যেন নতুন চায়ের পাতা ও পুরানো মদের মতো সুগন্ধ, তার গান ঝরনার পানির মতো স্বচ্ছ । চীনের বিখ্যাত কবি সি মু রোনের কবিতায় বলা হয়ছে , হাজাবুর গান তৃণ ভুমিতে ভেসে আসলে আকাশের মেঘ যেন স্তব্ধ হয়ে যায় , বাতাসও যেন শ্বাস নিতে ভুলে যায়। হাজাবু নিজের গাওয়া দীর্ঘ সুরের গান বর্ণনা করে বলেছেন , আমার দীর্ঘসুরের গান যেন সীমাহীন তৃণভুমি , যেন আমার বাবা-মা। হাজাবু নিজের চমত্কার কন্ঠস্বরের জন্য সবার শ্রদ্ধা ও সমাদর জয় করেছেন । তিনি অন্তমঙ্গলীয় জাতির পশুপালকদের মহাসম্মীলনী—নাদামু সাংস্কৃতিক উত্সবে মোট তিনটে ঘোড়ার পুরস্কার জয় করেছেন ,এটা তৃণভুমির সর্বোচ্চ পুরষ্কার , গোটা তৃণভুতিতেই হাজাবুর নাম ছড়িয়ে পড়ে ।
এ কথা শুনে শ্রোতা বন্ধুদের হয়ত অবাক লাগে , হাজাবুর গান তার প্রাণ বাঁচিয়েছিল । হাজাবুর বয়স যখন ২৪ বছর , তিনি স্থানীয় এক দস্যু দলের হাতে ধরা পড়েন , দস্যুরা তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল । তাকে মেরে ফেলার আগে দস্যুরা তাকে কয়েকটি কথা বাবা-মাকে বলার সুযোগ দিলো । হাজাবু কিন্তু দস্যুর কাছে একটি গান গাওয়ার অনুরোধ জানালেন । হাজাবু ' ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসি ' নামে একটি গান গেয়েছেন । এটা তৃণভুমির একটি পুরানো গান । মঙ্গলীয় জাতির অধিবাসীরা ঘোড়াকে তৃণভুমির প্রতীক হিসেবে মনে করেন । দস্যুরাও মঙ্গলীয় জাতির লোক , তাই হাজাবুর প্রথম গান শুনে দস্যুরা তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় নি , দ্বিতীয় ও তৃতীয় গান শুনে দস্যুদের মধ্যে একজন মুগ্ধ হয় এবং তার চোখ পানিতে ভরে উঠে , হাজাবুর গান তাদের হৃদয়ে শুভবুদ্ধি জাগিয়ে তুলেছে । দস্যু সর্দার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হাজাবুকে বলেছেন , থাক , তুমি ফিরে যাও , তুমি তৃণ ভুমিতে ফিরে গান গাইতে যাও ।
১৯৫৩ সালে হাজাবু অন্তমঙ্গলীয় নৃত্যসংগীত দলে ভর্তি হন । তার গান পরিবেশনার মঞ্চ তৃণ ভুমি থেকে থিয়েটারে স্থানান্তরিত হয় , গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তিনি শহরাঞ্চলের প্রচুর সংগীত অনুরাগীর সমাদর পেয়েছেন । হাজাবু নৃত্যসংগীত দলের সংগে মাতৃভুমির বিভিন্ন জায়গা ও পৃথিবীর অনেক দেশ সফর করেছেন । প্রতিবেশী মঙ্গোলিয়া প্রজাতন্ত্র সফরকালে হাজাবুর গান দর্শকরা এতো পছন্দ করেন যে গান পরিবেশনের পর হাজাবু এগারো বার মঞ্চে উঠে ধন্যবাদ জানানোর পরও দর্শকরা তাকে ছাড়তে চান না । সুইডেন ও ডেনমার্ক সফরকালে দর্শকরা হাজাবুকে তাদের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য মঞ্চে উঠে তার কোলে অনেক উপহার দেন । হাজাবু বুঝতে পেরেছেন পৃথিবীতে শুধু একটি ভাষার কোনো অনুবাদকের দরকার নেই , এই ভাষা হলো সংগীত । তিনি বলেছেন , প্রতিটি অনুষ্ঠানের পর অনেক দর্শক মঞ্চে উঠে আমার সংগে আলিংগন করেন , এতে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি । আমি জাপান, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন , সুইডেন প্রভৃতি দশ-বারোটি দেশ সফর করেছি । বিদেশী বন্ধুরা আমার গান পছন্দ করেন , আমার আরো বেশী গান উপভোগ করার জন্য তারা জোরে জোরে হাত তালি দেন । প্রত্যেকবারই আমি তাদের অনুরোধ মেটানোর চেষ্টা করেছি ।
১৯৮৯ সালে অন্তর্মঙ্গোলীয় স্বায়তশাসিত অঞ্চল সরকার হাজাবুকে সংগীত রাজার উপাধি দিয়েছে । এক কন্ঠশিল্পীর পক্ষে এটা এক বড় মযাদা । ১৯৮৭ সালে অন্তমঙ্গোলীয় নৃত্যসংগীত দল থেকে অবসর নেয়ার পর হাজাবু তৃন্যভুমিতে ফিরে গিয়েছেন । নিজের জন্মভুমিতে হাজাবু যুবক সংগীতবিদদের প্রশিক্ষন দেয়ার কাজ করেছেন , চীনের বিখ্যাত কন্ঠশিল্পী হু সুন হুয়া ও রাসু রো প্রমুখ তার ছাত্র ছিলেন । তিনি বলেছেন , আমি তৃণ ভুমির ছেলে ,সরকার ও দর্শক আমাকে অনেক মর্যাদা দিয়েছে ,আমি আশা করি যুব কন্ঠশিল্পীরাও দীর্ঘ সুরের মঙ্গোলীয় লোকসংগীত গাইবেন , এই ধরনের গান গাওয়ার পদ্ধতি আয়ও করার সহজ নয় , ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব ।
|