সাগরের সমতল উঠে আসা ও ভূভাগের ভিত্তি নেমে যাওয়ার মিলিত ভূমিকায় "পানি শহর" বলে পরিচিত ইতালির বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক শহর ভেনিস তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে । উদ্ধারকাজ আর বিলম্বিত করা যায় না ।
গত এক শো বছরে ইয়াদ্রিয়া সাগরের সমতল তেত্রিশ মিলিমিটার উঠে এসেছে । এর সংগে সংগে ভেনিস শহর প্রতি বছর গড়পড়তা পাঁচ মিলিমিটার করে নেমে যাচ্ছে । তাছাড়া প্রতি বছরের শীতকালে অবিরাম বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের প্রবল আক্রমনে ভেনিস দিনদিন গুরুতর পানির বিপর্যয়ের সম্মুখীন । শহরের কেন্দ্রস্থলের মহাচত্বর প্রতি বছর ষাটটিরও বেশী বার করে পানিতে ডুবে ডাচ্ছে । পরিবেশ বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারী জানিয়ে বলেছেন , অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে দুই হাজার পন্চাশ সালে ভেনিস শহরের অধিকাংশ ভূভাগ চিরকালের জন্যে সমুদ্রের পানিতে ডুবে যাবে ।
পুংখানুপুংখ গবেষনা ও আলাপ পরামর্শের পর ইতালি সরকার গত বছর জোয়ারের আক্রমণ প্রতিরোধ ও ভেনিস শহরকে উদ্ধারের একটি প্রকল্প অর্থাত্ "মোসি প্রকল্প" সূচিত করেছে । এই প্রকল্প অনুযায়ী , ত্রিশ মিটার লম্বা, বিশ মিটার চওড়া, পাঁচ মিটার পুরু ও দু'শো টন ভারী উনাশিটি কংক্রিটের তৈরী দেয়াল ব্যবহার করে ভেনিস শহরের সিয়েহু হ্রদের পূর্বাংশ ও ইয়াদ্রিয়া সাগরের সংযোগস্থলে প্রায় এক দশমিক দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ওঠানামা করতে পারে এমন কতকগুলো "ভাস্যমান বাঁধ" গড়ে তোলা হবে । সাধারণকালে এই সব কংক্রিটের দেয়াল সাগরের তলদেশে ডুবে থাকবে । সমুদ্রের জোয়ার এলে ঘনীভূত বায়ু পাম্পের নিয়ন্ত্রণে এই সব ভাস্যমান দেয়াল সমুদ্রের পানির উপরে ভেসে উঠে বাঁধে পরিণত হবে ।
কিন্তু এই প্রকল্পের খরচ খুবই বেশী , আনুমানিক চার বিলিয়ন ইউরো'রও বেশী , নির্মানকাল দীর্ঘ , আনুমানিক আট বছর । তার উপর প্রযুক্তি জটিল । তাই ইতালির ক্ষমতাসীন ও অক্ষমতাসীন সবার মধ্যে এই প্রস্তাব নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে । পরিবেশ কর্মীরাও প্রকল্পটি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে বলে নানান সন্দেহ প্রকাশ করেছেন । ইতালির সংবাদ মাধ্যমের চব্বিশে জুলাইয়ের একটি খবরে প্রকাশ , পাটোওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বৈজ্ঞানিক গবেষনা গ্রুপ সম্প্রতি একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছে । তারা বলেছে যে , ভূমির নীচে সমুদ্রের পানি ঢেলে দিয়ে ভেনিস শহরের নেমে যাওয়া রোধ করা যায় । এই প্রস্তাব অনুযায়ী ভেনিস শহরের ভূভাগ বর্তমান ভিত্তিতে অন্তত: ত্রিশ সেন্টিমিটার উঠে আসবে । বিশেষজ্ঞরা বলেছেন , যদিও এই ব্যবস্থা শহরের বন্যার বিপর্যয়ের হুমকি পুরোপুরি দূর করতে পারে না তবুও তাতে ভেনিস শহরের বন্যায় প্লাবিত হওয়ার সুযোগ বিরাটমাত্রায় কমবে ।
বৈজ্ঞানিক গবেষনা গ্রুপের দায়িত্বশীল ব্যক্তি , পাটোওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুসেপে গাম্পরাডি এই প্রস্তাব সম্পর্কে বলেছেন , ভেনিস শহরের ভূপৃষ্ঠের ছয় শো থেকে আট শো মিটার নীচের বিশেষ বালুকাময় মাটির স্তরে সমুদ্রের পানি ঢেলে দিতে হবে ,যাতে বালুকাময় মাটি নরম হয়ে গিয়ে স্ফীত হয় এবং এভাবে শহরের ভূমির ভিত্তি উন্নত হয় । গবেষনা গ্রুপ আরো মনে করে , ভূতাত্ত্বিক গঠনের বিশেষত্ব বিবেচনা করে প্রতি বছর মাটির নীচে প্রায় এক দশমিক আট কোটি ঘনমিটার পানি ঢেলে দিতে হবে । একটানা দশ বছর ঢালার পরই কেবল বাস্তব সফলতা পাওয়া যাবে । কিন্তু তিনি বলেছেন , বর্তমানে এই চিন্তা-ভাবনা শুধু তত্ত্বের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ । তা পরবর্তিকালের বাস্তব অনুশীলন-সাপেক্ষ ।
অধ্যাপক গাম্পরাডির অনুমান , এই প্রকল্পের খরচ হবে প্রায় আশি কোটি ইউরো । তিনি আশা করেন , এই প্রকল্প "মোসি প্রকল্পের"সংগে একত্রে এই বিখ্যাত শহরকে রক্ষা করতে পারবে । ভেনিস শহর কর্তৃপক্ষ এই প্রস্তাবের প্রতি খুবই বিরাট উত্সাহ দেখিয়েছেন ।
|