পেইচিং সময় দুই হাজার চার সালের ১লা জুলাই দুপুরে "কাসিনি" নামক নভোযান সাফল্যের সংগে শনিগ্রহের কক্ষপথে প্রবেশ করে । সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহের চারদিকে প্রথমবারের মতো একটি কৃত্রিম "উপগ্রহ"দেখা দেয় । "কাসিনি" নামক নভোযানটির পযবেক্ষণ এ পযর্ন্ত প্রবতির্ত জটিলতম গ্রহ পযবেক্ষণ পরিকল্পনা বলে মনে করা হচ্ছে । নভোযানটির অন্তত: চার বছরের নিকট ব্যবধান থেকে পযবেক্ষণ শুধু শনিগ্রহ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকদের উপলব্ধিই গভীরতর করবে না , বরং পৃথিবী ও জীবনের রহস্য উদ্ঘাটনের পক্ষেও সহায়ক ।
শনিগ্রহকে বৈজ্ঞানিকরা আদরের সংগে সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহের মধ্যেকার "রিংরাজ" বলে অভিহিত করেন । সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকেই ইতালির বিখ্যাত পন্ডিত প্রথমবারের মতো দূরবীন দিয়ে শনিগ্রহ পযবেক্ষণ করেন । কিন্তু তিনি বুঝতে পারতেন না যে , কেন বিভিন্ন সময়ে রাত্রিবেলার আকাশে শনিগ্রহের বিভিন্ন আকৃতি পরিলক্ষিত হয় । তিনি উপলব্ধি করতে পারেন নি যে , সেই বিভিন্ন আকৃতি হলো বিভিন্ন দিক থেকে দেখা শনিগ্রহের রিং । তিনি বরং এই প্রবনতাকে শনিগ্রহের ভেতর থেকে গজিয়ে উঠা এবং তারপর অদৃশ্য হওয়া "বাহু"-র উপমা দিয়েছেন । প্রায় অধর্শতাব্দী পর নেদারল্যান্ডের জ্যোতিবির্দ হুইগেন্স পযবেক্ষণ করে শনিগ্রহের রিংয়ের তত্ত্ব উত্থাপন করেন । পরে ইতালীয়ান বংশোদ্ভূত ফ্রান্সের বৈজ্ঞানিক কাসিনি প্রমুখ এই তত্ত্বকে সপ্রমাণ করেন ।
গত কয়েক শো বছরে প্রযুক্তির উন্নতির সংগে সংগে বৈজ্ঞানিকরা শনিগ্রহ পযবেক্ষণের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অজর্ন করেন । সৌরজগতের গ্রহগুলোর গঠন গবেষণা ইত্যাদি ক্ষেত্রে শনিগ্রহের মূল্যও ক্রমেই প্রকট হয় । শনিগ্রহজগত নিদির্ষ্ট মাত্রায় অনেকটা "ছোটো সৌরজগতের" মতো । সৌরজগত গড়ে উঠার প্রথমদিকে সূয গ্যাস ও ধূলিকণার গোলক-বেষ্টিত ছিলো । ঠিক এই গ্যাস ও ধূলিকণার গোলকগুলোর মধ্যেই বিভিন্ন গ্রহের জন্ম বলে মনে করা হয় । বৈজ্ঞানিকরা বলেছেন , শনিগ্রহ ও তার সুন্দর রিং প্রথমদিকের সূয ও তার চারদিকের গ্যাস ও ধূলিকণা গবেষণার মডেলে পরিণত হতে পারে । শনিগ্রহের অনেকগুলো উপগ্রহ পযবেক্ষণ করে গভীরভাবে সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহের বিবতর্নের প্রক্রিয়া বোঝার জন্য মূল্যবান তথ্যাদি পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে ।
এ পযর্ন্ত আমরা যত দূর জানি ,শনিগ্রহের একত্রিশটি উপগ্রহ আছে । সেগুলোর রাসায়নিক ,ভূতাত্ত্বিক ও বায়ুমন্ডলীয় ইত্যাদির গঠনের সমৃদ্ধ বৈশিষ্ট্য আছে । পরিকল্পনা অনুসারে "কাসিনি"নামক নভোযানটি চার বছরে ছিয়াত্তরবার শনিগ্রহ প্রদক্ষিণ করবে এবং বাহান্নবার শনিগ্রহের সাতটি উপগ্রহের সন্নিকটে পৌঁছুবে । এর মধ্যে শনিগ্রহের বৃহত্তম উপগ্রহ অথার্ত্ ছয় নাম্বার উপগ্রহ পযবেক্ষণ বিশেষ প্রত্যাশা করবার মতো । "কাসিনি"নামক নভোযানটি চার বছরে পঁয়তাল্লিশবার শনিগ্রহের ছয় নাম্বার উপগ্রহ অতিক্রম করবে এবং তার ভূপৃষ্ঠে "হুইগেন্স" নামক প্রোব্ নিক্ষেপ করবে ।
বিজ্ঞান ক্ষেত্রে পৃথিবীর জীবনের উত্পত্তি এখনও একটি রহস্য । ব্যাপকভাবে মনে করা হয় যে , বোধ হয় তথাকথিত "অরিজিন্যাল সূপ"নামে একধরণের পদার্থের সংগে জটিল কাবাইর্ড মিশে যাওয়ার পর পৃথিবীর জীবনের সৃষ্টি হয়েছে । কিন্তু বৈজ্ঞানিকরা প্রথমদিকের পৃথিবীর রাসায়নিক পরিবেশ সম্পর্কে কিছুই জানেন না । জানেন না জীবনের উত্পত্তির সময়ে পৃথিবীতে কি কি কাঁচা উপকরণ ছিলো । "কাসিনি"আর "হুইগেন্সের"শনিগ্রহের ছয় নাম্বার উপগ্রহ পযবেক্ষণ বৈজ্ঞানিকদের এই প্রশ্নের উত্তর পেতে সাহায্য করবে ।
শনিগ্রহের ছয় নাম্বার উপগ্রহের আকার বুধগ্রহ ও প্লুটোগ্রহের চেয়েও বড় । তার রয়েছে নাইট্রোজেন ও মিথেন-সমৃদ্ধ ঘন বায়ুমন্ডল । সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ ও তাদের উপগ্রহগুলোর মধ্যে শুধু পৃথিবী ও শনিগ্রহের ছয় নাম্বার উপগ্রহের বায়ুমন্ডলে নাইট্রোজেন মিশে আছে । প্রথমদিকের পৃথিবীতে বোধ হয় বিপুল পরিমাণ মিথেনের মতো হাইড্রোকাবর্ন ছিলো বলে অনুমান করা হচ্ছে । বৈজ্ঞানিকরা বলেছেন ,শনিগ্রহের ছয় নাম্বার উপগ্রহে সম্ভবত:অনেক রাসায়নিক মিশ্রিত পদার্থ হিমায়িত করা আছে এবং কিছু অনুরূপ রাসায়নিক মিশ্রিত পদার্থ সম্ভবত:জীবনের উত্পত্তির আগেই পৃথিবীতে বিদ্যমান । এমন কি কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক মনে করেন ,"কাসিনি"ও "হুইগেন্সের"পযবেক্ষণের ফলাফলে দেখা যাবে ,প্রথমদিকের পৃথিবীর সংগে বতর্মান পৃথিবীর চেয়ে শনিগ্রহের ছয় নাম্বার উপগ্রহের সাদৃশ্য বেশী । ইউরোপের মহাশূন্য ব্যুরোর "হুইগেন্স" প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক বলেছেন , শনিগ্রহের ছয় নাম্বার উপগ্রহ পযবেক্ষণ অনেকটা "চার বিলিয়ন বছর আগেকার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার" মতো ।
|