চীনের সংগীত মহলে কন্ঠশিল্পী লিউ হুয়ান এক রহস্যময় ব্যক্তি । তবে গানের অনুষ্ঠানে তিনি কম গান করেন , দু হাজার তিন সালের নববর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক সংগীতানুষ্ঠানে লিউ হুয়ান অপেরা ' খামেনের' এক আরিয়া গেয়ে দর্শকদের বার বার করতালি জয করেছেন । গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি সময় চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন সংস্থার এক অনুষ্ঠানে লিউ হুয়ানের একটি গান দর্শকদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে । তার গলার স্বর বৈশিষ্ট্যময় , তার প্রানবন্ত ও আবেগময় গান দ্রুত দর্শক ও শ্রোতার মন জয করেছে । ১৯৮৬ সালে ' সাদা পোশাক পরা পুলিশ ' নামক এক সিরিজ নাটক অনেক দর্শক পছন্দ করেন , দর্শকরা এই নাটকের কাহিনী ও অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়ের জন্য মুগ্ধ হন , বিশেষ করে লিউ হুয়ানের গাওয়া নাটকের আবহ সংগীতের গুরু গম্ভীর ও বেদনাময় সুর দর্শকদের মর্ম স্পর্শ করেছে । তখন থেকে লিউ হুয়ান অনেক ছায়াছবি অথবা সিরিজ নাটকে গান গেয়েছেন , প্রতিটিই দর্শকদের সমাদর পেয়েছে । ১৯৯৩ সালে লিউ হুয়ান সিরিজ নাটক ' নিউইয়ক-প্রবাসী পেইচিংয়ের মানুষের' জন্য গান ও সুর রচনা করেছেন। এই সিরিজ নাটকে যুক্ত রাষ্ট্রে চীনা নাগরিকদের জীবনের সুখ-দুঃখ বর্ণনা করা হয়েছে । লিউ হুয়ান যুক্ত রাষ্ট্র ও ইউরোপের সংগীতের প্রতি তার দীর্ঘ দিনের উপলব্ধি অনুসারে এই নাটকের জন্য ' হাজার বার প্রশ্ন করি ' নামে একটি গান রচনা করেন , এই গানের আধুনিক শৈলী ও মধুর সুর চীনের সংগীতজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে , এই গান সেই বছরের শ্রেষ্ঠ গান নির্বাচিত হয়েছে , এই গানের সিডি বিক্রি হয়েছিলো দশ লক্ষের বেশী । প্রাচীন চীনের বিখ্যাত সাহিত্য রচনা ' জলের কিনারার ' ভিত্তিতে তৈরী সিরিজ নাটক ' জলের কিনারায়' লিউ হুয়ান যে ' জোয়ানের গান ' নামক একটি গান গেয়েছেন , তা এতো জনপ্রিয় হয়েছিল যে চীনের আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে মুখে গান ছড়িয়ে পড়ে । ১৯৯০ সালে চীনে এশিয় গেম্স অনুষ্ঠিত হয়েছে , লিউ হুয়ান গেম্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ' এশিয়ার জোরালো বাতাস ' নামে একটি গান গেয়েছেন , এই গান চীনের তথা গোটা এশিয়ার প্রবল শক্তি দেখিয়েছে। তখন থেকে লিউ হুয়ান চীনের বিভিন্ন বড় বড় অনুষ্ঠানে সবার স্বীকৃত শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে অনেক গান গেয়েছেন। লিউ হুয়ান সিঙ্গাপুর , জাপান , ফ্রান্স আর যুক্ত রাষ্ট্রে সফর করেছেন এবং যুক্ত রাষ্ট্র সফরকালে নিউইর্য়কের কার্নেগি মিউজিক হলে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে চীনের আধুনিক গান শুনিয়েছেন ।
গান চর্চার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে লিউ হুয়ান বলেছেন , আমি শিক্ষকের কাছ থেকে গান শিখি নি , গান আমার শখ , আমি মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময় থেকেই গান ও বাদ্যযন্ত্র পছন্দ করি , সেই সময আমি পিয়ানো ও বেহালা বাজাতে শিখেছি । ১৯৮১ সালে লিউ হুয়ান পরীক্ষার মাধ্যমে পেইচিং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইন্সটিটিউনে ভর্তি হন , এই ইন্সটিটিউটে ফরাসী ভাষা শেখার সংগে সংগে তিনি গান চর্চা শুরু করেন । ইন্সটিটিউনের রোম্যান্টিক জীবন লিউ হুয়ানের গান চর্চা ও সুর রচনার উত্স । ইন্সটিটিউটে পড়ার সময় লিউ হুয়ান ইন্সটিটিউনের একটি পিয়ানো আবিষ্কার করেছেন , এই পিয়ানো একটা খালি কক্ষে পড়েছিলো , বাজানোর কেউ ছিলো না , কাজেই দুপুর বেলার খাওয়া শেষ করে সহপাঠীরা যখন বিশ্রাম করেন , লিউ হুয়ান পিয়ানো বাজাতে যান , এই ভাবে তিনি একটানা দু বছর ধরে এক দিনও দুপুর বেলায় বিশ্রাম করেন নি । পিয়ানো ছাড়া লিউ হুয়ান গিটারও পছন্দ করেন , ইন্সটিটিউনের নাচ অনুষ্ঠানে লিউ হুয়ান বাদ্যদলের সদস্য হিসেবে গিটার বাজিয়ে সহপাঠীর জন্য সেবা করেন , তিনি সহপাঠীদের সংগে কবিতা ও গানের কথা রচনা করতে পছন্দ করেন। ইন্সটিটিউনের জীবস স্মরণ করে লিউ হুয়ান বলেছেন , ইন্সটিটিউটের জীবন আনন্দদায়ক , আমাদের কোনো চাপ ছিল না , আমাদের মাথায় শুধু স্বপ্ন ও আশা ,পড়াশুনা ছাড়া ইচ্ছামতো কাজ করতে পারি । লিউ হুয়ান সেই আমলের জীবন বর্ণনা করে বলেছেন , সেই সময় আমরা বাইরের পৃথিবী দেখি নি , ঠিক যেন একজন লোক সমুদ্র দেখেন নি , তাই এক গামলা পানিকেও সাগরের মতো বড় মনে হয় । পরে বয়স ও অভিজ্ঞতা বাড়ার সংগে সংগে নিজেই আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা দেখেছি । লিউ হুয়ান বিভিন্ন পর্যায় আর বিভিন্ন স্টাইলের গান ও সুর অধ্যয়নের প্রয়াস করেছেন , ইন্সটিটিউট থেকে স্নাতক হওয়ার প্রাক্কালে লিউ হুয়ান চীনে ফ্রান্সের দুতাবাসের উদ্যাগে অনুষ্ঠিত এক ফরাসি গানের প্রতাযোগিতায় পুরষ্কার পেয়েছেন এবং এই প্রতিযোগিতার অন্য চারজন পুরষ্কার বিজয়ীর সংগে বিনাপয়সায় ফ্রান্সে বেড়াতে গিয়েছেন ।
১৯৮৫ সালে ইন্সটিটিউটের পড়াশুনা শেষ করে লিউ হুয়ান ইন্সটিটিউটের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন , একই বছর ইন্সটিটিউট তাকে অল্প সময়ের জন্য উত্তর পশ্চিম চীনের একটি স্কুলে পাঠিয়েছে । সেখানকার জীবন কষ্টকর , লিউ হুয়ান একা পাহাড়ের উপরে উঠতে পছন্দ করেন , এটা তার নিঃসঙ্গতা দূর করার একটি উপায় । সেই সময় লিউ হুয়ান উত্তর পশ্চিম চীনের কিছু গান রচনা করেছেন । লিউ হুয়ান যখন পেইচিং ফিরে আসেন , তিনি আবিষ্কার করেছেন চীনের সংগীত মহলে প্রচুর উত্তর পশ্চিম চীনের গান প্রচলিত । তখন তিনি নিজের লেখা গানগুলো বের করেন নি , অন্য লোকের পিছনে অনুসরণ করা তার অভ্যাস নয় ।
লিউ হুয়ান যেমন চীনের ও পাশ্চাত্যের সংগীত ও গান পছন্দ করেন , তেমনি প্রাচীন ও আধিনিক কালের গানও পছন্দ করেন । গান চর্চা ছাড়া তিনি গানের কথা ও সুর রচনা করেন । তার গাওয়া গান যেমন আছে আধুনিক গান , অপেরা ও লোকসংগীত, তেমনি আছে ইংরাজী ও ফরাসী গানসহ বিদেশী গান । লিউ হুয়ান চীনের সংগীত মহলের একজন স্বীকৃত প্রতিভাবান গায়ক । লিউ হুয়ান একজন সতর্ক ব্যক্তি , তিনি সব সময় আলোক উদ্ভাসিত গান গাওয়ার মঞ্চে দাড়াতে চান না । তিনি বলেছেন , আমার ধারনা , ঘন ঘন অনুষ্ঠান করা ভালো নয় , এতে গান পরিবেশনের গুনমান ব্যাহত হবে , একজন লোকের শক্তি সীমিত , সব ধরনের গান করা অথবা সব ধরনের গানের সুর দেয়া ও কথা রচনা করা সম্ভব নয় । তিনি মনে করেন , স্ববৈশিষ্ট্যময ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেয়া একজন শিল্পীর মূল্য , মঞ্চে গান করার সময় তিনি কখনও মঞ্চে নেমে দর্শকদের সংগে করমর্দন করেন না , তিনি তা দর্শকদের তোষামোদ মনে করেন , এই ধরনের কাজ তার পক্ষে অসহনীয় । তিনি বলেছেন , দর্শক ও শিল্পী দু পক্ষই শিল্পের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এসেছেন , শিল্পের সামনে দর্শক ও কন্ঠশিল্পী সমান , সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবধান দরকার ।
লিউ হুয়ান চীনের অর্থনীতি ও বানিজ্য ইন্সটিটিউটের একজন শিক্ষক , তিনি যে পাঠ্যক্রম শিখান , তার নাম পাশ্চাত্যের সংগীতের ইতিহাস । তার ক্লাসে সব সময় ছাত্রছাত্রীর ভীড় জমে , প্রতিটি ক্লাসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা চার শ'র বেশী । লিউ হুয়ান বলেছেন , আমি শিক্ষকতার কাজ পছন্দ করি , এই ভাবে আমি সব সময় অল্পবয়সীদের সংগে থাকতে পারি এবং অবসর সময় গান চর্চা করতে পারি । এতে গান চর্চা ও রচনার ক্ষেত্রে আমার চাপ কম হবে , এটা গান রচনার পক্ষে ভালো ।
দৈনন্দিন জীবনে লিউ হুয়ান একজন রোম্যান্টিক ধরনের ব্যক্তি, দশ বারো বছর আগে তিনি তার স্ত্রীর সংগে পরিচিত হওয়ার ৯ দিন পরই বিয়ে করেছেন , এখনও তাদের পারিবারিক জীবন সুখী । লিউ হুয়ানের সবচেয়ে বড় আশা হলো স্ত্রী ও মেয়ের সংগে শান্তিপূর্ণ ও উষ্ণ পরিবেশে দীর্ঘ দিন জীবন যাপন করা ।
|