"বসন্ত ও শরত্" এবং "যুদ্ধরত রাজ্যসমূহের সময়পর্বে" সামাজিক অবস্থা পশ্চিম চৌ-এর তুলনায় লক্ষণীয় উন্নতি লাভ করে । এই উন্নতির বৈশিষ্ট্য হল : এক , লৌহ আবিস্কার এবং তার ব্যবহার যা সামাজিক উত্পাদন-শক্তিকে উন্নত করে তোলে । নির্ভরযোগ্য লিখিত বিবরণ থেকে জানা যায় যে , খৃঃ পূঃ ৫১৩ সালে চিন রাজ্যের আইন একটি লৌহনির্মিত ত্রিপদপাত্রে ঢালাই করে লিখিত হয়েছিল । এ থেকে বুঝা যায় , সুদূর খৃঃ পূঃ ষষ্ট শতাব্দীতেই চীন লৌহ ঢালাইয়ের কৌশল আয়ত্ত করেছিল । এই বিবরণ যে খুবই নির্ভরযোগ্য সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয় যে , "বসন্ত ও শরত্" সময়পর্বের শোষার্ধে এবং "যুদ্ধরত রাজ্যসমূহের সময়পর্বে লৌহের ব্যবহার খুব ব্যাপক ছিল । হোপেই প্রদেশের সিংলোং জেলায় বহু পরিমাণে লৌহনির্মিত ঢালাই কাজে ব্যবহৃত ছাঁচ ভূগর্ভ থেকে পাওয়া গিয়েছে । যুদ্ধরত রাজ্যসমূহের সময়পর্বে লৌহনির্মিত যন্ত্রপাতি এবং অস্ত্রশস্ত্র হোনান প্রদেশের হুইসিয়ান জেলায় বহু কবরের মধ্যে আবিস্কৃত হয়েছে ।
লৌহ আবিস্কারের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি এবং ভাল কৃষি ও হস্তশিল্প উত্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি হতে থাকে । তার ফলে কৃষি এবং হস্তশিল্প অগ্রগতি লাভ করে এবং তা ক্রয়-বিক্রয় ক্রিয়াকলাপকে প্রাণবন্ত করে তোলে । সেই সঙ্গে রাজকুমারদের দুর্গগুলি শহর ও নগরে পরিণত হতে থাকে । যুদ্ধরত রাজ্যসমূহের সময়পর্বে দশ হাজার পরিবার বসবাসকারী শহরের সংখ্যা খুব কম ছিল না । যেমন , ছি রাজ্যের (বর্তমানকালের শানতোং প্রদেশ) রাজধানী লিনজিতে সত্তর হাজার পরিবার বাস করত । ওয়েই রাজ্যের (বর্তমানকালের হোনান প্রদেশ ) রাজপথে দিবারাত্রি যানবাহন চলাচল করত । এ সব থেকে জানা যায় আলোচ্য যুগের শ্রীবৃদ্ধি ও সঙ্গতির কথা ।
ক্রয়-বিক্রয় প্রথা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পণ্যবিনিময়ের উপায় হিসেবে মুদ্রা ব্যবহার প্রচলিত হয় । চীন দেশে মুদ্রা ব্যবহারের ইতিহাস সুদীর্ঘ । কিন্তু , যুদ্ধরত রাজ্যসমূহের সময়পর্বের আগে ব্যাপকহারে ধাতুমুদ্রার ব্যবহার প্রচলিত ছিল না । ঐ কালের বহু বাণিজ্য কেন্দ্র নিজ নিজ ধাতুমুদ্রা তৈরি করত । এই ধরণের দুই শতটির অধিক কেন্দ্রের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে ।
দুই , উত্পাদন-শক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ভূমিস্বত্বের প্রথারও পরিবর্তন হতে থাকে । পশ্চিম চৌ কাল থেকে অভিজাত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরাই সব জমির মালিকানাস্বত্ব ভোগ করছিল । জমি ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ ছিল । বসন্ত ও শরত্ সময়পর্বের মধ্যভাগ থেকে কিছু কিছু জমি অভিজাত ব্যক্তিদের কাছ থেকে নবোদিত জমিদারশ্রেণী এবং কৃষকদের নিকট হস্তান্তরিত হতে থাকে । পরবর্তী যুদ্ধরত রাজ্যসমূহের সময়পর্বে জমি ক্রয়-বিক্রয় একটি সাধারণ ঘটনারূপে পরিণত হয় । নবোদিত জমিদাশ্রেণী রাজকুমার অথবা মনত্রীদের কাছ থেকে বিরাট জমি নিয়ে তা ভূমিকর্ষকদের নিকট ইজারা দিতেন এবং তার পরিবর্তে খাজনা হিসেবে নির্দিষ্ট পরিমাণে কৃষি-উত্পাদিত দ্রব্য গ্রহণ করতেন । এই ভাবে ক্রমশঃ জমির খাজনা হিসেবে বাধ্যতামূলক বেগার প্রথার পরিবর্তে দ্রব্যদান প্রথা প্রচলিত হয় । জমির খাজনা প্রথার এই পরিবর্তনের ফলে ভূমিকর্ষকদের উপর ভূস্বামীদের কর্তৃত্ব বহুলাংশে দুর্বল হয়ে পড়ে ।
তিন , উত্পাদন-শক্তির মানোন্নতি কেবলমাত্র ভূমিস্বত্বাধিকারীদের ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনে নি , তার সঙ্গে স্থানীয় অর্থনীতিক ক্ষেত্রেও সাধারণভাবে অগ্রগতি এনে দেয় । পশ্চিম চৌ -এর অধীনে সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতিক অঞ্চল ছিল ওয়েইনদী উপত্যকা । বসন্ত ও শরত্ সময়পর্বে সমগ্র পীতনদী উপত্যকা খুব সমৃদ্ধিশালী অঞ্চলে পরিণত হয় । তত্কালীন ছি (বর্তমানে শানতোং), চিন (বর্তমানে শানসী), চেং (বর্তমানে হোনান প্রদেশের মধ্যভাগ), সোং (বর্তমানে হোনান প্রদেশের পূর্বভাগ), ছিং (বর্তমান সেনসী প্রদেশ), ছু ( বর্তমান হুপেই প্রদেশ) ইত্যাদি সামন্তরাজ্যের অর্থনীতিক অবস্থা সমৃদ্ধিলাভ করে । বসন্ত ও শরত্ সময়পর্বের শেষার্ধে উ (বর্তমানকালের চিয়াংসু) , ইয়ুয়ে ( বর্তমানকালের চেচিয়াং ) রাজ্যগুলি যখন ক্ষমতা বিস্তারের জন্য পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিল । তখন ইয়াংসি নদীর নিম্ন অববাহিকা চৌ রাজবংশের অর্থনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে । প্রাচীন যুগের সংরক্ষিত বস্তু এবং পুরানিদর্শন অধ্যয়ন করে স্থানীয় অর্থনীতিক অগ্রগতি জানা যেতে পারে । পশ্চিম চৌ কালে যে সকল তাম্র-নির্মিত দ্রব্য ভূগর্ত থেকে আবিস্কৃত হয়েছে তাদের অধিকাংশই চৌ-রাজপ্রাসাদের অথবা চৌ-রাজকর্মচারীদের ব্যবহৃত জিনিস ছিল । প্রকৃতপক্ষে সামন্ত রাজাদের ব্যবহৃত ঐ জাতীয় জিনিস এখনও আবিস্কৃত হয়নি । অথচ পূর্ব চৌ সময়পর্বের প্রাপ্ত তাম্র-নির্মিতত দ্রব্যসমূহের অধিকারী ছিলেন সামন্তরাজারা । এ থেকে বসন্ত ও শরত্ সময়পর্বের সংস্কৃতি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্রমবিকাশের কথা জানা যায় ।
|