সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের তথ্য কার্যালয় চীনের সংখ্যালঘু এলাকার স্বশাসন শীর্ষক একটি স্বেতপত্র প্রকাশ করেছে । স্বেতপত্রটিতে গত পঞ্চাশাধিত বছর ধরে চীনের সংখ্যালঘুজাতি এলাকাগুলোতে স্বশাসন প্রবর্তনের অভিজ্ঞতা ও সাফল্য সার্বিকভাবে পর্যালোচনা আর বর্ননা করা হয়েছে । কিছু সংখ্যালঘুজাতির সুধি ব্যক্তি সংবাদদাতাকে দেয়া সাক্ষাত্কারে বলেছেন , চীনের সংখ্যালঘুজাতির এলাকাগুলোতে স্বশাসনের বাস্তবায়নে বলিষ্ঠভাবে বিভিন্ন সংখ্যালঘুজাতি এলাকার অর্থনৈতিক গঠনকাজ আর শিক্ষা , সংস্কৃতি প্রভৃতি ব্রতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা হয়েছে ।
চীনদেশ বহু জাতি নিয়ে গঠিত । সমগ্র দেশের ১৩০ কোটি জনসংখ্যাক মধ্যে হান জাতির জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৯১ শতাংশ । হান জাতি ছাড়া চীনে আরো ৫৫টি জাতি আছে । তাদের জনসংখ্যা শুধু মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ ।সুতরাং এই ৫৫টি জাতি সংখ্যালঘুজাতি বলে অভিহিত করা হয় । গত শতাব্দির পঞ্চাশের দশক থেকে চীন স্বশাসনের পদ্ধতিতে সংখ্যালঘুজাতির কাজ পরিচালনা করে আসছে ।
চীনের ৩৪টি প্রদেশ পর্যায়ের প্রশাসনিক এলাকার মধ্যে পাঁচটি হলো সংখ্যালঘুজাতির স্বশাসন এলাকা । এই ৫টি স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল ছাড়া অন্যান্য প্রদেশ পর্যায়ের প্রশাসনিক এলাকাগুলোতেও বহু স্বায়ত্ত শাসিত বিভাগ ও জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । বিভিন্ন সংখ্যালঘুজাতির অধিবাসীরা যার যার অধ্যুষিত এলাকায় পুরোপুরি স্বশাসন উপভোগ করেন। বর্তমানে চীনে যে সব স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল আছে , সে সব অঞ্চলের আয়তন দেশের ভুভাগের মোট আয়তনের অর্ধেকেরও বেশী ।
সংবিধান আর সংখ্যালঘুজাতি এলাকার স্বশাসন আইন প্রভৃতি আইন অনুসারে বিভিন্ন স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের সর্বোচ্চ প্রশাসককে স্থানীয় প্রধান জাতির লোকদের দ্বারা নির্বাচিত হতে হয়। অন্যান্য পর্যায়ের ক্ষমতা সংস্থা , যেমন আইন প্রনয়ন , গণ নিরাপত্তা , অভিশংসক বিভাগের প্রধান প্রধান দায়িত্বশীল ব্যক্তিও সংখ্যালঘুজাতির ব্যক্তিদের দ্বারাই নিয়োগ প্রাপ্ত।
পাই চাও তিব্বত স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের আইন প্রনয়নকারী সংস্থা-গণ কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটির অন্যতম সদস্য । তিনি বলেছেন , স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলগুলোতে স্বজাতি আর স্ব-অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনা করা এবং স্বতন্ত্রভাবে অর্থনীতির নির্মানকাজ ব্যবস্থা , পরিচালনা আর উন্নয়ন করা ছাড়াও স্বজাতি ও স্থানীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের সংগে সংগতিপূর্ণ স্থানীয় স্বশাসন নিয়মবিধি প্রনয়ন করা যায় ।
তিব্বত স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের প্রথম গণ কংগ্রেসের পর স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের গণ কংগ্রেস আর তার স্ট্যান্ডিং কমিটি পর পর ২৩৭টি আঞ্চলিক আইনবিধি আর আইনবিধিমূলক সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাব প্রনয়ন করেছে ।
এই সব আঞ্চলিক আইনবিধি স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের অর্থনীতি , রাজনীতি , সমাজ, সংস্কৃতি প্রভৃতি ব্রতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য আইনগত নিশ্চয়তা যুগিয়েছে ।
মিঃ পাই চাও বলেছেন , তিব্বত স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের প্রনীত বিবাহ আইনের সংশোধিত নিয়মবিধিতে যেমন স্থানীয় সংখ্যালঘুজাতির বিয়ের বয়স শিথিল করা হয়েছে , তেমনি এক স্ত্রী বহু স্বামী , এক স্বামী বহু স্ত্রী প্রভৃতি প্রথা অব্যাহত রয়েছে। তা ছাড়া স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলে তিব্বতী ভাষার অধ্যয়ন ও ব্যবহার , পরিবেশ সুরক্ষা , পুরাকীর্তি সংরক্ষণ প্রভৃতি ক্ষেত্রের নিয়মবিধিও প্রনয়ন করা হয়েছে । ফলে স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশের সমন্বিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা হয়েছে ।
চীনের বেশীর ভাগ সংখ্যালঘুজাতি সীমান্ত অঞ্চলে বাস করে । তাদের অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত । বহু বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক, কর আদায় , ব্যাংকিং , ভুভাগীয় সম্পদের সুরক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের প্রতি সহায়তামূলক ব্যবস্থাও প্রনয়ন করেছে । বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার সংখ্যালঘুজাতির উন্নয়ন খাতে এক ট্রিলিয়ন ইউয়ান অর্থ বরাদ্দ করেছে ।
লুং ইউয়ান উয়ে চীনের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির একজন জুয়ান জাতির পন্ডিত । তিনি দীর্ঘকাল ধরে সংখ্যালঘুজাতি এলাকার অর্থনীতি বিষয়ক অধ্যয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। জরীপ আর গবেষনার কাজের প্রয়োজনে তিনি বহু সংখ্যালঘুজাতি এলাকায় গিয়েছেন । সম্প্রতি তিনি তার নিজের জন্মস্থল , জুয়ান জাতির অধ্যুষিত কুয়াংশির পাই সি অঞ্চলে গিয়েছিলেন । তিনি গত বিশাধিক বছরে পেইচিংয়ে চাকরি করেছেন । এবার জন্মস্থলে গিয়ে তিনি খুব মুগ্ধ হয়েছেন । তিনি বলেছেন , গত এই বিশাধিক বছরে সংখ্যালঘুজাতি এলাকার আমূল পরিবর্তন হয়েছে ।
কুয়াংশি স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের পাই সি এলাকা একটি গরীব এলাকা ছিল । এখন এই অঞ্চলের কৃষি উত্পাদন প্রযুক্তি আর পরিমাপের দিক থেকে অনেক উন্নত হয়েছে । হাজার হাজার হেক্টর জমিতে টমেটো , আম, ইক্ষু আর শাক-সবজি চাষ করা হয় ।
মিঃ লুং বলেছেন , ইতিহাসে সংখ্যালঘুজাতি এলাকা অর্থনীতির দিক থেকে অনুন্নত ছিল । কোনো কোনো জাতি এমন কি প্রত্যক্ষভাবে অতি প্রাচীন সমাজ থেকে সমাজতান্ত্রীক সমাজে রুপান্তরিত হয়েছে । এখন বহু সংখ্যালঘুজাতি এলাকায় গ্রামে গ্রামে সড়ক নির্মিত হয়েছে আর টেলিফোনের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে । পাহাড়ী অঞ্চলে বেতার আর টেলিভিশন অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হবার পর জনগনের জীবনযাত্রার বিপুল পরিবর্তন হয়েছে ।
সংখ্যালঘুজাতি এলাকার জনগনের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবার সংগে সংগে চীন সরকার এই সব এলাকায় শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে দিয়েছে । যেমন ন'বছর মেয়াদী বাধ্যতামূলক শিক্ষা জনপ্রিয় করার জন্য দেশ সংখ্যালঘুজাতি এলাকার ছাত্রদের শিক্ষার ফি আর লেখাপড়ার জন্য ব্যবহার্য সামগ্রীর ফি মওকুফ করেছে । উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর মাধ্যমিক পেশাগত বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সংখ্যালঘুজাতির পরীক্ষার্থীদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় । মিঃ ইয়াং চিয়াং লিন , পেইচিংয়ের একটি সংখ্যালঘুজাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউন নান প্রদেশের তুলুং জাতির একজন স্নাতক । তিনি এখন পেইচিংয়ে চাকরি করছেন। তিনি বলেছেন , এখন তুলুং জাতির বেশীর ভাগ লোক ন'বছর বাধ্যতামূলক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন । এ পর্যন্ত প্রায় এক শো ছাত্রছাত্রী অনারস্ ডিগ্রি আর ব্যাচেললর্স ডিগ্রি পেয়েছেন । এখন ইউন নান প্রদেশের রাজধানী খুওমিং সহ বিভিন্ন স্থানে তুলুং জাতির উর্ধতন পর্যায়ের যোগ্য কর্মী আছেন ।
|