৬৫ বছর বয়স্ক লিউশিন পেইচিং মহা-নগরের ছাও ইয়াং ডিস্ট্রিক্টের একজন সাধারণ অধিবাসী। অবসর নেয়ার পর তিনি বাড়িতে প্রযুক্তিগত পদ্ধতিতে পানি বাঁচানোর চেষ্টায় রত হন। বাড়ির প্রতিটি পানির কল আর ফ্লাশ টয়লেটকে তিনি পানি বাঁচানোর উপযোগী করে তোলেন। জীবনযাত্রায় তিনি পানি বাঁচানোর অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন এবং তা প্রতিবেশীদের সংগে মিলে ভোগ করেন। তিনি বলেছেন, পানি বাঁচানোর তাত্পর্য শুধু নিজের বাড়ির টাকা বাঁচানো নয়, তার চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ তাত্পর্য হলো পানি সম্পদ বাঁচানো।
পেইচিংয়ে লিউ শিনের মত যথাসাধ্য প্রচেষ্টায় পানি বাঁচানোর কাজে রত নাগরিক কিন্তু কম নন। লিউ শিনের বাড়িতে যে পানিতে শাকসবজি বা চাল ধোঁয়া হয়, ধোঁয়ার পরও সে পানি ফেলে না দিয়ে বরং ফুল-গাছে ছিটানো হয়। তাঁর পুনঃসংযোজনের ফলে ফ্লাশ টয়লেটে প্রতিবারে ব্যবহৃত পানি আগের চেয়ে তিন ভাগের দুই ভাগ কমেছে। আগে তিন মাসে বাড়িতে ৭০ টন পানি ব্যবহৃত হত, এখন ব্যবহৃত হয় ৫০ টনেরও কম। লিউ শিন বলেছেন:
"পানি খুব মূল্যবান সম্পদ, তা শুধু টাকা-পয়সার ব্যাপার নয়। পানি বাঁচানোর আরো গুরুত্বপূর্ণ তাত্পর্য হলো সীমিত পানি সম্পদকে সুরক্ষা করা। পানি আমাদের বাঁচার প্রয়োজনীয় শর্ত। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে, প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষা করতে হয়। পানি বাঁচানো খুব দরকার এবং এই ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব আছে।"
চীনে পানির অভাব আছে এমন শহরগুলোর মধ্যে পেইচিংয়ের অবস্থান সর্বাগ্রে।মাথাপিছু পানি সম্পদের পরিমান মাত্র ৩০০ ঘনমিটার, তা গোটা চীনের মাথাপিছু পরিমানের আট ভাগের এক ভাগেরও কম, এবং পৃথিবীর মাথাপিছু পরিমানের ত্রিশ ভাগের এক ভাগেরও কম। এক কোটি ত্রিশ লক্ষ লোকসংখ্যা বিশিষ্ট মহা-নগরের পক্ষে এই পরিমান পানিসম্পদ খুবই অপর্যাপ্ত। তাতে সাধারণ নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা একমত যে, বিজ্ঞানসম্মত ও প্রযুক্তিগত পদ্ধতিতে পানি বাঁচানোই হলো পেইচিং শহরের ধারাবাহিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের অবশ্যম্ভাবী পথ।
গত কয়েক বছরে পেইচিং পৌর সরকার পানি বাঁচানোর বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে, যেমন গবেষনা চালিয়ে পানি বাঁচানোর উপযোগী পানির কল উদ্ভাবন করে তা প্রতিটি পরিবারে বিনামূল্যে স্থাপন করা হয়েছে সাধারান ফ্লাশ টয়লেটকে পুনর্সংযোজিত করে পানি বাঁচানোর উপযোগী ফ্লাশ টয়লেটে পরিবর্তিত করে তা সারা শহরে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে। সংগে সংগে গোটা সমাজে পানি বাঁচানো সম্পর্কে ব্যাপকভাবে প্রচার চালিয়ে জীবনযাত্রা ও শিল্পে ব্যবহৃত পানির পুনব্যবহারের হার উন্নত করা হয়েছে।
পেইচিংয়ের বিখ্যাত ছাং আন রাস্তায় অবস্থিত "ছাং ফেং" ছুটি হোটেল একটি চার তারা হোটেল। এই হোটেলের ভূ-গর্ভে দ্বিতীয় তলায় দূষিত পানি পরিশোধনের একটি বিশেষ ব্যবস্থা আছে। অতিথিদের থাকার ঘরগুলো থেকে সৃষ্ট দূষিত পানি এখানে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শোধন করা হয় এবং তারপর ফ্লাশ টয়লেটে ব্যবহারের জন্য তা আবার অতিথিদের থাকার ঘরগুলোতে পাঠানো হয়। বাস্তবতা থেকে প্রমানিত হয়েছে যে, এই পানি পরিশোধন ব্যবস্থা হোটেলের জন্য আশাপ্রদ ফলপ্রসূতা বয়ে এনেছে। গত এক বছর এই ব্যবস্থার সাহায্যে ৩০ হাজার টনেরও বেশী দূষিত পানি শোধন করা হয়েছে। তা এই হোটেলের সারা বছর ব্যবহৃত পানির পরিমানের ২৩ শতাংশ, হোটেলের জন্য প্রায় ২ লক্ষ রেনমিনপি বাঁচানো হয়েছে। এই হোটেলের পানি পরিশোধন বিষয়ক কর্মকর্তা লি ওয়েই ফিং বলেছেন:
"এই হোটেল নির্মানের সময়েই ১০ লক্ষ রেনমিনপি পুঁজি বিনিয়োগ করে এই পানি পরিশোধন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। আমরা অতিথিদের থাকার প্রতিটি ঘরের হাত ধোয়া আর গোসল করার যাবতীয় দূষিত পানি ভূগর্ভের দ্বিত্বীয় তলার পানি পরিশোধন ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে পরিশোধন করি এবং শোধনের পার তা আবার ব্যবহৃত হয়।"
আরো পানি বাঁচানোর জন্য হোটেলের প্রতিটি অতিথি ঘরের স্নানাগারে পানি বাঁচানোর উপযোগী পানির কল বসানো হয়েছে।এই ধরনের কল থেকে বেরিয়ে আসা পানির বেগমাত্রা সাধারন কলের মতো,কিন্তু ৭০ শতাংশ পানি বাঁচানে যায়।
পেইচিং চীনের পানি সংকটকবলিত গুরুতর অভাব গ্রস্ত শহরগুলোর মধ্যে একটি মাত্র। বর্তমানে গোটা চীনে পানি সম্পদের ভীষণ অভাব, মাথাপিছু পানির পরিমান বিশ্বের গড়পড়তা মাথাপিছু পরিমানের মাত্র একচতুর্থাংশ। তার উপর পানি সম্পদের বিন্যাসও ভারসাম্যহীন এবং পানি দূষণের সমস্যাও বেশ গুরুতর । অনেক শহরের পানির অভাবগ্রস্ত অঞ্চলের পরিধিও সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে, পানির অভাবের সমস্যা দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে। পানি সম্পদের অভাব ইতিমধ্যে চীনের অর্থনৈতিক ও সমাজিক টেকসই উন্নয়নে বাধাদানকারী একটি গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এজন্য চীন সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সম্প্রতি পানি বাঁচানো সংক্রান্ত একটি বিশেষ সম্মেলনে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে পানি বাঁচানোর উপযোগী প্রযুক্তি আর পণ্যের ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বিরাট প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়েছে। নতুন নির্মিত, পুনর্নির্মিত ও সম্প্রসারিত যাবতীয় গন-স্থাপত্য কর্মে পানি বাঁচানোর মানদন্ডের নাগাল-পাওয়া পানি ব্যবহারের পন্যাদি ব্যবহার করতে হবে। বর্তমান ঘরবাড়ীগুলোতে ব্যবহার করা পানি বাঁচানোর মানদন্ডের নাগাল-পাওয়া যাবতীয় পানি ব্যবহারের পন্যদ্রব্যগুলোকে ২০০৫ সালের মধ্যে বদলাতে হবে। চীনের জাতীয় উন্নয়ন বিকাশ ও সংস্কার কমিটি শহরের পানি বাঁচানো আর সমুদ্রের পানি ব্যবহারের হাইটেকের শিল্পায়নের কাজও চালাবে।
চীনের জলসেচ মন্ত্রণালয়ের জলসম্পদ বিভাগের উপ-প্রধান,চীনের পানি সংরক্ষণ কার্যালয়ের উপ-প্রধান কুও মেং জুও বলেছেন, পানি বাঁচানোর প্রযুক্তি প্রচারের সংগে সংগে অর্থনৈতিক উপায়ে পানি বাঁচানো ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হবে।তিনি বলেছেন:
"চীনের পানির অভাবের সমস্যা মোকাবেলায় পানি বাঁচানো আর পানি সম্পদের কার্যকরী ব্যবহার হলো সর্বপ্রধান ব্যবস্থা এবং পানি সম্পদের সুবন্টন বাস্তবায়নের পূর্ব-শর্ত ও চাবি কাঠি। চীনের লোকসংখ্যার বৃদ্ধি অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়ন এবং নগরায়ন ও শিল্পায়নের গতিবৃদ্ধির সংগে সংগে পানির চাহিদা আরো বাড়বে, পানির সরবরাহ ও চাহিদা সমন্বিত করে, প্রধানতঃ অর্থনৈতিক উপায়ে পানি বাঁচানোর ব্যবস্থা গড়ে তুলবো এবং অব্যাহতভাবে পানি সম্পদ ব্যবহারের কার্যকরিতা ও ফলপ্রসূতা বাড়িয়ে চলবো।"
এখন চীনে গোটা সমাজে এই ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে যে, পানি সম্পদের অভাবের সমস্যা প্রশমিত করা আর পানি সরবরাহের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার সব চেয়ে কার্যকর উপায় হলো সার্বিকভাবে প্রযুক্তিগত উপায়ে পানি বাঁচানো। সংগে সংগে সার্বিকভাবে আইনগত,অর্থনীতিগত,প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত উপায় প্রয়োগ করে কড়াকড়িভাবে পানি বাঁচানোর ব্যবস্থা গড়ে তোলা, পানি বাঁচানোর উপযোগী-পন্যাদির ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলা,যুক্তিসঙ্গত পানির দামের ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং পানি বাঁচানো ত্বরান্বিত করা।
|