চীন একটি বহুজাতিক দেশ।৯৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বিশিষ্ট এই বিশাল ভুখন্ডে বাস করে ৫৬টি জাতি।তাই জাতি এগুলোর মধ্যে একটি।
আপনারা যে সংগীত শুনছেন তা হলো চীনের তাই জাতির একটি বিখ্যাত সংগীত।সংগীতের নাম হলো, চাঁদের আলোতে বাঁশের ছায়া। তাই জাতি হচ্ছে প্রধানত: চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের ইয়ুন্নান প্রদেশে বসবাসরত একটি সংখ্যালঘু জাতি।বাঁশের তৈরী বাড়ীঘর, নারীদের পরা বালতির মতো স্কার্ট, তাদের পরিবেশিত মযূর নাচ এবং পানি বিচ্ছুরন উত্সব জনতার প্রতি তার বৈশিষ্ট্য আর রোম্যানটিক অনুভুতি প্রকাশ পেয়েছে।এই সংখ্যালঘু জাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রীতিনীতির টানে , অনেক চীনা আলোকচিত্র-প্রেমী মাঝে মাঝে তাই জাতি অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে গিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং এই জাতির সুন্দর মেয়েদের ছবি তুলে থাকেন। চলচ্চিত্রকারদের তোলা তাই জাতির গ্রাম্য দৃশ্য সবর্দাই আমার মনে ভেসে উঠে ।তাই জাতি অধ্যুষিত গ্রামে অতিথি হিসেবে কয়েক দিন কাটানো আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন।এবার আমি ইয়ুন্নান প্রদেশ সফরের সুযোগ পেয়েছি।কিন্তু মাত্র অল্প সময়ের সফর। সুতরাং তাই জাতির জনসাধারনের জীবন সম্বন্ধে আমার বেশি জানার ইচ্ছা থাকলেও এবার আমি তাই জাতি অধ্যুষিত এলাকায় বেশী সময় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পাইনি।অবশেষে আমার বন্ধু আমার জন্য একটি তাই জাতির উদ্যান দেখার ব্যবস্থা নিয়েছেন । তিনি এভাবে আমাকে বললেন যে, যদি আমি ওই উদ্যানে যাই তাহলে আমি তাই জাতি সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারবো। সিশিয়ানব্যানা জেলার রাজধানী চিনহন শহর থেকে ৩০ কিলোমিটারের কম দূরে অবস্থিত এই তাই জাতির উদ্যান।অধিকাংশ তাই জাতি চীনের ইয়ুন্নান প্রদেশের সিশিয়ানব্যানা অঞ্চলে বসবাস করে। বতর্মানে চিনহন শহরে বসবাসরত তাই জাতির জনগণ আধুনিক শৈলীময় জীবনযাপন করছেন।কিন্তু এই শহর থেকে গাড়িতে আধা ঘন্টার পথ পার হয়ে তাই জাতির উদ্যানের বসবাস করা তাই জাতির জীবন সম্পূর্ণ আলাদা।এখানে তাই জাতির রীতিনীতি অক্ষত রয়েছে। এটা ঠিকই আমার জানা আর দেখা মূল্যবান জিনিস।যদি তাই জাতি সম্বন্ধে আপনার কৌতুহল থাকে , তাহলে চলুন আমার সংগে তেই জাতির উদ্যানে চলে যান।
তাই উদ্যান পৌঁছতে না পৌঁছতে তাই জাতির সংগীত দূর থেকে ভেসে আসছে।সংগীতের ঝংকার শান্ত আর মনোরম, সামনের গ্রামে বসবাসকারী তাই জাতির জীবন ঠিকই এই সংগীতের মতো।এই গ্রামের অধিবাসীরা শান্তিতে জীবনযাপন করছেন।উয়েয়ু নামে একজন তাই জাতির মেয়ে অথিতিপরায়ন। আমাকে স্বাগত জানানোর জন্যে তিনি গ্রামের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন।তাই জাতির বিশিষ্ট স্কার্ট মেয়েটির ছিপছিপে পাতলা শরীরের সাথে মানিয়েছে ।তিনি আমাকে তাই উদ্যানের ভিতরে নিয়ে গেছেন। যখন আমি চার দিকের দৃশ্য দেখতে নিবিষ্ট তখন তিনি আমাকে বর্নণা করতে শুরু করলেন।
৫টি গ্রাম নিয়ে এই তাই উদ্যান গঠিত হয়েছে।এই উদ্যান এমন একটি প্রাকৃতিক গ্রাম হয়ে দাঁড়িয়েছে যাতে সাংস্কৃতিক আকর্ষণ ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের মিশ্রণ দেখা যায়। ৫টি গ্রামে সব মিলে ৩১৩টি পরিবার, লোক সংখ্যা ১৪০০ জনেরও বেশি।এখানে আপনি যেমন প্রকৃত তাই জাতির স্ববৈশিষ্ট্যসম্পন্ন স্থাপত্য , তাই জাতির ঐতিহ্যিক হস্তশিল্প উপভোগ করতে পারেন, তেমনি তাই জাতির জীবনযাপনের শৈলীও অনুভব করতে পারেন।তার বর্ণনা শুনতে শুনতে আমরা গ্রামের ভিতরে ঢুকলাম।গ্রামের ভিতরের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে আমি লক্ষ্য করেছি, গুছানো তাই জাতির বাড়ীঘর সবুজ গাছপালায় আচ্ছন্ন।দুতলা বাঁশের তৈরী বাড়ীঘরগুলোর চারপাশে নারকেল আর সূপারি গাছের ঘেরা।গাছপালার ফাঁকে এ সব বাঁশের তৈরী বাড়ীঘরের চেহারা দেখা যায়। বাড়ীঘরের নীচে চারটি কাঠ আর বাঁশের খাট দড় করিয়ে মাটির উপরে নির্মিত হয়।ঘরের উপর তলায় মানুষ থাকে, নীচ তলায় পরিবারের ছোটখাট জিনিসপত্র রাখা হয়।বাঁশের তৈরী ঘরগুলোতে অত্যন্ত নীরব ।মাঝে মাঝে দু একজন মেয়ে দরজা বা জালনার বাইরে মাথা বের করে তাকলেন।তাদের মাথায় ঝুলে আছে এক থোকা ফুল ।প্রায় প্রত্যেক তাই জাতির মেয়ের মাথায় ফুল থেকে। আমি তামাসা করে বললাম, আপনারা খুব বিলাসী, ফুল দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে দিলেন? মেয়েটি হাসতে হাসতে আমাকে গ্রামের চার পাশের নানা রংয়ের ফুলের দিকে দেখিয়ে বললেন, এখানে সারা বছর ফুলের সমাবেশ, গাছপালায় সবর্দাই সবুজ থাকে।যখন মেয়েটি আমাকে বণর্না করলেন, তখন গ্রামের কয়েক জন মেয়ে আমাদের দিকে চলে আসছিল।তারা পরষ্পরকে তাই জাতির ভাষায় অভিবাদন জানায়।তাদের পরা বাদলির মতো স্কার্ট খুব আকর্ষনীয়।হাটঁবার সময়ে তাদের ছিপছিপে কোমরে মনে হয় ঝংকার রয়েছে, যেন সংগীতের স্বরলিপির চিহৃর মতো।ঠিক সেই সময় সংগীতের আওয়াজ আমার কানে ঢুকল।মেয়েটি আমাকে বললেন, এটা হলো গ্রামের কয়েক জন শিল্পীর গাওয়া গান ।
তাই জাতির মানুষ গায়ক-গায়িকাকে জেনহা ডাকে।বিয়ের আর অষ্তোষ্টিক্রীয়া অনুষ্ঠানে সাধারণত জেনহাদের গান গাইতে নিমন্ত্রণ করা হয়।তারা গানের মাধ্যমে অভিনন্দন, কামনা আর আশা-আকাংখা প্রকাশ করে। জানা গেছে, এই প্রচলনের ইতিহাস সহস্রাধি বছরের।এই রীতি তাই জাতি অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে অত্যন্ত জনপ্রিয়।তাই জাতির জনগণ মনে করেন, জেনহা না থাকলে, তরকারীতে লবণ না দিলে যেমন স্বাদহীন, জীবনেও যেন তেমনি রসহীন।মেয়েটি আমাকে আরো বললেন, তাই জাতির লোকেরা সকলেই বুদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী।প্রত্যেক গ্রামে কমপক্ষে একটি মন্দির আছে।গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হোক, মন্দ হোক, মন্দির সব সুন্দরভাবে নিমার্ন করা হয়েছে।মিস উয়েন আমাকে একটি জাঁকজমকপূর্ণ মন্দিরে নিয়ে গেলেন।তিনি আমাকে বললেন,
এই মন্দিরের নাম হলো মুশছন বৃহত মন্দির। খৃষ্ট ৫৮৩ আমলে এই মন্দির নিমির্ত হয়।তার ইতিহাস ১৪০০ বছরেরও বেশী।এই মন্দির তাই জাতির গ্রামের কেন্দ্র স্থান বলে গুরুত্বপূর্ণ উত্সব উপলক্ষে গ্রামবাসীরা সবাই এখানে প্রণাম করতে আসেন।শ্রদ্ধাবিগলিত মনে আমরা দু জন মন্দিরে ঢকলাম।এই শান্ত মন্দিরের ভিতরে বেশির ভাগ এখানে প্রার্থনা করতে আসা তাই জাতির লোক।ভিতরে ঢুকার পর বাচাল মিস উয়েন নীরব। তিনি দু হাত কোলের সামনে ক্রশ করে গন্ভীর ভাব ধরলেন।বুদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী বলে তেই জাতির মানুষ সবর্দাই শান্তশিষ্ট , সহজেই অন্যদের সংগে রাগ করে না। তারা সব সময়ে অন্যদের সংগে আন্তরিকভাবে সহাবস্থানে থাকেন।যখন আমি মন্দির থেকে বের হয়ে তেই জাতির বাসায় গেলাম, তখন আমার এই অনুভুতি আরো প্রবল।
বাঁশের তৈরী ঘরে উঠে আমরা দু জন একটি বাসায় ঢুকলাম। এই পরিবারের নারী মালিকের নাম উয়েপু।তিনি নানা রকমের নিরক্ষীয় অঞ্চলের ফলমুল আমাদের পরিবেশন করতে ব্যস্ত।এই নারী মালিক বেশি কথা বলেন না, তবু সব সময় অথিতিদের সামনে হাসি হাসি মুখ।তিনি আমাকে বললেন, তার স্বামী মাঠে চাষী কাজ করতে গেলেন, বড় মেয়ে এই গ্রামের গাইড এবং ছোট মেয়ে ইস্কুলে গেছে।তার বাসায় তিনটি ঘর আছে।থাকার ব্যবস্থা বেশ ভালো।তার ঘরের বাইরে বিশেষভাবে একটি ছোট প্লাটফোর্ম নিমির্ত হয়েছে।প্লাটফোর্মে আবার দুটো কক্ষ আছে।তিনি বললেন, এ গুলো বিশেষভাবে অতিথিদের জন্য তৈরী করা হয়েছে।পরে জানা গেলো, সম্প্রতি তেই জাতির উদ্যানে পযর্টন শিল্প চালু হয়েছে।গ্রামের অনেক পরিবারে পযর্টকদের স্বাগত জানানো হয়েছে।তিনি বললেন,
পযর্টকরা তাই জাতির বাসায় থাকতে পছন্দ করেন। তারা আমাদের সংগে খেয়ে অভ্যস্ত হয়েছে।তারা আমাদের বাসায় থাকতে এসেছে বলে আমরা আনন্দিত। আমাদের বাসায় থাকতে তারাও খুব খুশী।তাদের মধ্যে কেউ কেউ দু তিন মাসের জন্য এখানে থাকেন।তিনি বললেন, অতীতে তাদের পরিবারের প্রধান আয় ধানের চাষ এবং ফুলের গাছ রোপনের উপর নির্ভর করা হতো। পযর্টন শিল্প শুরু হওয়ার পর, গোট গ্রামের তাই জাতির পরিবারের জীবনযাত্রা অনেক উন্নত হয়েছে। জানা গেছে, প্রত্যেক বছরের এপ্রিল মাসের মাঝখানে তাই জাতির সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ঐতিহ্যিক উত্সব---পানি বিচ্ছুরণ উত্সব পালিত হয়।পানি বিচ্ছুরণ উত্সবকে বেপরোয়া উল্লাস উত্সব বলে ডাকা হয়।নর ,নারী, বৃদ্ধ ,শিশু নির্বিশেষে সে দিন সবার গায়ের কাপড় সম্পূর্ণ ভিজা থাকে।
তাই জাতির উদ্যান ত্যাগ করার সময়ে, গোটা গ্রাম গোধূলীর আলোতে আচ্ছন্ন।রান্নার ধোঁয়া বাঁশের তৈরী বাড়ীঘর আর সুবজ গাছপালার ফাঁকে পাক খাচ্ছে।মন্দিরের উচু চড়া সোলালি আলোর ঝলকে চকচক করছে।আমার অজ্ঞাতে এ সব একটি তৈল চিত্রের রুপান্তরিত হয়েছে।
|