তিব্বতী অপেরা এমন এক রকমের লোক শিল্প, যা চীনের অন্যতম সংখ্যালঘুজাতি তিব্বতী জাতির মধ্যে প্রচলিত । এই অপেরায় প্রাচীন ও সরল নৃত্য আর উচ্চ কন্ঠে গান গাওয়ার মাধ্যমে তিব্বতী জাতির জনগণের দুঃখ দুর্দশা আর সুখ আনন্দের গল্প বর্ননা করা হয় । ৭ শো বছরেরও বেশী সময় আগে যখন তিব্বতী অপেরার জন্ম হয় তখন তা তিব্বতীদের জীবনযাপনের সংগে জড়িত । বহু তিব্বতী গভীরভাবে তিব্বতী অপেরা পছন্দ করেন এবং তাকে জীবনযাপনের এক অংশ বলে মনে করেন । তাঁরা তিব্বতী অপেরার প্রাণ-শক্তি অনুস্ফূর্ত করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন । তিব্বতী অপেরা প্রসংগে বলতে গেলে সর্বপ্রথমে আপনাদের থাংতুংজেপু নামে তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের এই প্রসিদ্ধ সন্ন্যাসীসম্বন্ধে কিছু বলা হবে ।
চতুর্দশ শতাব্দিতে যখন তিনি তিব্বতে একটি চেইন ব্রীজ নির্মান করছিলেন , তখন তিনি আর্থিক আর শ্রম শক্তির অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন । এই ভাবে তিনি একটি উপায় খুঁজে বের করলেন । অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনি নৃত্য সংগীতে পারদর্শী সাত জন মেয়েকে নিয়ে একটি শিল্পী দল গঠন করেছেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলে অভিনয় করার জন্য তিনি বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক গল্পের ভিত্তিতে সংগীত ও নৃত্য নাট্য রচনা করেছেন । এটাই তিব্বতী অপেরার প্রাথমিক রুপ । তাঁর এই মহান কীর্তি স্মরণ করার জন্য তিব্বতী জাতির জনগণ তাঁকে তিব্বতী অপেরার প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করেন । যেহেতু সাত জন সুন্দরী মেয়ে তিব্বতী অপেরা পরিবেশন করেছেন , সেহেতু লোকেরা তিব্বতী অপেরাকে 'আচরাম' ডাকেন । তিব্বতী ভাষায় তার অর্থ'দেবী আপা'। প্রথম দিকে তিব্বতী অপেরায় নৃত্যের মাধ্যমে সরল গল্প পরিবেশন করা হতো । তার পর লোক শিল্পীদের ক্রমাগত সমৃদ্ধিশালী আর উন্নত করার মাধ্যমে তিব্বতী অপেরা অভিনয়ের সময় গান গাওয়া আর কথাবার্তাও যোগ দেয়া হয়েছে । ফলে তিব্বতী অপেরা অদ্বিতীয় রীতিনীতি ও সংখ্যালঘুজাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অপেরায় পরিনত হয়েছে । তিব্বত স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের তিব্বতী অপেরা দলের নেতা জাসিতোজে বলেছেন , তিব্বতী অপেরার পরিপক্ক হবার পর তার খুব পূর্ণাংগতা আর ঘোর সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে । গল্পের বিষয়বস্তুর দিক থেকে তা পরিপূর্ণতার উপর খুব গুরুত্ব দেয় । তা ছাড়া তিব্বতী অপেরার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো অন্যদের লোক নৃত্য সংগীতের শ্রেষ্ঠত্ব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা । তিব্বতী অপেরায় হাস্যরসাত্মক নাটক আর প্রহসনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয় । তা ছাড়া তিব্বতী অপেরায় দর্শকদের সংগে আদান প্রদানের উপরও মনোযোগ দেয়া হয় । তিব্বতে তিব্বতী অপেরার বহু দর্শক আছেন । কিছু সংখ্যক প্রবীন শিল্পী ছাড়া বহু অল্পবয়সী ছোট বেলা থেকে তিব্বতী অপেরা দেখতে আর শিখতে পছন্দ করেন । ফলে এই পুরানো শিল্পকলা বিকাশের ব্যাপক ভবিষ্যত সম্ভাবনা আছে ।
স্লেন নামে একজন তিব্বতী এই অপেরার পাগল। যখন তাঁর বয়স ১২ , তখন তিনি তিব্বতী অপেরা শিখতে শুরু করেন । তিনি এখন লাসা শহরের একটি তিব্বতী অপেরা দলের নেতা হয়েছেন । অপেরা শেখার অভিজ্ঞতা প্রসংগে তিনি বলেছেন , তিব্বতী অপেরা শেখার সময় শিক্ষকের ব্যবস্থায় খুব কড়াকড়ি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমাকে কন্ঠশীলন করতে হতো আর তিব্বতী অপেরার পান্ডুলিপি আবৃত্তি করতে হতো । দশাধিক বছরে অধ্যবসায়ের সংগে প্রচেষ্টা চালাবার মাধ্যমে আমার আবৃত্তি করার ক্ষমতা অনেক উন্নত হয়েছে । আমার নাটক পান্ডুলিপি আবৃত্তির কন্ঠস্বর আবেগপূর্ণ । কথা বলা স্পষ্ট আর আবৃত্তির গতি দ্রুত।" স্লেন শিক্ষকের কাছে অপেরা পরিবেশনের সুর আর দৈহিক কসরতও শিখেছেন । এখন তিনি সাত আট ঘন্টা স্থায়ী তিব্বতী অপেরার নাটকের পান্ডুলিপি আবৃত্তি করতে পারেন । তিনি মঞ্চে একটানা কয়েক ঘন্টা দাঁড়িয়ে বিশ্রাম না করে অপেরার বিষয়বস্তু বর্ননা করতে পারেন । তাঁর প্রভাবে তাঁর পরিবার পরিজনও তিব্বতী অপেরা পছন্দ করেন । তাঁর মা , বড় বোন, ছোট বোন আর স্ত্রী তিব্বতী অপেরা পরিবেশন করতে পছন্দ করেন । বড় বোন , ছোট বোন আর স্ত্রী তিব্বতী অপেরা দলের মেরুদন্ডতুল্য সদস্যে পরিনত হয়েছেন । স্লেন আর তাঁর তিব্বতী অপেরা দল প্রধানতঃ প্রসিদ্ধ ঐতিহ্যিক তিব্বতী অপেরা পরিবেশন করেন । এতে কয়েক বছর আগে তিব্বতী অপেরার নিখুঁত রস জীবন্ত হয়ে উঠেছে । প্রতি বছরের আগষ্ট মাসে যখন তিব্বতী জনতা দুই খাওয়ার উত্সব পালন করেন , তখন এই তিব্বতী অপেরা দল গ্রামাঞ্চলে গিয়ে কৃষক আর পশুপালকদের জন্য বিনা খরচে তিব্বতী অপেরা পরিবেশন করেন । তাঁরা তিব্বতী জনগনকে আনন্দদেন। যেহেতু তিব্বতী জনগনের জীবনযাত্রার মধ্যে তিব্বতী অপেরার গুরুত্বপূর্ন অবস্থান আছে , সেহেতু যেখানে তিব্বতীরা বাস করেন , সেখানেই তিব্বতী অপেরা পরিবেশন করা হয় । তিব্বতী জাতির বিভিন্ন ধর্মীয় উত্সবের সংগে তার সম্পর্ক নিবিড়। এর মধ্যে তিব্বতী অপেরা আর দই খাওয়ার উত্সবের সম্পর্ক আরো গভীর । একাদশ শতক খৃষ্টাব্দে টক দুধ পান করার উত্সবের জন্ম হয় । প্রথম দিকে এটা ছিল এক ধরনের নিখুঁত ধর্মীয় ক্রীয়াকর্ম । তিব্বতী ভাষায় তার অর্থদই খাওয়ার উত্সব । এ পর্যন্ত এই উত্সবের ইতিহাস সহস্রাধিক বছর পুরানো । এই উত্সবের সংগে তিব্বতী অপেরার যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে , তা সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় । তখন প্রতি বছরের গ্রীষ্মকালেদই খাওয়ার উত্সব চলাকালে তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চলের তিব্বতী অপেরা দল লাসার মন্দিরগুলোতে গিয়ে অপেরা পরিবেশন করে । ফলে দই খাওয়ার উত্সব তিব্বতী অপেরাভিত্তিক উত্সবে পরিনত হয়েছে । সুতরাং এই উত্সব তিব্বতী অপেরা উত্সব বলেও আখ্যায়িত করা হয় । উত্সবকালে মন্দির ও পার্কে দেশী বিদেশী পর্যটকরা যেমন নিজেদের পছন্দীনীয় পন্যদ্রব্য কিনেন , তেমনি তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের সংগে এক সাথে যবের মদ পান করেন । মদ পান করার সংগে সংগে তাঁরা একদিকে খাসির মাংস খান , অন্য দিকে তিব্বতী অপেরা উপভোগ করেন । তিব্বতের বৈদেশিক সাংস্কৃতিক আদান প্রদান ক্রমাগত নিবিড় হওয়ার সংগে সংগে তিব্বতী অপেরা চীনের অন্যান্য অঞ্চল আর বিদেশী দর্শকদের কদর পেয়েছে । অভিনেত্রী পাসান তিব্বতী অপেরা দলের সংগে বহুবার বিদেশ সফর করেছেন । তিনি তিব্বতী অপেরা বিকাশের উপর আশাবাদী । তিনি বলেছেন , তিব্বতী অপেরার প্রচুর দর্শক আছে । দেশ-বিদেশে তা কদর পেয়েছে । যদিও ভাষার ব্যবধান আছে , আমরা তিব্বতী ভাষা বলি , তিব্বতী ভাষায় অপেরাও পরিবেশন করি । কিন্তু আমদের অপেরার সুর আর দৈহিক কসরতের মাধ্যমে দর্শকরা তিব্বতী অপেরা বুঝতে পারেন । সুতরাং আমরা তিব্বতী অপেরার বিকাশের উপর আশাবাদী ।
|