ফুযৌ চীনের ফুচিয়েন প্রদেশের রাজধানী ।এই শহরে অনেক দেখার মতো জায়গা আছে।গুসান নামে একটি পাহাড় এই শহরের পূর্ব উপকন্ঠে অবস্থিত।এই ছোট পাহাড়ে ইয়াংশিয়েন নামক একটি মন্দির আছে বলে পাহাড়টির সুনাম আছে। এ পাহাড়ের মধ্য অংশে এই মন্দির অবস্থিত।একটি কিংবদন্তীতে বলা হয়েছে যে জায়গায় এখন ইয়াংশিয়েন মন্দির অবস্থিত সে জায়গা একটি অগাধ পুকুর ছিল।একটি বিষাক্ত ড্রাগন এই পুকুর দখল করে মাঝে মাঝে নিরীহ মানুষের উপর আক্রমণ করে থাকতো।চীনের থাং রাজবংশের আমলে ইয়াংশিয়েন মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।মন্দিরে এখন যে ফলক ঝুঁলানো হয় তাতে বড় অক্ষের " ইয়াংশিয়েন মন্দির" লেখা আছে।জানা গেছে এ তিনটি চীনা অক্ষর হল চীনের ছিং রাজবংশের সম্রাট থ্যাংশির অভিলেখন।এখানে বিশেষ উল্লেখ্য যে, বাংলা বিভাগের নতুন কর্মী লি লু জন্ম ফুযৌ শহরে এবং তিনি সেখানেই বড় হন।চীনের ঐতিহ্যিক উত্সব---বসন্ত উত্সবে তিনি ছুটি নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন।
ইয়াংশিয়েন মন্দির হচ্ছে চীনের হানজাতি অধ্যুষিত এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। এখানে প্রত্যেক দিন কেবল দেশী-বিদেশী পূজা পালনকারীদের ভীড়। সে দিন বাসা বাসা থেকে সকাল ৮টায় আমি বাসে চেপে ইয়াংশিয়েন মন্দিরের সামনের পাকিং লটে পৌছতে প্রায়এক ঘন্টা লাগল।তখন গুসান পার্কের বাইরের আর ভিতরে উপচে পড়া ভীড়।কোথা থেকে আমার ভ্রমণ শুরু করব তা সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা ছিল না। একটি প্রবাদে বলা হয় যে, " গ্রামবাসীরা শহরের সড়ক দেখতে আগ্রহী, শহরবাসীরা পাহাড়ের মন্দির দেখতে আগ্রহী"।অবশেষে আমি প্রধানত ইয়াংশিয়েন মন্দিরের পর্যটন লাইনেই ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বর্তমানের এই ইয়াংশিয়েন মন্দিরের আকার প্রায় মিং আর ছিং রাজবংশ আমলের মতো বজায় রাখা হয়েছে। গোটা মন্দিরে মোট ২৫টি ছোট-বড় হল আছে।পাহাড়ের ঢালুতে এ সব ছোট-বড় হল নির্মান করা হয়। চারদিকে প্রাচীন কালের গাছপালা এবং অদ্ভূত পাথরগুলো এই মন্দিরের সঙ্গেসমন্বিত হয়।এতে চীনের প্রাচীন স্থাপত্যের ঐতিহ্যিক শিল্পকলা এবং বৌদ্ধধর্মের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রীতিনীতি প্রতিফলিত হয়েছে। সুতরাং চার দিকে এত বেশী গাছপালা আছন্ন হয়ে আছে বলে এখানে উপস্থিত হলেও এই মন্দির সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টিগোচর হয় না।পর্যটকরাপাহড়ের পথে হাঁটাহাঁটি করে হোক, কেবল কারে বসে পাহাড়ের উপর যাওয়া হোকএই মন্দির পর্যটকদের নজরের বাইরে লুকিয়ে থাকে।ইয়াংশিয়েন মন্দিরের দ্বারের দু পাশের দুটো কাঠের বোর্ডেদুই লাইনের কবিতা লেখা আছে। এ দুটো কবিতা হলো " পরিষ্কারমেঝে সাফ করার কি দরকার, খোলা দরজা বন্ধ করার কি দরকার"। এ দুটো লাইনের কবিতা অত্যন্ত রসপূর্ণ।মন্দিরের গুরু ব্যাখ্যা করে বললেন,
এ দুটো কবিতার প্রগাঢ় অর্থ আছে ।বৌদ্ধ ধর্ম মনে করে , যে কোনোব্যাপার ষ্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা ঠিক নয়। " পরিষ্কার জায়গা" বৌদ্ধ ধর্মের ভাষায় বলতে " নির্মল ভূমি" বুঝায়। " খোলা দরজা" মানে বুদ্ধ ধর্ম।সুখ-দু:খ নির্বিবাদে থাকা বৌদ্ধ ধর্মের আংক্ষিত উদ্দেশ্য।গুরু আরো বলেছেন, মানুষের মন পরিষ্কার আর শান্ত হওয়ার কথা , তবে নানা ধরনের বস্ত্তু লোভের কারণে মানুষের মন দূষিত হয়েছে। এক কার্প শুদ্ধ পানি দূষিত হওয়ার পর যেমন পরিষ্কার করতে হয় ঠিক তেমনি মানুষের দূষিত মনও পরিষ্কার করা উচিত।
এই বিরাটাকারের ইয়াংশিয়েন মন্দিরে অনেক হল এবং টাওয়ার আছে।আমি সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাছিলাম। মন্দিরের ভিতরে ঢুকে দেখলাম লোকে লোকারণ্য । হলের ভিতরে পুরুষ--নারী বহু ধর্মাবিলম্বীনীরবে ধূপ জ্বালাছেন।উল্লেখ্য ধর্মালম্বীরা সাধারণত: বুদ্ধ পূজার সময়ে ধূপ জ্বালায়। এভাবে তারা সুখ জীবন , সুষ্ঠু ব্রত এবং সুখ পরিবারের জীবন কামনা করেন।
ধূপের ধূমে আমার নি:শ্বাসের দম আসে না।তাই আমি হলের বাইরে বের হলাম।বাইরের পরিষ্কার আহওয়া নি:শ্বাস নিয়ে আমার মন আলন্দে পরিপূর্ণ।আমি যে অনুভবতা পেয়েছি তা কথায় বর্ণনা করা যায় না।শ্রোতা বন্ধুরা সময় পেলে এই গুসান স্বশরীরে বেড়াতে আসেন।তবে এই বুদ্ধ ধর্মের বিখ্যাত পাহাড়ের আমেজ যাতে অনুভব করা যায়, ক্যাবল কারে না বসলে ভাল হত।একজন পর্যটক বললেন,
বর্তমানে গুসান আগের দর্শনীয়স্থান থেকে পবর্ত আরোহরণকারীদের বিনোদনের জায়গায় পরিণত হয়েছে।সাধারণত পর্বত আরোহরণকারী প্রদানত: বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা।শরীর চর্চার জন্যে তারা প্রায়ই প্রত্যেক দিন এখানে পর্বত আরোহণ করতে আসেন। প্রত্যেক শনিবার আর রবিবার অনেক লোক সপরিবার নিয়ে এখানে আসতে নিজেদের শিথিল করার জন্যে।
পাহাড়ের উপর দাড়িয়ে দূরের দিকে তালিয়ে সবুজ বনে আছন্ন পাহাড় আমার দৃষ্টগোচর হয়।দূরের আর কাছের মন্দিরগুলোর হলুদ রংয়ের টালি সবুজ গাছপালার মধ্যে চকচকে করছে।অনেক অজানা পাখিগুলো টী টী করে ডাকছে।দূরে একজন কিশোরী মায়ের হাতে ধরে পাহাড় আরোহন করছিল।আমি তাদের কাছে গিয়ে এই ছোট ছেলের সাক্ষাতকার নিলাম। সে আমাকে বলল,
আমি মাঝে মাঝে এখানে পাহাড় আরোহন করতে আসি।আমি আশা করি, পাহাড় আরোহন নতুন বছরে আমাকে মংগল এনে দেবে। এখানকার দৃশ্য খুব সুন্দর। আয়ুও ভালো।এখানে আসতে পরিবহণ অত্যন্ত সুবিধাজনক।সুতরাং আমি এখানে আসতে পছন্দ করি।
আমার অজানতে সন্ধ্যাবেলা হয়ে গেলো।তখন ইয়াংশিয়েন মন্দিরের ভিতর থেকে পর্যতকদের আঘাত-করা মংগল ঘন্টার আওয়াজ।
চীনের চন্দ্র বছরের ৩০শে ডিসেম্বর থেকে ১৫ই জানুয়ারী পযর্ন্ত গুসানে মংগল ঘন্টা আঘাত করার ঐতিহ্য আছে।
|