দেওন জাতির বর্তমান লোকসংখ্যা পনেরো হাজারের বেশী । তারা প্রধানত: ইউন্নান প্রদেশের লুসি জেলা ও চেনখাং জেলায় বাস করেন ।
দেওন জাতি হচ্ছে চীনের একটি বেশ প্রাচীন জাতি । দেওন জাতির ঐতিহাসিক পুস্তকে লিপিপদ্ধ রয়েছে যে, একটি চা গাছের একটি পাতা উড়ে মাটিতে পড়ার পরই দেওন জাতির পূর্বপুবুষের জন্ম হয়েছে । স্পষ্টত: দেওন জাতির সুদীর্ঘকালের চা চাষ ও চা পানের ইতিহাসের সংগে এই কিংবদন্তীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আছে । সংশ্লিষ্ট তথ্যে দেখা গেছে , প্রায় তেবো শো খৃষ্টাব্দের আগেই দেওন জাতি ইউন্নান প্রদেশের পাহাড়ী এলাকায় জমি খনন করে চাষের চাষ শুরু করেছে। চীনের প্রত্নতত্ত্ব বিদরা ইউন্নান প্রদেশের কিছু কিছু পাহাড়ী এলাকায় বিশাল চাবন আবিষ্কার করেছেন । এগুলো নাকি দেওন জাতির পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পুরাকীর্তি ।
দেওন জাতির নারীরা সাধারণত : উপরে চাইনিজ স্টাইল জ্যাকেট রুপোর তৈরী গোলাকার বা চতুর্ভূজাকার অলংকার পরেন এবং নীচে কালো ও লাল ডোরাকাটা স্কার্ট পরেন। দেওন জাতির নারীদের কোমরে ফিতা লাগানোর রীতিও প্রচলিত আছে ।
যে মেয়ের কোমরে লাগানো ফিতা যত বেশী সূক্ষম সেই মেয়েকে তত পবিশ্রমী ও বুদ্ধিমতী এবং তার মন তত সুন্দর বলে মনে করা হয়ে থাকে । তাই দেওন জাতির যুবক ও যুবতীদের মেলামেশার সময়ে যুবতীর ভালবাসা পাওয়ার জন্য যুবক প্রায়ই নিজের সূক্ষমভাবে তৈরী কোমরে লাগানোর উপযোগী জীবজন্তুর ছবি ও ফুলের ছবি সম্বলিত ফিতা নিজের প্রিয় যুবতীকে উপহার দেয় । "কোমরের ফিতা " তাই ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভালবাসার প্রতীকে পরিণত হয়েছে ।
দেওন জাতির যুবক ও যুবতীদের প্রেমের জীবন অত্যন্ত সুন্দর ও সমৃদ্ধ । দেওন জাতির যুবক যুবতীরা ভালবাসার পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে । বাবা-মা'রা কখনো হস্তক্ষেপ করেন না । সাধারনত দেওন জাতির যুবক যুবতীদের প্রেম করার দু' ধরণের উপায় আছে : একটি হচ্ছে : একদল যুবতীর সংগে একদল যুবকের গানের প্রতিযোগিতা চালানো এবং আরেকটি হচ্ছে : যুবক এককভাবে যুবতীর সংগে মেলামেশা করে । কিছুকাল প্রেমালাপ চালানোর পর যদি দুপক্ষ সত্যি সত্যিই পরস্পরকে ভালবেসে ফেলে তাহলে প্রেমিন তার প্রেমিকাকে এক প্যাকেট চা বা তামাক উপহার দেয় । যুবতী উপহারটি পাওয়ার পর তা নিজের বিছানার শিয়রে টাংগায় । বাবা-মা তা দেখে বুঝতে পারেন যে , মেয়ের পাত্র জুটেছে ।
দেওন জাতির যুবক ও যুবতীদের প্রেমকালে চা উপহার দেয়া হয়ে থাকে । বিবাহকালেও চা প্রধান উপহার হিসেবেই গণ্য । তাছাড়া আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে অতিথি হওয়ার সময়ে প্রথমে চা উপহার দেয়া হয় । তাই দেওন জাতির লোকদের মনে চার স্থান বিশেষ লক্ষনীয় ।
দেওন জাতির বয়োবৃদ্ধদের সম্মান করার উত্তম রীতি আছে । প্রতিটি উতসবের সময়ে তরুণতরুণীরা গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য নিজ বাড়ীর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবারের একাংশ তাদের দেয় । কোনো কোনো তরুণতরুণী বিনাশর্তে গ্রামের অসহায় বয়োবৃদ্ধদেরকে জমিচাষে সাহায্য করে । কোনো কোনো তরুণতরুণী তাদের নিজ বাড়ীতে থাকতেও দেয় । দেওন জাতির আরেকটি রীতি আছে । তা হচ্ছে: প্রতিটি বছরের এপ্রিল মাসে জল বিচ্ছুরণ উতসবের সময়ে তরুণতরুণীরা বয়োবৃদ্ধদের হাত-পা ধুয়ে দেয় । হাত-পা ধুয়ে দেয়ার রীতি বয়োবৃদ্ধদের প্রতি তরুণতরুণীদের সম্মান প্রদর্শনের সদগুন গড়ে তোলা এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার সম্পর্ক সমন্বিত করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে ।
দেওন জাতি অধ্যূষিত অনচলে প্রচুর বাঁশ উতপন্ন হয় । সারি সারি বাঁশগাছ আর বাঁশের ছায়াই হচ্ছে দেওন জাতির গ্রামের একটি বৈশিষ্ট । দেওন জাতির জীবনে বাঁশের ব্যবহার খুবই ব্যপক । ঘরবাড়ী বানানো ও উত্পাদনের যন্ত্রপাতি নির্মান থেকে শুরু করে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই কাঁচামাল হিসেবে বাঁশ ব্যবহার করা হয়ে থাকে ।
দক্ষিণপশ্চিম চীনে বসবাসকারী অন্য কিছু সংখ্যক সংখ্যালঘু জাতির মতো বাঁশঘর দেওন জাতির প্রধান আবাসও বটে । বাঁশঘর দোতলা হয়ে থাকে । উপরতলায় মানুষ থাকে আর নিচতলায় অব্যবহৃত নানা জিনিষপত্র রাখা হয় । দেওন জাতির আরো কিছু সংখ্যক লোকদের বাসস্থান কাছাকাছি এলাকার হানজাতির লোকদের ঘরবাড়ীর মতো ইট ও টালি তৈরী ।
১৯৪৯ সালে নয়াচীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে পর্যন্তও দেওন জাতি আদিম জীবনযাত্রার অবস্থা বজায় রেখেছে । নয়াচীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ,বিশেষ করে চীনে সংস্কার ও মুক্তদ্বার নীতি প্রবর্তনের পর , দেওন জাতির অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ হয়েছে এবং জীবনযাত্রার মানেরও অবিরাম উন্নতি হয়েছে ।
এখন দেওন জাতি অধ্যূষিত অঞ্চলে চা আর আখ একটি প্রধান স্থানীয় অবলম্বনমূলক শিলপে পরিণত হয়েছে। দেওন জাতির অনেক পরিবার অর্থকরী ফসল চাষের জন্যা হস্তচালিত ট্রাকটর প্রভৃতি কৃষি পাতিও কিনেছে ।
জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের সংগে সংগে দেওন জাতির অনেক পরিবারে টেলিভিশনসেট , রিফ্রিজ্যারেটর প্রভৃতি আধুনিক গার্হস্থ বৈদ্যুতিক সামগ্রিও হয়েছে । শুধু তাই নয় , দেওন জাতির নারীদের পোশাক আশাকও ক্রমেই আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে । ঐতিহ্যিক ধরণ ও বিশেষ শৈলপিক রীতি বজায় রাখার ভিত্তিতে দেওন জাতির নারীদের নলাকার স্কার্টের সংস্কার হয়ে আধুনিক জীবনযাত্রার সংগে ক্রমেই আরো সামঞ্জস্য সাধিত হয়েছে ।
|