চীনের রাজধানী পেইচিং মহা নগর থেকে ৮০ কিলোমিটার উত্তরে এমন একটি জায়গা আছে যাকে " মহা প্রাচীরের উত্তর দিকের ছোট লিচিয়াং নদী" এবং "চীনের ছোট তিন গিরিখাত " বলে ডাকা হয়। এই জায়গার নাম হল লোং ছিং সিয়া অর্থাত লোংছিং গিরিখাত। বসন্তকালে ওখানে নানা প্রজাতির ফুলের সমারোহা, গ্রীষ্মকালে প্রাণ-জুড়ানো হাওয়া, শরককালে পাহাড়ের সারা গায়ে লাল পত্র-পল্লাবের আভরণ এবং শীতকালে ধ্যানী শিল্পীর জাদুর স্পর্শে দেদীপ্যমান বরফের বাতি।লোংছিং গিরিখাত শীতের দিনে হিমেল তাপমাত্রা দীর্ঘস্থায়ী বলে এখানে বরফ জমে থাকে লম্বা সময় ধরে।এই পরিপ্রেক্ষিতে এখানে বরফ-বাতির ভাস্কর্যের জন্ম । ১৯৮৭ সালে প্রথম বরফ-বাতির ভাস্কর্য উত্সব লোংছিং গিরিখাতে অনুষ্ঠিত হয়।এ পর্যন্ত একটানা ১৮ বার অনুষ্ঠিত হয়েছে।।এখন লোংছিং গিরিখাতের বরফ-বাতির ভাস্কর্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন । প্রত্যেক বছর বরফ-বাতির মূল বিষয় ভিন্ন।এক কথায় লোংছিং গিরিখাতের বরফ-বাতির ভাস্কর্য চিত্তাকর্ষক । কিছু দিন আগে বাংলা বিভাগের কর্মী ওয়াং তান হোং রুবি পেইচিংএ বসবাসরত তিনটি বাংলাদেশী পরিবারের সংগে লোংছিং গিরিখাতে বরফ বাতি দেখতে গিয়েছেন।আজকের এই আসরে আপনারা শুনতে পাবেন রুবি র লেখা একটি রেকডিংভিত্তিক প্রতিবেদন।প্রতিবেদনটির শিরোনাম: " তিনটা বাংলাদেশী পরিবারের সাথে আমার আনন্দ ভ্রমণ" ।
যে দিন আমরা লোংছিং গিরিখাতে গেলাম সে দিন ছিল পেইচিংয়ে চলতি শীত মত্তসুমের সবচেয়ে ঠান্ডা দিন।তবে আমরা তেমন শীত অনুভব করলাম না। যখন আমরা লোংছিং গিরিখাত পৌছুলাম তখন লজ্জাবতী বধুর কপালের টিপের মত পশ্চিমাকাশের সূর্যটা রক্তর্বণ করে এক মসয়ে দিগন্তরেখায় মিলিয়ে গেল। তখন বৈচিত্র্যময় আতশবাজি আমাদের দৃষ্টিগোচর হল, যেন আমাদের আগমনকে স্বাগত জানানো হচ্ছে।দক্ষিণ পাশের পাহাড়ে দেখা গেল প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট চিয়াং ছে মিনের অভিলেখন : " লোংছিং গিরিখাত" এ তিনটি বিরাট চীনা অক্ষর।আমরা দেখলাম, গোটা পাহাড় বৈচিত্র্যময় বাতিতে সুসজ্জিত হল। পাহাড়ের তলদেশে ৪০০০ বর্গ মিটারেরও বড় আয়তনের একটি প্রদর্শনী এলাকা ।গোটা প্রদর্শনী এলাকা একেবারে বাতির সাগরে পরিণত হয়ে গেল।বাংলা বিভাগের বিশেজ্ঞ মহিউদিন তাহের বললেন, এটা হল তাঁর দ্বিতীয় বার লোংছিং গিরিখাত পরির্দশন। তাহের সাহেবের আপন জবানীতেই শুনুন তাঁর মন্তব্য:
তাঁর আঙ্গুলী-নির্দেশ অনুসরণ করে আমি একটি বিরাটাকারের একটি দেয়াল দেখলাম। বলাবাহুল্য এই দেয়াল বরফের তৈরী। দেয়ালের মাঝখানে একটি দরজা ।তার দুই পাশে ধবধবে শাদা দুটো স্বচ্ছ সিংহ। সিংহ দুটো দেখতে অত্যন্ত প্রাণবন্ত।ভিতরে প্রবেশ করার পথে গাদাগাদি করে লোকের ছবি তুলছিল। জনতার সংগে আমরা এই দরজার ভিতরে ঢুকলাম।ভিতরে গিয়ে সবাই হা হা করে অবাক হয়ে গেলাম। বরফের ভাস্কর্যের এক আশ্চর্য জগত!থ্যাল্যান্ডের বিরাটাকারের রাজ প্রাসাদের বরফ মূর্তি ঠিক আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে । বাম দিকে এগিয়ে গিয়ে চীনের মহা প্রাচীরের বরফ ভাষ্কর্য আমাদের নজরে পড়ল।এই বরফের ভাস্কর্যে বিরাটাকারের একটি ড্রাগন উড্ডীয়মান অবস্থায় । প্রাসাদের দু পাশে চীনের গ্রীষ্মকালীণ রাজ প্রাসাদ এবং তার সুদীর্ঘ রঙিণ করিডোর।যত দেখি, ততই যেন বরফের চারু ও কারুকলার অথৈ জলধিতে যেন হারিয়ে যাচ্ছি। হঠাত আমার কাঁধে কারো কমণীয় হাতের আলতা পরশ অনুভব করলাম।ফিরে দেখে শরমি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে।আনন্দে গলে গেলেন তিনি। শুনুন তিনি বললেন ?
তাঁর এত আনন্দের কারণ খুব সহজেই বুঝা যায়।কেননা এর আগে তিনি কোনো দিনই এই বরফের ভাস্কর্য দেখেননি।এসব দেখে তাঁর অবাক না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।তাহেব বাহেবের কাছে শুনলাম, এ সব বরফের ভাস্কর্যের মধ্যে একজন বাংলাদেশী বন্ধুর কর্ম ছিল। কিন্তু তিনি সে দিন আসেননি বলে আমরা তাঁর ভাস্কর্য খুঁজে পাইনি।আরো ভিতরে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে আমরা আরেকটি বিশ্ব-উদ্যানে প্রবেশ করলাম। প্রথমে আমাদের নজরে পড়ল ইতালির রোমান গির্জা, সিসরের পিরামিড ও স্ফিংকস। আরো সামনে যেতেই তাজমহল আমাদের দৃষ্টিগোচর হল। মনে হল আমরা সবাই দক্ষিণ এশিয়ায় উপস্থিত হলাম। দেখা গেল এই সুন্দর দৃশ্যকে ক্যামেরা-বন্দী করতে অনেক লোক ব্যস্ত। এক জন মধ্য-বয়সী পুরুষ আমাকে দেয়া সাক্ষাতকারে বললেন,
আমি প্রথম বার এই বরফ-বাতির ভাস্কর্য দেখেছি। আমি হোনান প্রদেশ থেকে এসেছি। এখানকার বরফ বাতির উত্সব সত্যি খুব সুন্দর।হারবিনের বরফ-বাতির ভাস্কর্য প্রদর্শণীর আকার নি:সন্দেহে এর চাইতে অনেক বড়।কিন্তু এখানকার তুলনায় ওখানে তাপমাত্রা অনেক নিচু। তাই এ সব ভাস্কর্য সংরক্ষণ করা হারবিনের পক্ষে কোনো ব্যাপার নয়। তবে এখানে এ সব ভাস্কর্য সংরক্ষণ করা একটু কঠিন। বরফ হচ্ছে হিমাংকেয় নীচের জগতের জিনিস। আমি বিশেষভাবে এখানে এ সব বরফের ভাস্কর্য দেখতে এসেছি।
তার পর আমরা এস্ক্যালেটরে চেপে লোংছিং গিরিখাতের শৃংগে উঠলাম।উপর থেকে গোটা প্রদর্শনী এলাকা দেখলাম সমগ্র বৈচিত্র্যময় জগত আমাদের ছোট্র দুটি চোখের মণিকোঠায় ধরা পড়ল।সময় সীমিত বলে আরো অনেক জায়গায় আমাদের যাওয়ার সংযোগ হয়নি। সে দিন আমরা অনেক ছবি তুলেছি।সে দিন উইং কমান্ডার হাসান অবিরাম শুধু আমাদের জন্যে ছবি তুললেন।
|