শাদা রঙের পাজামা পরতে পছন্দ করেন বলে পাই খু ইয়াওয়ের নাম এসেছে । তা ইয়াও জাতির বহু শাখার অন্যতম । আজ এই অনুষ্ঠানে মানচাংইয়াওচে নামে যে একটি গ্রাম দেখানো হবে , তা নিছক একটি পাইখুইয়াও গ্রাম । গ্রামে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে গ্রামবাসীরা শাদা রঙের পাজামা পরেন, তারা সবুজ পাহাড় আর বনে থাকেন , এক ধরনের আরামদায়ক জীবনযাপন করছেন ।
এই গ্রামে৪০টিরও বেশী কৃষক পরিবার আছে । সংবাদদাতা আবিস্কার করলেন , সকল গ্রামবাসীর চুল চকচকে । গ্রামের প্রধান লু ছেন চুং আমাকে বলেছেন , বিয়ে করার তিন বছর পর ইয়াও জাতির পুরুষরা চুল আর কাটে না । তারা চুল ধোয়ার জন্য শ্যাম্পু ব্যবহার করে না , মদ তৈরী করার জন্য ব্যবহার্য চাল পরিস্কার করার পানিটুকু ব্যবহার করা হয় । ফলে চুল কালো আর চকচকে হয়েছে ।
পাই খু ইয়াওয়ের নিত্য জীবনযাত্রায় মদ না থাকলে চলে না । লু ছেন চুং বলেছেন , গ্রামে প্রায় বাড়িতে বাড়িতে মদ বানানো হয় । তার বানানো চালের মদ এই অঞ্চলে প্রসিদ্ধ। সুতরাং যখন হাট বসে , তখন তিনি চালের মদ নিয়ে হাটে চলেন ।
পাহাড়ে থাকা পাই খু ইয়াওয়ের হাট বিষয়ক সংস্কৃতির নিবিড় বৈশিষ্ট্য আছে । হাট সাধারণতঃ দিনের হাট ও সান্ধ্য হাট এই দুই ধরনের হাটে বিভক্ত হয় । দিনের হাটে ক্রয়-বিক্রয় চলে আর সান্ধ্য হাটে মানুষে মানুষে আরো বেশী আদান প্রদান করা হয় । তিনি আমাকে বলেছেন , হাটে চলা আমাদের একটি সবচাইতে খুশির ব্যাপার । আমরা যখন হাটে চলি , তখন সবাই নিজের তৈরী সুন্দর পোষাক পরি । হাটে চলার জন্য বেশ কয়েক কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয় । আমরা যেমন দিনের হাট , তেমনি সান্ধ্য হাটেও চলি । সান্ধ্য হাটে তরুণ তরুণীদের আদান প্রদানের জন্য একটি স্থান যুগানো হয়।
দিনের হাটে পাই খু ইয়াও যার যার বাড়ির জিনিসপত্র , চালের মদ, শবজি , ফলমূল ইত্যাদি দেখিয়ে দেন , এই সব জিনিস বিক্রি করা যায় । তাদের সর্বান্তকরণ কথাবার্তা আর হাসিখুশিতে পুরানো বন্ধুদের কথাবার্তার আনন্দ দেখা দিয়েছে । হাটে ঘুরে ঘুরে বেড়ালে আপনি আবিস্কার করবেন , যারা এখানে এসেছেন , তারা হয়তো ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য নয় , উপরন্তু নানা পদ্ধতিতে তৃপ্তি পাওয়ার জন্যই ।
দিনের হাটের জাঁকজমকের চেয়ে সান্ধ্য হাটের আবেগ ও রোমান্টিক পরিবেশ বেশী । তরুণ -তরুণীরা সমাবেশিত হয়ে গান গাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করেন। তারা গানের মাধ্যমে একে অপরের প্রেমের অনুভুতি ব্যক্ত করেন । গান শেষে তরুণ তরুণীরা হয়তো প্রেমে পড়ে । লু ছেন চুং আর তার স্ত্রী লু সিয়াও মেই এই পদ্ধতিতে প্রেমে পড়েছেন । দশ বারো বছর আগে একটি সান্ধ্য হাটে গান গাওয়ার সময়ে তাদের পরিচয় হয়েছে এবং দুজনই তত্ক্ষনাত্ প্রেমে পড়েছেন । তার পর তারা বিয়ে করেছেন ।
এ পর্যন্ত লু সিয়াও মেইয়ের দুই সন্তান আছে । কিন্তু তিনি দেখতে আগের মতোই অল্পবয়সী আর সুন্দরী । তিনি কথা কম বলেন , গ্রামে তিনি জামা-পোষাক বানানোতে নিপূণা বলে পরিচিত । বাসায় রকমারি সৌন্দর্যময় পোষাক আছে । কখনো কখনো তিনি গ্রামে ভ্রমনে আসা পর্যটকদের দু' একটা পোষাকও বিক্রয় করেন । তবু বেশীর ভাগ সময়ে তিনি নিজের বাচ্চাদের সুন্দর পোষাকে সাজাতে পছন্দ করেন । তিনি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষারত মেয়েকে বেশ কয়েকটি নতুন পোষাক বানিয়ে দিয়েছেন।
জেনকাওসু পাই খু ইয়াও অধ্যুষিত এলাকার এক জাতের গাছ । এটা পাই খু ইয়াও পোষাক তৈরীর এক ধরনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য । আশ্চর্য এই যে , পাই খু ইয়াও লোকেরা যত জনবহুল ও রীতি-নীতি প্রাচীন অঞ্চলে থাকেন , এই ধরনের গাছ ততই বড় ও মোটা । এই ধরনের গাছ অন্য স্থানে স্থানান্তরিত করার জন্য কেউ কেউ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন , কিন্তু অবশেষে তা ব্যর্থ হয়েছে । এই ধরনের গাছ হয়তো শুধু পাই খু ইয়াওয়ের ভাষা বুঝতে পারে , পরিচিত আওয়াজ শুনতে না পারলে তাদের বেড়ে যাওয়ার শর্তও নেই । এই পর্যন্ত উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের দিক থেকে এই ধরনের গাছের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক নামও খুঁজে বের করতে পারেন নি ।
লু সিয়াও মেই আর তার সংগীরা গাছ থেকে যে গাছের আঠা সংগ্রহ করে , তা মাখনের সংগে মিশিয়ে কাপড় রঙ করার জন্য এক ধরনের কাঁচামাল তৈরী করা হয় । পাই খু ইয়াওয়ের এক জোড়া স্কার্ট তৈরী করার জন্য তিরিশাধিক ধরনের কাজ সম্পন্ন করা দরকার ।
যখন আবহাওয়া চমত্কার , তখন গ্রামের নারীরা নদীর তীরে গিয়ে এক দিকে কাপড়-চোপড় কাচেন , অন্য দিকে কথাবার্তা বলেন । গ্রামে আর অমুখের বাসায় যা যা হয়েছে , এই সব তথ্য এখান থেকে বাইরে সম্প্রচার করা যায় । ওখানে কাপড়-চোপড় কাচা এক ধরনের মাধ্যম , আসলে অনেকে তাকে একটি প্রীতি-সম্মিলনী বলে মনে করেন ।
সমাজ বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছেন যে , পাই খু ইয়াও আবাসিক এলাকায় মাতৃ-শাসিত সমাজ থেকে পিতৃ-শাসিত সমাজের দিকে উত্তরণের সংকেত ও তথ্য এখনো অবশিষ্ট আছে । সুতরাং সমাজের বিভিন্ন মহলের প্রচেষ্টায় পাই খু ইয়াও অধ্যুষিত এলাকায় একটি প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ যাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে , যাতে এখানকার স্ববৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আচার ব্যবহার সংরক্ষণ করা যায় । লু ছেন চুং আমাকে বলেছেন , পাই খু ইয়াওয়ের লোকসংখ্যা শুধু ৩০ হাজারের একটু বেশী । তাদের বেশীর ভাগই আশেপাশের গ্রামে থাকেন । এখন বেশীর ভাগ পর্যটক এখানে ভ্রমণ করতে আসতে পছন্দ করেন । পাই খু ইয়াওয়ের বহু অল্পবয়সীরাও চাকরি করার জন্য বাইরে গেছেন । গত কয়েক শতকে স্থায়ী আচার ব্যবহার অনিবার্যভাবে দূর হয়ে যাচ্ছে , কিন্তু কোনো কোনো রীতি-নীতি এখনো সংরক্ষিত আছে ।
|