পেইচিং থেকে দু'শো কিলোমিটার দুরে হোপেই প্রদেশের লং হুয়া জেলায় সাত্রিশ বছর বয়সের উ রুই সিয়া চীনের একজন সাধারণ নারী, কিন্তু তাঁর নেতৃত্বএ স্থানীয় কৃষকদের লালন করা শাক সব্জীর উন্নত বীজ চীনের অনক প্রদেশে বিক্রি করা হয়েছে।
পেইচিংয়ে একটি পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে উ রুই সিয়ার সংগে আমাদের সংবাদদাতার প্রথম দেখা হয়। ধূসর রংয়ের স্যুট পরিহিত উ রুই সিয়া দেখতে খুবই স্বাস্থ্যবান, লালচে শান্ত মুখে লেগে আছে মৃদুহাসি, দারিদ্র্য মোচনে স্থানীয় কৃষকদের নেতৃত্ব দিয়ে বিশেষ কীর্তি স্থাপনের জন্য চীনের জাতীয় নারী ফেডারেশন তাঁকে আদর্শ নারীর মর্যাদা দিয়েছে।
উ রুই সিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে একটি গৃহনিমার্নে ব্যবহৃত পাথরের উপকরণ তৈরীর কারখানায় অস্থায়ীভাবে কাজ করেন, বছরখানেক পর তিনি রোং হুয়া জেলার শাক সবজি চাষের প্রযুক্তি প্রচলন কেন্দ্রে চাকরি পান, তিনি মাঝে মাঝে প্রবীন কারিগরদের সংগে পল্লীগ্রামে গিয়ে কৃষকদের উন্নত জাতের বীজ প্রজননের প্রকৌশল শিখাতেন, এই প্রসংগে তিনি বলেছেন,
"প্রথম দিকে ফসলের বীজ প্রজনন সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু কৃষকরা আমাকেও কারিগর মনে করতেন, তাই আমাকে প্রথমে প্রবীন কারিঘরদের কাছ থেকে ফসলের বীজ প্রজননের প্রকৌশল শিখে তারপর কৃষকদের শিখাতে হয়েছে।"
পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমতী উ রুই সিয়া মাসখানেকের মধ্যে ফসলের বীজ প্রজননের সাধারন কৌশলও রপ্ত করলেন, এই সব কৌশল কৃষকদের শিখাতে তিনি এক পয়সাও নেন না।
তিনি মাঝেমধে জং গুয়ান জেন গ্রামে গিয়ে শাক সব্জী চাষের কঠিন সমস্যা সমাধানে কৃষকদের সাহায্য করতেন, কৃষকদেও প্রতি তাঁর ভালোবাসা নির্মল আর গভীর, তাই কৃষকরাও তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন, কৃষকদের মধ্যে কেউ কেউ স্নেহের স্বরে তাঁকে আদুরে সিয়া বলে ডাকেন, কেউ কেউ তাঁকে শিক্ষিকা সিয়া বলে ডাকেন, সং হুয়া জেলার নারী ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ইয়ো ছিং উ রুই সিয়ার প্রশংসা করে বলেছেন:
"জং গুয়ান জেন গ্রামে উ রুই সিয়া শ্রদ্ধার পাত্রী, শিক্ষিকা উয়ের আরার খবর পেলে সবাই তাঁকে বাড়িতে ধরে নিয়ে খাওয়াতে উদ্যত হয়।
দু'হাজার সালে শাক সব্জী চাষের প্রযুক্তি প্রচলন কেন্দ্রে তাঁর বাড়িতে ফিরে যান, কৃষি উত্পাদনে যে সামান্য আয় হয় তা নিয়ে তিনি জেলা শহরের দোকান-রেস্টোরানে কাজ করেছেন, তবে তিনি কখনো শাকসব্জী চাষের কথা ভুলতে পারেন নি। তিনি লক্ষ করলেন, চীনাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার সংগে সংগে নানা ধরনের টাটকা শাকসব্জীর চাতিদাও বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু স্থানীয় বাজারে শাকসব্জীর প্রকার-বৈজিত্র্য তেমন বেশী নয়। শাকসব্জী চাষের উত্সাহ কৃষকদের আছে, কিন্তু শাকসব্জী চাষের কলাকৌশল তাঁদের জানা নেই। তাঁরা দীর্ঘকাল ধরে শুধু ভুট্টার চাষ করেন, সারা বছরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রম করে তাঁদের যে আয় হয় তা খুবই কম। সুতরাং তিনি উষ্ণাগারে শাকসব্জীর নতুন জাতের বীজ লালনের যে সিদ্ধান্ত নেন, এই সম্পর্কে তিনি বলেছেন:
"গ্রামে গিয়ে দেখলাম, কৃষকরা শুধু ভুট্টার চাষ করেন, আসলে এর চেয়ে বেশী টাকা রোজগার করার অনেক উপায় আছে।"
স্থানীয় নারী সংস্থার সমর্থনে উষ্ণাগার ভাড়া করা ও কৃষি উপকরণ কেনার জন্য উ রুই সিয়া দশ হাজার ইউয়ান ধার নেন, চীনের বসন্ত উত্সব উপলক্ষে যখন গ্রামবাসীরা উত্সব উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তিনি উষ্ণাগারে শাকসব্জীর নতুন জাতের বীজ প্রজননের কাজ শুরু করলেন:
চীনের চান্দ্রবর্ষের দ্বাদশ মাসে পড়েছে প্রচন্ড শীত। উষ্ণাগার গরম রাখার জন্য চুল্লীতে কয়লা জ্বালাতে হয়।
উ রুই সিয়ার বন্ধুবান্ধবীরা আমাদের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন যে, জীবনের কঠিন সংগ্রামে উরুই সিয়ার স্বভাব হয়েছে শক্ত আর সবল, বাধাবিঘ্নের কাছে কখনো নতি স্বীকার করেন নি, যে কোনো কাজে হাত দিক না কেন সফল না হলে তিনি কখনো হাল ছাড়েন না।
কিছু তিন পর, উষ্ণাগারের মাটি থেকে সবুজ চারা গজীয় উঠল, এক এক লাইনে এক এক প্রকারের শাকসব্জীর চারা। সতেজ সবুজ চারা দেখে তাঁর মন আনন্দে ভরে উঠল। তিনি বলেছেন:
"আমার চোখে সবুজ চারা অনেকটা শিশুর মত। চীজ বপনের দু'এক দিনপর চারা গজিয়ে বৃদ্ধিপেতে দেখে মনে মায়া-মমতা জন্মে।"
উ রুই সিয়ার একমাত্র সন্তানের বয়স বারো বছর হয়েছে, মায়ের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে না পারায় তিনি প্রায় লজ্জাবোধ করেন। তাঁর উষ্ণাগার বাড়ি থেকে তিরিশ বিলোমিটার দুরে অবস্থিত, কাজ করতে করতে সন্ধ্যা নেমে যায়, বাড়ি ফিরে যেতে না পেরে উষ্ণাগারের পাশে একটি কুঁড়ে ঘরে মাঝে মাঝে তাঁকে রাত কাটাতে হয়েছে। মন্তান দেখার ভার তিনি সম্পুর্ণ দিয়েছেন তাঁর স্বামীর উপরে।
একার শক্তি দিয়ে শাকসব্জীর উন্নত জাত প্রচলিত করা সম্ভব নয়, তাই উ রুই সিয়া আশেপাশের গ্রামের কৃষকদের তাঁর সাথে কাজ করতে উত্সাহ দেন। তিনি প্রথমে বীজ বপন করেন, চারা গজিয়ে উঠার পর কৃষকদের রোপন করতে দেন, সাইকেল চালিয়ে তিনি এক এক গ্রামে গিয়ে কৃষকদের প্রযুক্তির উপদেশ দেন। বীজ পাকা হলে তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে বীজ সংগ্রহ করেন।
কালক্রমে উ রুই সিয়ার উষ্ণাগারে শাক সবজির প্রকার সংখ্যা এক শো থেকে তিন শো চল্লিশে উন্নীত হয়েছে, তিনি প্রতিটি শাকসব্জীর ছবি তুলে ছবির পেছনে তার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য লিখে রাখেন, তাঁর দুটো বক্স এখন শাকসব্জীর ছবিগুলোতে ভরে গেছে।
উষ্ণাগার ভাড়া করার প্রথম বছরেই উ রুই সিয়ার আয় লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে, যে দশটি কৃষক পরিবার তাঁর সংগে শাকসব্জীর বীজ প্রজননের কাজ করেছেন তাদের প্রতিটির বার্ষিক আয় দু'হাজার ইউয়ান হয়েছে এবং এটা ভুট্টা চাষের চেয়ে চার গুণ বেশী। বীজ লালনে মুনাফা হয় দেখে আরো ষাটটি কৃষক পরিবার উ রুই সিয়া সংগে বীজ লালনের কাজে অংশ নিয়েছে।
তাদের মধ্যে ওয়াং ইয়া জুন নামে একজন কৃষক সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন:
"আমি লক্ষ করেছি, যারা উ রুই সিয়ার সংগে শাকসব্জীর উন্নত বীজ লালন করেছে, তারা সবাই অনেক টাকা উপার্জন করেছে, এই কথা খুবই পরিস্কার, ভুট্টা চাষের চেয়ে শাকসব্জীর উন্নত বীজ লালন থেকে অধিক আয় পাওয়া যায়। তাই এই বছর আমি ও চার একর জমির ঠিকা নিয়ে বীজ প্রজননের কাজ শুরু করেছি।"
উ রুই সিয়া ও স্থানীয় কৃষকদের লালন করা শাকসব্জীর বীজ নানা তাপমাত্রা ও আদ্রতার জায়গায় বপন করা যায় বলে এবং এর ব্যাধি প্রতিরোধক গুণ আছে বলে চীনের পেইচিং, থাংশান, শেনজেন ও তালিয়ানের বীজ ব্যবসায়ীরা তাদেও কাছে একটার পর একটা বীজ কেনা অর্ডার পাঠাচ্ছেন।
|