বিবাহ একটি খুশির ব্যাপার আর পরিবার পরিজনের মুত্যুবরণ একটি শোর্কার্ত বিষয়। কিন্তু চীনের মধ্যাংশ ও পশ্চিমাংশের দাপাসান পাহাড় আর উলিনসান পাহাড় অঞ্চলে বসবাসকারী থুচা জাতির অবস্থা তো ঠিক অন্য রকমের। মেয়ে বিয়ে করলে বাবামা ও পরিবার পরিজনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে থাকবে, এটা একটা দুঃখের ব্যাপার। আত্মীয় স্বজনের মৃত্যুবরণে তার জীবন সুসম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করা হয়। তা উদযাপন উপলক্ষে পরিবার পরিজন আর প্রতিবেশীদের নাচ গান করতে হবে।
থুচা জাতির লোকেরা মানুষের জীবনমরণকে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করেন। নিহত আত্মীয় স্বজনের জন্য শোকাচার আয়োজনের নিয়ম হল আনন্দের সংগে মৃতদের বিদায় দেয়া।
থুচা জাতির গ্রামে যখন সানাই আর ঢোল বাজে, তখন বোঝা যায় এই গ্রামে শোকাচার আয়োজন করা হচ্ছে। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে একজন প্রবীণের পরিচালনায় সকল গ্রামবাসী বাদ্যযন্ত্র বাজায়। সংগীতের সুরের ছন্দে ছন্দে গ্রামবাসীরা একদিকে গান গায়, অন্যদিকে নাচ করে।
থুচা জাতি আনন্দময় পরিবেশে পরিপূর্ণ এই শোকাচার প্রতিবেশীদের স্নেহ ও মায়া মমতার প্রতীক। গ্রামে একজন মারা গেলে সবাই তার স্মুতির উদ্দেশ্যে আয়োজিত শোকাচারে যোগ দেয়। গ্রামবাসীরা একদিকে মৃতের প্রশংসা করে তার পরিবার পরিজনের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন, অন্যদিকে তার জীবনী থেকে অন্যদের শিক্ষা আর পরামর্শ দেন। মৃতের জন্য গাওয়া গানের সুর বৈচিত্র্যময় এবং তা আন্তরিকআর হৃদয়স্পর্শী।
থুচা জাতির মেয়েরা বিয়ের সময়ে একদিকে কাঁদে, অন্যদিকে গান গায়। এই জাতির জাঁকজমকপূর্ণ শোকাচারের তুলনায় তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে বেশ দুঃখজনক পরিবেশ বিরাজ করে।
রীতিনীতি অনুসারে বিয়ের আগে মেয়েদের কমপক্ষে সাত দিন এমন কি এক মাস ধরে কাঁদতে হয়। তারা যেমন ভাই-বোন, তেমনি আত্মীয়স্বজন আর পূর্বপুরুষদের জন্য কাঁদে। এতে তারা বিয়ের আগে তাদের মনের বেদনা ও অনুভূতি প্রকাশ করেন।
থুচা জাতির লোকদের মতে বন্ধুরা যত বেশি কাঁদে, তাদের ধনসম্পত্তি তত বেশি হতে পারে। থুচা জাতির মেয়েরা বিয়ের আগে যে কাঁদে, কেউ কেউ তাকে মেয়েদের দক্ষতা ও দয়ার প্রতীক বলে মনে করেন। কাঁদার সময়ে যারা বেশি সুন্দর কথা বলতে পারে, আর আকর্ষণীয় গান গাইতে পারে, লোকেরা তাদেরকে খুব প্রশংসা করেন। নইলে তারা তো অভিযুক্ত। সুতরাং থুচা জাতির মেয়েদের ছোট বেলা থেকে কান্না চর্চা করতে হয়।
থুচা জাতির মেয়েরা সাধারণত কান্নার সংগে সংগে গান রচনা করে। তার বেশ আকর্ষণীয় শক্তি আছে। পঞ্চাশাধিক বছর বয়স্ক ম্যাদাম ইয়াং ইং হুনান প্রদেশের পশ্চিমাংশের একটি থুচা গ্রামের অধিবাসী। তিরিষ বছরেরও বেশি সময় আগে তার বিয়ের সময় প্রসংগে তিনি বলেছেন, বিয়ের সময়ে তিনি এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কেঁদেছেন। বিয়ের সময়ে মেয়েদের কান্না থুচা জাতির বিয়ের অনুষ্ঠানের একটি প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু এবং এটা থুচা জাতির একটি অদ্বিতীয় শিল্পকলায় পরিণত হয়েছে। কান্নার সময়ে শুধু বন্ধু একাই কাঁদেন না, বরং গ্রামের সকল মেয়ে, সহপাঠি আর প্রতিবেশী তার সংগে মিলে কাঁদে। আমরা যখন ম্যাদাম ইয়াংয়ের বাসায় গিয়ে সাক্ষাত্কার নিলাম, তখন একটি মেয়ের বাড়িতে রেকর্ডার থেকে বিয়ের সময়ে মেয়েদের কান্নার গান প্রচারিত হচ্ছিল। বিয়ের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বন্ধু ও তার পাত্র শহরে গিয়ে কেনাকাটা করতে গেলেন। ম্যাদাম ইয়াং বলেছেন, যুগ বদলের সংগে সংগে মানুষের ধ্যানধারনারও পরিবর্তন হয়েছে। এখন বিয়ের আগে বন্ধুদের কান্না করা দরকার নেই। মানুষের কান্না পরিবর্তে ক্যাসেট কিনে যত দিন লাগে তত দিন রেকর্ডিং প্রচার করা যায়। তিনি মনে করেন যে, এতে যেমন ঐতিহ্য সংরক্ষন করা হয়েছে, তেমনি মেয়েদের স্বাস্থ্যও রক্ষা করা হয়েছে।
থুচা জাতির যুবক-যুবতীদের প্রেমের কোনো বাধা নেই। যুবক-যুবতীরা গান গাওয়া আর নাচ করার মাধ্যমে প্রেম করে এবং একজন প্রবীণ সাক্ষীর প্রমানে তারা বিয়ে করতে পারে। তাদের কোনো যৌতুক লাগে না।
থুচা জাতির এই সব রীতিপ্রথা ২ হাজার বছরেরও বেশি সময় পুরানো। হয়তো যুগ বিকশিত হবার সংগে সংগে এই জাতির রীতিনীতির পরিবর্তন হতে পারে। তিন্তু তারা অবশ্যই আরো বৈচিত্র্যময় পদ্ধতিতে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করবেন।
|