পেইচিংয়ের উত্তর পশ্চিম উপকন্ঠের একটি ফ্লাটবাড়িতে বাস করছেন ৮৯ বছর বয়সী একজন বিদেশী । তিনি চীনা নাগরিতকত্ব পেয়েছেন । তাঁর নাম ইসরাইল এপস্টেইন ।তিনি বলেছেন, ১৯১৫ সালে পোল্যান্ডে এপস্টেইনের জন্ম । ১৯১৭ সালে দু বছর বয়সী এপস্টেইন তাঁর মাবাবার সংগে চীনে আসেন । ছোটো বেলায় তিনি উত্তর চীনের বন্দর তিয়ান জিন শহরে বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন । তখন চীন ছিল একটি আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক দেশ । তিয়ান জিনের মত চীনের গুরুত্বপুর্ণ বন্দরে বৃটেন , ফ্রান্স ,জাপান প্রভৃতি উপনিবেশবাদী দেশের ইজারাকৃত এলাকা ছিল । ইজারাকৃত এলাকার কোনো ব্যাপারে চীন সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারত না । ইজারাকৃত এলাকার বাইরেও বিদেশীরা চীনাদেরকে লাঞ্ছনা করত , এমন দৃশ্য মাঝে মাঝে তাঁর চোখে পড়ত । চীনাদের দু:খদুদর্শা দেখে কিশোর এপস্টেইনের মনে গভীর সহানুভুতি জাগত ।
১৯৩১ সালে এপস্টেইন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে সাংবাদিক হিসেবে ইংরাজ পত্রিকার " বেইচিং অ্যান্ড টিয়েনজিন টাইমসের জন্য কাজ করতে শুরু করেন । বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে চীনে জাপানী আক্রমনের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সুত্রপাত ঘটে ।তাঁর সমবয়সী চীনা তরুণ- তরুণীরা দলে দলে যে জাপানী হামলা বিরোধী দেশপ্রেমিক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন তা দেখে এপস্টেইনের মনে ন্যায্যতাবোধ জাগ্রত হয় । একজন সত্ সাংবাদিক হিসেবে তিনি কয়েকটি প্রগতিশীল পত্রিকার জন্য প্রবন্ধ লিখে চীনা জনগণের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের ন্যায়সংগত সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানান । তখনকার দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেছেন :১৯৩৪ সাল ও ১৯৩৫ সালে আমি দুটো সাময়িকী তথা সাংহাইয়ের ভয়েস অফ চায়না এবং বেইচিংয়ের ডেমোক্রেসির জন্য প্রবন্ধ লিখি কখনো ছদ্মনাম ,কখনো আসল নাম ব্যাবহার করে ।
১৯৩৭ সালে জাপান যখন চীনের বিস্তীর্ন অঞ্চলে হামলা চালায় তখন এপস্টেইন ছিলেন ইউনাইটেড প্রেসের সাংবাদিক । যুদ্ধ বাঁধার পর এপস্টেইন তার লেখা রিপোর্টে জাপানের বর্বরোচিত হামলার নিন্দা করেন এবং চীন নিশ্চয় বিজয় লাভ করবে বলে আস্থা প্রকাশ করেন । কিন্তু ইউনাইটেড প্রেস চীনের পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগে তাঁকে বরখাস্ত করে ।
ঠিক তখনই চীনের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মহান অগ্রণী ডক্টর সান ইয়াট সেনের বিধবা স্ত্রী সং ছিং লিন চীন রক্ষা সঙঘ গঠন করেন । এই সঙঘ জাপানের আক্রমন বিরোধী সংগ্রামে নিয়োজিত চীনা সৈন্যবাহিনীকে ঔষুধ , চিকিত্সার সরঞ্জাম ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করত । ১৯৩৮ সালে এপস্টেইন চীন রক্ষা সঙঘে যোগ দান করেন এবং আন্তর্জাতিক প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন । চীনা জনগণ ও সৈন্যবাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধের উপরে তিনি বহু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ।
মাদাম সং ছিং লিনের সংগে পরিচিত হওয়ার পর এপস্টেইন হয়েছেন তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধূ ।তাঁদের বন্ধুত্ব স্থায়ী ছিল চল্লিশাধিক বছর । আজ থেকে তেইশ বছর আগে মাদাম সং ছিং লিন মৃত্যু বরন করেছেন । কিন্তু তাঁর স্নেহময় মুখ এখনো স্পশ্টই এপস্টেইনের মনে আছে। এপস্টেইন বলেছেন : মাদাম সং ছিং লিন ছিলেন একজন অসাধারন নারী , সহকর্মী হোক ,বন্ধু হোক , সমাজের উপরের স্তরের লোক হোক, বা নীচু স্তরের লোক হোক, তাঁদের সমানচোখে দেখতেন তিনি।
মাদাম সং ছিং লিনের প্রভাবে এপস্টেইন সোত্সাহে চীনা জনগণের জাপানী হামলা বিরোধী সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেন । ১৯৪৪ সালে চীন ও বিদেশের সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে এপস্টেইন কুও মিং তাং সরকারের সৃষ্ট বাধা অতিক্রম করে ইয়ান আনে গিয়ে খবরাখবর ও রিপোর্ট লিখেন ।তখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অফিস ইয়ান আনে ছিল । সেখানে তিনি সম্পুর্ণ আলাদা একটি চীন দেখতে পান । তিনি মাও সে তং , চৌ এন লাই , জু দে প্রমুখ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বিখ্যাত নেতাদের সাক্ষাত্কার নেন । তাঁর লেখা রিপোর্টে বলা হয়েছে , মাও সে তং কথাবার্তায় অত্যন্ত রসিক , তিনি গভীরভাবে সমস্যা বিশ্লেষন করতে পারেন , যা বলেছেন তা আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে । নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার জন্য এপস্টেইন যে বিশাধিক প্রবন্ধ লিখেছে সেগুলোতে মার্কিন জনগনের সামনে চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বে চীনা জনগণের নির্ভীক সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ।
১৯৫১ সালে চীন সরকারের প্রচার বিভাগ চায়না রেকন্সট্রাক্টস নামক ইংরাজী ভাষার সাময়িকী প্রকাশের প্রস্তুতি নেয় ।মাদাম সং ছিং লিনের আমন্ত্রনে এপস্টেইন ও তাঁর স্ত্রী চোলমেলেই এই সাময়িকী প্রকাশে সাহায্য করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনে আসেন এবং এই সাময়িকীর সম্পাদক নিযুক্ত হন
চায়না রেকন্সট্রাক্টস যাতে সময় মত প্রকাশিত হয় তার জন্য এপস্টেইন ও তাঁর স্ত্রী রাতদিন কাজ করেছিলেন ।তিনি বলেছেন :তখন পেইচিংয়ে বিদেশী ভাষার ছাপাখানা ছিল না , দ্বিমাসিক চায়না রেকন্সট্রাক্টস মুদ্রিত হত এক হাজার কিলোমিটার দুরের সাংহাই শহরে ।তাই তাঁদেরকে দুমাসে একবার করে সাংহাইয়ে গিয়ে প্রবন্ধগুলোর প্রুফ সংশোধন করতে হত ।
১৯৫৭ সালে এপস্টেইন চীনা নাগরিকত্ব পান । চীনা নাগরিক হিসেবে তিনি আরো বেশী উত্সাহে প্রচার কাজে আত্মনিয়োগ করেন । চার বার তিববতে গিয়ে সাত আট শো জনের সাক্ষাত্কার নেয়ার পর তিনি তিববতের বিবর্তন নামে যে একটি গবেষণামুলক গ্রন্থ প্রকাশ করেন তা দেশবিদেশে সমাদৃত হয়েছে ।তা ছাড়া এপস্টেইনের লেখা চীনের গণ যুদ্ধ , চীনের অসমাপ্ত বিপ্লব , আফিম যুদ্ধ থেকে চীনের মুক্তি , সং ছিং লিন - বিংশ শতাব্দীর মহান নারীও পরপর প্রকাশিত হয়েছে।
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে এপস্টেইন চায়না রেকন্সট্রাক্টসের প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন । ১৯৯০ সালে এই সাময়িকীর নতুন নাম হয়েছে চায়না টুডেই । নববইয়ের দশকের শেষ দিকে তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন । কিন্তু তিনি আগের মত প্রতিদিন ব্যস্ত । তিনি চীনের রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের সদস্য , সং ছিং লিন তহবিলের পরিষদের সদস্য , চীনের সমাজ কল্যান সমিতির কার্যনিবাহী সদস্য। চীনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা অত্যন্ত প্রগাঢ় , তিনি গভীর আবেগের সংগে বলেছেন : আমি চীনকে ভালোবাসি , চীনা জনগনকে ভালোবাসি , চীন আমার বাড়ি , নির্মল ভালোবাসাই চীনের ভাগ্যের সংগে আমার জীবনকে সংযুক্ত করেছে ।
|