 চীনের রাজধানী পেইচিংয়ে সিহোইউয়ান নামে একটি পুরানো ও ঐতিহ্যিক বাড়ির একটি কক্ষে সাজানোর কাজ অসাধারণ , চীনের দক্ষিণাংশের বিভিন্ন সংখ্যালঘুজাতির বৈচিত্র্যময় কাপড় চোপড় আর সাজানোর জিনিসপত্রে ভরপুর । এই পোষাকের দোকানের ম্যানেজার হচ্ছে ইয়াপুসানখা নামে কিনো জাতির একজন মেয়ে , বাসার মালিক তার ছেলে বন্ধু ও তার পরিবার পরিজন ।

কিনো জাতি এমন একটি সংখ্যালঘু জাতি যার জাতির লোকসংখ্যা শুধু ২০ হাজার । তাঁরা প্রধানতঃ চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ইউননানের কিনো থানায় বাস করেন । তাহলে ছোট বেলা থেকে ওখানে বসবাসকারী ইয়াপুসানখা কি ভাবে পেইচিংয়ে বাস করছেন ? এই প্রশ্ন নিয়ে আমি তাঁর বাড়িতে গিয়েছি।

তিনি যে বাড়িতে বাস করছেন , তা পেইচিংয়ের একটি পুরানো আবাসিক এলাকায় অবস্থিত । তখন ছিলো শীত্কালের প্রথম দিক । প্রাঙ্গনে বহু গাছের পাতা ঝরে পড়ছিল । ইয়াপুসানখা একটি উপযোগী তুলার পোষাক পরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অতিথিকে হাসি মুখে স্বাগত জানালেন । তিনি লম্বা , চিকন আর সুন্দরী । অতিথিকে স্বাগত জানিয়ে তাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন । আসলে সে দিন পেইচিংয়ে বেশী ঠান্ডা ছিল না , সূর্যের আলো উজ্জ্বল । এমন কি একটু গরম লাগছিল । তিনি ছোট বেলায় ইউনান প্রদেশে থাকতেন । কখনো উত্তর চীনের শীত অনুভব করেন নি ।
ইয়াপুসানখা কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের
ইউননান প্রদেশ থেকে যে পেইচিংয়ে এসেছেন , তার মূলে রয়েছে একটি বিস্ময়কর পরিচয় । পাঁচ বছর আগে তিনি ইউননান প্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেনীর ছাত্রী । একদিন তিনি অসাবধানে একজন ছেলের ক্যামেরায় বন্দী হলেন । ফলে একটি বিস্ময়কর প্রেমের কাহিনী শুরু হয়েছে । সে দিন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজার সা
 
মনে সহপাঠীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম । আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিফোর্ম নেই । সবাই নিজের জাতীয় পোষাক পরেন । তখন আমার চুল লম্বা, কোঁকড়ানো আর ত্বকও ফর্সা । বয়স মাত্র ১৮ । আমি চার দিকে তাকালাম । তিনি রাস্তার ঐ পারে দাঁড়িয়েছিলেন। সম্ভবতঃ তিনি মনে মনে আমার প্রতি খুব আকৃষ্ট হন। তিনি আমার জন্য ছবি তুলতে চাইলেন । তার পর আমার সহপাঠী আসলেন । তিনি আমার চলে যাওয়ার ভয়ে তাড়াহুড়া করে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন ।

তিনি আমাকে বললেন , তিনি আমার জন্য ছবি তুলেছেন , ওটা প্রিন্ট করে আমাকে দেবেন । কথাটা শুনে আমি খুব খুশী হয়েছি । দু'দিন পর তিনি আমাকে ছবি উপহার দিতে আসলেন । বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বেশী লোক ছিল , তিনি ছবি দেখিয়ে এক জনের পর একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন , এই ছবির মেয়েটি কে ? আপনি চেনেন? তাঁর খোঁজে দিতে পারেন? অবশেষে তিনি আমাকে খুঁজে পেয়েছেন । ফলে আমাদের পরিচয় হয়েছে , খুব আশ্চর্য ।
যে ছেলে ইয়াপুসানখার জন্য ছবি তুলেছেন , তিনি তার এখনকার পুরুষ বন্ধু থান হোন উয়ে । তিনি লম্বা , মান জাতির একজন তরুণ । তখন তিনি ছিলেন পেইচিং চলচ্চিত্র ইন্ষ্টিটিউটের আলোকচিত্র বিভাগের একজন ছাত্র । শিক্ষার বিষয় চর্চা করার জন্য তিনি ইউননানে গিয়েছিলেন। ইয়াপুসানখার সৌন্দর্য তাকে আকর্ষণ করে। ফলে তিনি ইয়াপুসানখার জন্য ছবি তুলেছেন।

থান হোন উয়ে একজন শান্ত মানুষ , তার চুল লম্বা। তার পূর্বপুরুষরা চীনের সর্বশেষ সামন্ততান্ত্রিক রাজবংশ-ছিং রাজবংশের কর্মকর্তা ছিলেন । এখন তিনি ও তার পরিবার পরিজন যে পরানো পেইচিংয়ের সিহোইউয়ান নামে বড় বাড়িতে থাকেন , তা এখন দুর্লভ । ইয়াপুসানখার সংগে তার পরিচয় প্রসংগে তিনি বলেছেন , তার জামা পোষাক পরা আর তার হাসি আমাকে আকর্ষণ করেছে । আমাদের পরিচয় হয়েছে । আমার মনে তিনি সরল আর খুবই লাবণ্যময়ী। দুজন এক সাথে থাকলে আমার কোনো চিন্তা নেই ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালিখার চার বছরে দুজন আলাদা দুই স্থানে ছিলেন ।
দুজনের মধ্যে কয়েক হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব ছিল । একে অপরকে দেখতে চাইলে ট্রেনে তিন দিন লাগতো । স্নাতক হবার পর ইয়াপুসানখা খুনমিংয়ে একটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিলেন। অর্ধেক বছর পর ছেলে বন্ধুর সমর্থনে তিনি তাঁর খুনমিংয়ে চাকরি ছেড়ে পেইচিংয়ে এসেছেন ।
গত বছরের শেষ নাগাদ দুজনের মিলন হয় । দুজন প্রেমে পড়েছেন । তারা পেইচিংয়ের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে বেড়ান । থান হোন উয়ে ইয়াপুসানখাকে নিয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখেন , ক্যামেরা নিয়ে পেইচিংয়ের ভোর ও সন্ধ্যার দৃশ্য তুলেন । ইয়াপুসানখা মনে করেন যে , দুজন যে এক সাথে জীবনযাপন করেন , তা তার ছেলেবন্ধুর তোলা ছবির মতো একই রকম সুন্দর ।
পেইচিংয়ে ইয়াপুসানখা আর চাকরির সন্ধান করেন নি। তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন । তিনি আবিস্কার করেন , অন্যরা তাঁর সংখ্যালঘুজাতির পোষাক পছন্দ করেন । সুতরাং তিনি নিজের জাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পোষাক বানানের পরিকল্পনা বিবেচনা করেছেন । কিনো জাতির অন্যান্য মহিলাদের মতো তিনি বস্ত্রবয়ন আর দর্জির কাজে পারদর্শী । তিনি নিপুণভাবে কাপড় রং করা , সূতা কাটা , বস্ত্রবয়ন , সূচীকর্ম ইত্যাদি কাজ করতে পারেন । ম্যাদাম চেন পেই নি ইয়াপুসানখার দোকানের অন্যতম নিয়মিত ক্রেতা । তিনি বলেছেন , তাঁর দোকানে গেলে আমি প্রধানতঃ স্ক্যার্ট আর অলংকার দেখি । এই সব জিনিসের মধ্যে কিনো জাতি ছাড়া অন্যান্য সংখ্যালঘুজাতিরও আছে ।
ইয়াপুসানখা যে সংখ্যালঘুজাতির পোষাক ও সাজানোর জিনিস বানান , তার ডিজাইন আর ভাবনা কল্পনা ইউননান প্রদেশের সিসুয়াংপাননা তাই জাতি স্বায়ত্ত শাসিত বিভাগের ইয়ানো নামে কিনো জাতির একটি গ্রাম থেকে এসেছে । গ্রামের আশেপাশে এখনো তাই , মিয়াও জাতি প্রভৃতি সংখ্যালঘুজাতি বাস করে । ইয়াপুসানখা বলেছেন , পেইচিংয়ে বেশী সময় থাকা সত্ত্বেও জন্মস্থলের কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে । যেমন , উঁচু উঁচু নারকেল গাছ , কাঠের বাড়িঘর , ভোর ও সন্ধ্যা বেলায় রান্না-বান্নার ধোঁয়া আর কৃষি কর্মে ব্যস্ত গ্রামবাসীরা ।

ইয়াপুসানখা আনন্দের সংগে সংবাদদাতাকে বলেছেন , দু'মাস পর বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য তিনি ও তার স্বামী ইউননানে তাঁর জন্মস্থানে যাবেন । তিনি বলেছেন , কিনো জাতি এমন একটি জাতি , যে জাতির লোকেরা অবাধে প্রেম ও বিয়ে করতে পারেন । এই ব্যাপারে কোনো বাধা নেই । বাবা মাও আমাদের প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাতে পারবেন । আমরা দুজনে চিরকাল জন্য পরস্পরকে ভাল বাসবো ।
|