ইউননান প্রদেশের গ্রীষ্মকাল এমন একটি সুন্দর ঋতু , তা গাছপালা আর সূর্যের আলোতে পরিপূর্ণ । এই ঋতুতে যুগ যুগ ধরে এখানে বসবাসকারী তাই জাতির লোকেদের এই সবচাইতে জাঁকজমকপূর্ণ উত্সব- জল বিচ্ছুরণ উত্সব উদযাপন করে । বাংলাদেশের পাহাড়ী জাতিদের" পানি খেলা" উত্সবের মতো। উত্সবকালে তাই জাতির নারী ও পুরুষরা ফুল সহ পানি অন্যদের উপরে ছিটিয়ে দেয় । উত্সবে পানি , সংগীত্ ,আর হাসির আওয়াজ পরিপূর্ণভাবে বিরাজ করে । তাই জাতির পাহাড়ী গ্রাম আনন্দপূর্ণ পরিবেশে ভরপুর । তখন সুন্দরী তাই জাতির মেয়েরা লোকদের দৃষ্টি খুব আকৃষ্ট করে । কারণ তাদের মনোরম জামা পোষাক এই উত্সবকে একটি আকর্ষনীয় দৃশ্য যুগিয়ে দেয় ।
তাই জাতির লোকেরা ময়ুরকে বিশেষ ভাবে আদর করে । রুপ কথা অনুযায়ী, একজন যুবরাজ ছিলেন । বহু মেয়ে তাকে বিয়ে করতে চাইল । একদিন একজন শিকারী তাকে জানালেন , পরের দিন সাতজন সুন্দরী ময়ুর মেয়ে সাঁতার কাটার জন্য হ্রদের তীরে আসবে ।এদের মধ্যে কনিষ্ঠ মেয়ে সবচেয়ে সুন্দর । যুবরাজ যদি তার সাঁতার কাটার সময় হ্রদের তীরে তার রাখা ময়ুর পোষাক লুকিয়ে রাখেন, তাহলে মেয়েটি তার সংগে বিয়ে করবে । কথাটা শুনে যুবরাজ খুব আশ্চর্য হলেন । পরের দিন তিনি হ্রদের তীরে এলেন । তিনি সত্যি দেখলেন , সাতজন মেয়ে সাঁতার কাটল । তিনি সবচেয়ে সুন্দর মেয়েকে ভাল বেসেছেন । সেজন্য তিনি তার ময়ু পোষাক লুকিয়ে রাখলেন। অন্যান্য মেয়েরা সাঁতার শেষে পোষাক পরে ময়ুরে পরিনত হয়ে উড়ে চলে গেল। শুধু কনিষ্ঠ মেয়ে তার পোষাক খুঁজে বের করতে পারল না । এই সময় যুবরাজ তার ময়ুর পোষাক নিয়ে আসলেন । পরে এই সুন্দর ময়ু মেয়ে যুবরাজের স্ত্রীতে পরিনত হয়েছে । তারা একসাথে সুখী জীবণ কাটালেন । এই গল্প তাই জাতির অধ্যুষিত অঞ্চলে বংশপরম্পরায় জনপ্রিয় হয়েছে । তাই জাতির মেয়েদের পোষাকে এখনো ময়ুরের ছাপ দেখা যায়।
স্যুই তাই তাই জাতির একটি শাখা । তারা নদীর তীরে থাকার দরুণ এই নাম পেয়েছে । স্যুই তাইয়ের বেশী র ভাগ মেয়েরা পায়ে জুতা পরে না , তারা লুঙ্গির মতো লম্বা স্ক্যার্ট পরে । এই ধরণের স্ক্যার্ট একটি রংবেরঙের কাপড় দিয়ে বানানো হয় । তা পরিশ্রমের জন্য কোনো অসুবিধা নেই । পরনে খাটো পোষাক আর রঙবেরঙের স্ক্যার্টে সুন্দর তাই জাতির মেয়েরা আরো ছিপছিপে হয়েছে । তারা যেন বনের ময়ুরের মতো স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করে । তাই জাতির লোকেরা সুন্দরী মেয়েদের কে সোনালী ময়ু বলে মনে করে । ইউ মেন নামে মেয়েটি তাদের মধ্যে একজন । সে বলেছে , স্ক্যার্ট যে কি ভাবে পরতে হবে , তা শিখতে হবে ।
নিয়ম অনুসারে স্ক্যার্ট পরতে হলে উপর থেকে নীচে পরতে হয় । নীচ থেকে উপরে পরা নিষিদ্ধ । স্ক্যার্ট খুলতেও একই রকম । আশ্চর্য ব্যাপার এই যে , গোসল করার সময় তাই জাতির মেয়েরা ধীরে ধীরে নদীর তীর থেকে নদীর ভিতরে চলে । তারা একদিকে চলে , অন্য দিকে স্ক্যার্টটি শরীরের উপর দিকে গুটিয়ে দেয় । যখন শরীর পুরোপুরি নদীতে ডুবে যায় , তখন তাদের স্ক্যার্টও পুরোপুরি খোলা হয় । এই সময় মেয়েরা স্ক্যার্ট মাথার উপরে জড়িয়ে দেয় । গোসল শেষে তারা একই রকম উপায় ব্যবহার করে একদিকে নদীর তীরের দিকে চলে , অন্য দিকে স্ক্যার্ট পরে।
তাই জাতির অন্য একটি বড় শাখা হান তাই নামে পাহাড়ী অধিবাসীরা । স্যুই তাইয়ের পোষাকের চেয়ে হান তাইয়ের পোষাক আরো বৈচিত্র্যময় । হান তাই পোষাকের মধ্যে হুয়া ইয়াও তাই নামক পোষাক সবচাইতে সুন্দর । কালো আর লাল এই ধরনের পোষাকের প্রধান দুটো রঙ । পরনে আস্তিন আর কলার ছাড়া একটি খাটো পোষাক আছে । পোষাকের উপরে সাজানোর জন্য সূচীকর্ম ভরা । কোমরে একটি নিজের বানান রঙিন ফিতা জড়িয়ে রয়েছে । হুয়া ইয়াও তাই মেয়েরা নানা রকমের রৌপ্য অলংকারের মতো সাজানো জিনিস পরতে পছন্দ করে । যেমন হাতে চুড়ি , কানে দুল , গলায় রুপোর গয়না ইত্যাদি ।
মাদাম ইয়াং ইউয়ান এমন একজন প্রফেসার , যিনি সংখ্যালঘুজাতির জামা পোষাক বিষয়ক গবেষণার কাজ করেন । তিনি বলেছেন , ইউননান প্রদেশে বহু সংখ্যালঘুজাতি সাজানোর জন্য রৌপ্য জিনিস ব্যবহার করতে পছন্দ করে ।
তাই জাতির লোকেরা চাঁদ আর তারার প্রতি খুব শ্রদ্ধা নিবেদন করে । আসলে তারা বংশের বিস্তারের উপর খুব গুরুত্ব দেয় । তাদের ধ্যানধারনা অনুযায়ী , বংশের বিস্তার যত বেশী , তত ভাল । তাই জাতির লোকেরা বিশ্বাস করে , চাঁদ দেবতা সন্তান হওয়ার কাজ পরিচালনা করে । আকাশে অসংখ্য তারাই বহু সন্তান সন্ততীর প্রতীক ।
হুয়া ইয়াও তাই মেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সুন্দরী প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে হয় । এটাই তাই জাতির যুবক যুবতীদের আদান প্রদানের এক ধরনের পদ্ধতি । মেয়েরা নিজের সবচেয়ে সুন্দর পোষাক পরে , পিঠে একটি সুন্দর ক্ষুদ্র ঝুড়ি । গ্রামের একজন মহিলার পথনির্দেশনায় তারা রাস্তায় ধীরে ধীরে হেটে চলে । রাস্তার দু'পাশের যুবকরা তাদের উপর খুব নজর রাখে। যে তরুণ মেয়েটিকে পছন্দ করে , সে তরুণ নিজের উপহার মেয়েটির ঝুড়িতে নিক্ষেপ করে । যদি মেয়েটি তরুণটিকে পছন্দ করে , তাহলে সে তার উপহার গ্রহণ করে । নইলে মেয়েটি তরূণটির উপহার ফেরত দেয় ।
মেয়েদের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় হুয়া ইয়াও তাই জাতির সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে আর তাদের সবচাইতে সুন্দর জামা পোষাক দেখা যায় । এর সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের প্রতিযোগিতায় মাধ্যমে তাই জাতির বহু যুবক যুবতী দম্পতিও হয়েছে । তাই জাতির মেয়েদের এই ধরনের অসাধারণ পোষাক দেখে একজন পর্যটক অনুভূতির সঙ্গে বলেছেন , তাদের পোষাক যে এত সুন্দর , তা দেখতে যেন একটির পর একটি কবিতার মতো । মহিলাদের এই ধরনের পোষাকই পরতে হয় । শ্রোতাবন্ধুরা তাই জাতির সুন্দরমেয়েদের দেখতে চাইলে এপ্রিল মাসে ইউননান প্রদেশে যান আর জল বিচ্ছুরণ উত্সবে যোগ দিন। এই উত্সব আসলে তাই জাতির মেয়েদের একটি সবচাইতে জাঁকজমকপূর্ণ পোষাক প্রদর্শনী ।
|