দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইউননান প্রদেশ আর মায়ানমারের সীমান্তে অবস্থিত পর্বতমালায় মানুষ ও প্রানীর রহস্যময় চিত্র দেখা যায়। সেখানে বসবাসকারী ওয়া জাতির লোকদের জন্য খাড়া পাহাড়ে যে এ সব নকশা চিত্রাংকন করা হয়েছে, তা এই জাতির ইতিহাস গ্রন্থ। ওয়া জাতির পূর্বপুরুষরা পাহাড়ে চিত্রাংকনের মাধ্যমে এই জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি রেকর্ড করেছেন।
দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সীমান্তে অবস্থিত ছাংইউয়ান অঞ্চলে বসবাসকারী ওয়া জাতি চীনের অন্যতম সংখ্যালঘুজাতি। তার লোকসংখ্যা প্রায় চার লক্ষ। ওয়া জাতির পূর্বপুরুষরা প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলের পর্বতমালায় থাকতেন। তারা পাহাড়ী চিত্রাংকনের মাধ্যমে এই জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি রেকর্ড করেছেন। গত শতাব্দির ষাটের দশকে এই সব পাহাড়ী চিত্র আবিস্কৃত হবার ফলে বিশ্বের জাতি বিষয়ক পণ্ডিত ও শিল্পীদের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে। ওয়া জাতির পূর্বপুরুষরা যে এত বিস্ময়কর চিত্রকর্ম সৃষ্টি করেছেন, তার জন্য তাঁরা খুব মুগ্ধ হয়েছেন।
সমুদ্র সমতলের চেয়ে ১ হাজার মিটারেরও বেশি উঁচুতে পাহাড়ের ছাংইউয়ানের এই সব পাহাড়ী চিত্র ছড়িয়ে আছে। নিবিড় বট গাছ আর বাঁশ বন থেকে কয়েক ডজন মিটার দীর্ঘ পাহাড়ের একটি খাড়ার দিকে মানুষ,প্রানী প্রভৃতি নকশা অস্পষ্ট দেখা যায়।
এই সব নকশায় তীর ধনুক ও বর্শাধারী মানুষ আর গরু, কুকুর ইত্যাদি প্রানী আছে। চিত্রাংকন সরল আর মোটামুটি, কিন্তু এতে তখনকার ওয়া জাতির লোকদের নিত্যকার জীবনযাত্রা প্রতিফলিত হয়েছে।
ছাংইউয়ানের পাহাড়ি চিত্র প্রসংগে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘুজাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়া জাতি বিষয়ক পণ্ডিত চাও ফু রোং বলেছেন, ছাংইউয়ানের পাহাড়ি চিত্র সৃষ্টি হয়েছিল তিন হাজার বছর আগে। এতে তখনকার ওয়া জাতি প্রভৃতি সংখ্যালঘুজাতির উত্পাদন ও জীবনযাত্রার অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেছেন, সকল পাহাড়ি চিত্র লেবুর মতো লাল রঙের। খনি আর প্রানীর রক্তের সংযোগ হওয়ার পর এই রঙ তৈরী করা হয়েছে। বিষয়বস্তুর দিক থেকে এই সব চিত্রে তখনকার ওয়া জাতির পূর্বপুরুষদের শিকার, পশুপালন, যুদ্ধ, নৃত্য, ধর্মীয় উপাসনা তত্পরতা ইত্যাদি রূপ পেয়েছে। চিত্রে যে বাড়িঘর, বৃক্ষ, সূর্য, সড়ক আর পাহাড়ের নকসা পাওয়া গেছে, তাতে ৩ হাজার বছর আগে ওয়া জাতিভিত্তিক সংখ্যালঘুজাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি আর জীবিকা প্রতিফলিত হয়েছে।
চাও ফু রুং বলেছেন, ছাংইউয়ানের পাহাড়ি চিত্র থেকে বোঝা যায়, তখনকার ওয়া জাতির পূর্বপুরুষরা তীর ও ধরুক তৈরী করতো, প্রস্তরজাত হাতিয়ার ব্যবহার করতো এবং চীনা মাটির দ্রব্য তৈরী করতেও শিখেছিলো। তারা পাহাড়ে নিজেদের জীবনযাত্রাভিত্তিক চিত্রাংকন করতো। এই সব পাহাড়ি চিত্র এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যার মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের পাবর্ত্য অঞ্চলে বসবাসকারী প্রাচীনকালের সংখ্যালঘুজাতির সংস্কৃতি গবেষণা করা যায়। এটা তাদের রাজনৈতিক অবস্থা, উত্পাদনের মান, আচার ব্যবহার সম্পর্কিত মূল্যবান তথ্য। ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের মার্স্টাস ডিগ্রির ছাত্র চাং উ মিন বলেছেন, ছাংইউয়ান পাহাড়ি চিত্রের বিষয়কবস্তু প্রচুর, নকসা সরল ও মনখোলা এবং মানুষ ও প্রাণীর ভাবভংগী জীবন্ত আর বৈচিত্র্যময়। এতে প্রাচীনকালের উপজাতির উত্পাদন ও জীবনযাত্রা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিনি বলেছেন, চীনের চারুকলা ইতিহাসে ছাংইউয়ান পাহাড়ি চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান আছে। এটা মূল্যবান চারুকলার তথ্য, যার মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সংখ্যালঘুজাতির লোকেদের চারুকলা গবেষণা করা যায়। ২০০১ সালে ছাংইউয়ান পাহাড়ি চিত্রকে দেশের রাষ্ট্র পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক দ্রব্য হিসেবে ধার্য করা হয়েছে। এখনকার ওয়া জাতির লোকদের সাংস্কৃতিক জীবনে কতকগুলোচারুকলা, সংগীত আর নৃত্যকর্মের রচনার ধারণা আর উত্স এ সব পাহাড়ী চিত্র থেকে এসেছে।
যখন ওয়া জাতির উত্সব পালিত হয় আর ধর্মীয় উপাসনা করা হয়, তখন তাদের এই ঐতিহ্যিক নৃত্য পরিবেশন করা হয়। নৃত্যে পাহাড়ি চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠে। ওয়া জাতির ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি এ পর্যন্ত যে প্রচলিত আছে, এই নৃত্য তারই একটি দৃষ্টান্ত।
এখন শিল্পগত প্রক্রিয়াকরন হবার পর কাঠের ঢোল নৃত্য আরো প্রাণবন্ত ও আনন্দময় হয়ে উঠেছে। কতকগুলো নৃত্যের ভঙ্গি যেমন পুরুষদের বর্শা নিক্ষেপ, ধনুক চর্চা আর নারীদের পরিশ্রমের ভঙ্গি সবই পাহাড়ি চিত্র থেকে এসেছে। ওয়া জাতির লোকেরা কাঠের ঢোল নৃত্য নাচ করার সঙ্গে সঙ্গে আহলাদের সঙ্গে চীত্কার করেন।
গত কয়েক বছরে ইউননান প্রদেশের পর্যটন শিল্প প্রসারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ছাংইউয়ানের পাহাড়ি চিত্র দেশ-বিদেশের পর্যটকদের একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থলে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ি চিত্রের নকসা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের বাড়িতে প্রবেশ করেছে এবং এই ওয়া জাতির সংস্কৃতি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেও পৌঁছেছে।
আরও
|