১৯৬৫ সালে চীনের তিব্বত স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থা চালু হয় । তখন যারা জন্ম গ্রহন করেন , তাদের বয়স ৪০ বছর পূর্ণ হয়েছে । ৪০ বছর বয়স হচ্ছে মানুষের জীবনের সোনালী সময়পর্ব ।
তেনজেন তিব্বতের দক্ষিণাংশের ইটখাজে অঞ্চলের পাইলাং জেলার একজন সাধারণ কৃষক । কয়েক বছর আগে তিনি এই অঞ্চলের জেনবা নামে প্রথম তিব্বতী খাবার তৈরীর কারখানা প্রতিষ্ঠিত করেছেন । এখন তেনজেন ও তার জেনবা তৈরীর কারখানা সম্বন্ধে আপনাদের কিছু বলা হবে ।
যদিও তখন তিব্বতে প্রচণ্ড শীত , তবু কারখানায় উত্পাদনের ব্যস্ততা আর শ্রমিকদের উদ্দীপনার পরিবেশ বিরাজ করছিল । কারখানার দরজার সামনে জেনবায় ভরা একটির পর একটি মালবাহী গাড়ি লম্বা লাইন করে দাঁড়ানো । কারখানাটিতে উত্পাদিত দ্রব্য তিব্বতের অন্যান্য অঞ্চলে পাঠানো হবে । দেখে রক্ত হিমকরা শীতে অফুরন্ত প্রান শক্তি অনুভব করা যাচ্ছিল ।
তেনজেন এই কারখানার মালিক । ত্বক শ্যামলা , মুখে হাসি লেগে আছে । দেখতে একটু লাজুক মনে হয় । আসলে তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় পারদর্শী ।
তেনজেন পাইলাং জেলায় জন্ম গ্রহন করেন । ওখানে কৃষি জমি উর্বর , বৃষ্টি প্রচুর । এই জেলা তিব্বতের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা , যেখানে প্রাচুর্যময় খাদ্যশস্য উত্পন্ন হয় । যদিও এখানকার উত্পন্ন যব উন্নত মানের জন্যে সুবিখ্যাত , তবু তেনজেনের বাড়িতে জমি ও জন শক্তি কম বলে সংসারে দারুণ অভাব দেখা দিতো। সুখে জীবন কাটানোর জন্য তেনজেন বাইরে চাকরি করতেন আর ঋণ নিয়ে ট্রাক কিনে মাল পরিবহনের ব্যবসা চালাতেন । কিন্তু এতে তার পরিবারের সংসারের আমূল পরিবর্তন হয় নি ।
পরে তেনজেন ব্যবসাও করেছিলেন । তিনি গ্রাম ও জেলায় নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য বিক্রি করতেন । কিন্তু ক্রেতাদের নগদ অর্থ কম ছিল । তারা শুধু স্থানীয় উত্পন্ন যবের বিনিময়ে নানা রকম পন্য দ্রব্য কিনতে সক্ষম । তেনজেন বলেছেন , তখন ব্যবসা চালাবার জন্য আমি কোনো নগদ অর্থ পাই নি। কারণ সবাই গরীব ছিলেন , শুধু খাদ্যের বিনিময়ে পন্য দ্রব্য পাওয়া যেতো । আমাকে নানা জায়গায় গিয়ে এই সব যব বিক্রি করতে হতো। তবু তা বিক্রি করা খুব কঠিন । বেশীর ভাগ সময়ে পরিবহনের খরচও অর্জন করা যেতো না ।
যখন তিনি যব বিক্রি করার জন্য চিন্তিত হচ্ছিলেন , তখন তিনি আবিস্কার করলেন যে , জেনবা প্রক্রিয়াকরণ শিল্প তিব্বতের কতকগুলো জায়গায় ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিলো । তিব্বতী জাতির প্রধান খাদ্য জেনবা তৈরী করার জন্য প্রথমে যব দিয়ে যবের ময়দা তৈরী করতে হয় । খাওয়ার সময়ে তার সংগে মাখন বা পানি আর চিনি মিশিয়ে জেনবা খাবার খাওয়া যায় । এখন যবের ময়দা তৈরী করার জন্য যন্ত্র ব্যবহৃত হয় ।
এই তথ্য জেনে নিয়ে তেনজেন ভাবলেন , জেনবা প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বাজারের অন্তর্নিহিত শক্তি বিরাট , তার জন্মস্থল-পাইলাং জেলায় উন্নত মানের যব উত্পন্ন হয় । জেনবা প্রক্রিয়াকরণ শিল্প এমন একটি শিল্প , যা নির্মান করার জন্য অর্থ বরাদ্দ কম আর তা দ্রুত ফলপ্রসূ হবে ।
১৯৯৯ সালে তেনজেন এই অঞ্চলে প্রথম জেনবা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা প্রতিষ্ঠিত করেছেন । তিনি তার উত্পাদিত দ্রব্যকে 'লুতেন' নামে ট্রেড মার্ক দিয়েছেন । তবু শিল্প চালানো সহজ নয় । অভিজ্ঞতা কম বলে প্রথমে তার কারখানার তৈরী জেনবা বিক্রি করা যেতো না । ফলে প্রচুর যব নষ্ট হয়েছে ।
ব্যর্থতার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা সার সংকলন করার মাধ্যমে তেনজেন সাফল্য অর্জন করেছেন । তিনি আবেগের সংগে বলেছেন , আমার মনে হয় , যাদের দৃঢ়সংকল্প আছে , তারা সফল হতে পারেন । আমাদের তৈরী জেনবা ইটখাজে বাজারে সমাদৃত হয়েছে । ক্রেতারা বলেছেন , আমাদের জেনবা যেমন সুস্বাদু, তেমনি সুগন্ধী। তখন আমি খুব উচ্ছ্বসিত হয়েছি ।
তখন থেকে তেনজেনের জেনবা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার অবস্থা অধিক থেকে অধিকতর ভালো হয়ে উঠে । উত্পাদন দ্রব্যের গুণগত মান ক্রমাগত উন্নত করার জন্য তিনি প্রক্রিয়াকরনের ব্যবস্থা , ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে গবেষনা চালিয়েছেন । তিনি নিজেই ধারাবাহিক কতকগুলো প্রক্রিয়াকরনের সরঞ্জাম ডিজাইন আর তৈরী করেছেন , এতে যেমন সরঞ্জাম কেনার জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজির সাশ্রয় হয়েছে , তেমনি উত্পাদনের ফলপ্রসূতা উন্নত হয়েছে । তেনজেন বলেছেন , যবের খোসা ছাড়ানো একটি কঠিন কাজ । ঐতিহ্যিক পদ্ধতিতে বহু সময় লাগে তার কর্ম ফলপ্রসূতাও নীচু । পরে তেনজেন অন্য ধরনের যন্ত্রপাতির ভিত্তিতে খোসা ছাড়ানোর এক ধরনের যন্ত্রপাতি আবিস্কার করেছেন । খোসা ছাড়া যব শুকানোর জন্য বাতাসের উপর নির্ভর করা হতো। বাতাস না থাকলে এই কাজ হয় না । এই সমস্যা সমাধানের জন্য তেনচেন একটি শুষ্ক করা যন্ত্র আবিস্কার করেছেন । ফলে ব্যবহারিক ফলপ্রসূতা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে ।
জেনবা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা চালিয়ে তেনজেন ধনী হয়েছেন , কিন্তু তিনি গ্রামবাসীদের ভুলে যান নি । তার কারখানায় শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা ৯০ভাগই গরীব পরিবার থেকে এসেছেন । তেনজেন সর্বাগ্রে পাইলাং জেলার কৃষকদের কাছ থেকে যব কিনেন । জেলা প্রশাসক তাওয়া তাকে খুব পছন্দ করেন । গত বছর পাইলাং জেলার মাথাপিছু গড়পড়তা আয় ছিল ১৯৭০ ইউয়ান , কিন্তু তেনজেনের কারখানার শ্রমিকদের গড়পড়তা আয় ৩৪০০ ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে ।
গত কয়েক বছরে প্রচেষ্টা চালাবার মাধ্যমে তেনচেনের কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা সত্তরে দাঁড়িয়েছে আর বার্ষিক বিক্রির মূল্য ২৩ লক্ষইউয়ান ছাড়িয়ে গেছে । তার কারখানার তৈরী লুতান মার্কার জেনবা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের লাইসেন্স পেয়েছে । তেনজেন কারখানার বিকাশের ভবিষ্যতের উপর আশাবাদী ।
বহু বছর ধরে গবেষনা চালাবার মাধ্যমে কৃষি বিজ্ঞানীরা প্রমান করেছের যে , উচ্চ রক্ত চাপ আর হৃত্পিন্ড ও রক্তশীলা রোগের চিকিত্সায় জেনবা উপকারী। অধিক থেকে অধিকতর লোকের কাছে তিব্বতী জাতির এই ঐতিহ্যিক প্রধান খাদ্য সমাদৃত হয়েছে ।
|