চীনের পশ্চিমাংশের ছিনহাই-তিব্বত মালভূমি আর তার আশেপাশের অঞ্চলগুলো হচ্ছে তিব্বতী জাতি- অধ্যুষিত এলাকা । এই বিস্তীর্ণ এলাকায় যেমন বরফে ঢাকা পর্বত , নদ-নদীর উত্পত্তিস্থল প্রভৃতি প্রাকৃতিক দৃশ্য, তেমনি তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্ম মন্দিরও আছে । তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্ম মন্দির পরিদর্শন করলে তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতির রহস্য ও মহত্ব অনুভব করা যায় ।
উত্তর-পশ্চিম চীনের কানসু প্রদেশের রাজধানী লানচৌ শহরের ১ শো কিলোমিটারেরও বেশী দক্ষিণে অবস্থিত সড়কের পাশে একটি বিরাট মন্দির চোখে পড়ে । ঝকঝকে এই মন্দির পাহাড়ের পাদদেশ আর নদীর ধারে নির্মিত। মন্দিরটি প্রচুর সোনালী ভবন আর প্যাগোডা নিয়ে গঠিত। জাঁকজমকপূর্ণ এই মন্দিরই তো লাবলেন মন্দির ।
লাবলেন মন্দির চীনের তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম প্রসিদ্ধ মন্দির । তা ১৭০৯ সালে নির্মিত হয়েছে এবং উত্তর পশ্চিম চীনের তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র আর সর্বোচ্চ বৌদ্ধ ধর্ম ইনস্টিটিউট। উপাসনা করার জন্য তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সারা বছর নিরন্তর এই মন্দিরে আসেন । মন্দিরে সন্ন্যাসীদের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার । যখন সংবাদদাতা মন্দিরের দরজার সামনে এলেন , তখন মন্দিরে পর্যটক খুব কম ছিল , শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল । বাইরে কয়েকজন লামা কথাবার্তা বলছিলেন । সংবাদদাতার আগমন তাদের খুব ভাল লাগল ।
মন্দিরের একজন অল্পবয়সী লামা সংবাদদাতাকে স্বাগত জানালেন । তার নাম জাসিচাছু । তিনি একাগ্রচিত্তে এই মন্দির সম্বন্ধে অনেক কিছু বর্ননা করলেন । তাতে তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কৃতির মহত্ব দেখা দিয়েছে । জাসির পরিচালনায় সংবাদদাতা লাবলেন মন্দিরের চিকিত্সা ইন্স্টিটিউটে পৌঁছলেন । এটা এমন একটা ইন্স্টিটিউট , যেখানে তিব্বতের চিকিত্সা পদ্ধতি ও ঔষুধ নিয়ে গবেষণা করা হয় । তিনি বলেছেন , লাবলেন মন্দিরে মোট ছ'টি ইন্স্টিটিউট আছে , তিন ভবন নিয়ে একটি ইন্স্টিটিউট গঠিত । সামনের ভবন ছাত্রদের পরীক্ষা দেয়ার স্থান , মাঝ খানের ভবনে ছাত্রদের ক্লাসরুম আর পেছনের ভবন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনার জায়গা । মেডিক্যাল কলেজের প্রধান কর্তব্য তিব্বতী চিকিত্সা পদ্ধতি আর ঔষুধ নিয়ে গবেষণার কাজ চালানো । এই কলেজে মোট ১৩০ জনেরও বেশী ছাত্র আছে । তারা এখানে ছ' বছর পড়ে । কলেজটি একটি সরল প্রাঙ্গন । ভবনের জানালার উপরে কালো পরদা টাঙানো হয় । এটা দেখতে খুব রহস্যময় মনে হয় । জাসি বলেছেন , তিব্বতী ঔষুধ তৈরী আর রোগীদের চিকিত্সা করার জন্য মেডিক্যাল কলেজের লামারা প্রতি বছর পাহাড়ে গিয়ে বনৌষধি সংগ্রহ করে ।
যখন সংবাদদাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ফিরে এলেন , তখন বিকেল পাঁচটা বেজেছে । মন্দিরের সোনালী ছাদের উপরে সোনালী সূর্যের আলো ঝকঝক করছিলো । তিব্বতী বাড়ি ঘরের সাদা , লাল আর হলুদ রঙের দেয়াল নীল আকাশের নীচে আরো মনোরম হয়ে উঠেছে । চারুকলা কলেজের বহু ছাত্র প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে চিত্রাংকন চর্চা করছিল । রঙবেরংয়ের ছবি তাদের হাতে একটির পর একটি মন্দির হয়ে উঠেছে । এখনকার বৈচিত্রময় রঙ সত্যি চিত্রশিল্পীদের স্বর্গ ।
লাবলেন মন্দিরে বৃহত্তম বৌদ্ধ ভবন সোনালী টালী বিশিষ্ট ভবন । ভবনের ছাদের উপরে যে সব টালী বসানো হয়েছে , সে সব টালী তৈরী করার জন্য এক শো কিলোগ্রামেরও বেশী সোনা ব্যবহার হয়েছে । ভিতরে বহু ধর্মাবলম্বীরা উপাসনা করছিল । বুদ্ধের প্রতি তারা যে এত অনুগত আর শ্রদ্ধা বিগলিত যে, উপাসনার সময় তাদের দেহ ও মাথা আরেকটু হলে মাটি স্পর্শ করতো । বুদ্ধের প্রতি এটাই তাদের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ শ্রদ্ধা নিবেদনের অনুষ্ঠান । এই সব ধর্মাবলম্বীর মধ্যে সংবাদদাতা তিব্বতী লম্বা পোষাক পরা একজন অল্পবয়সী নারীকে দেখলেন । তার দুটো চুলের বিনুনি আছে , মুখে গম্ভীর আর দারুণ শ্রদ্ধার ছাপ । তিনি ভবনে খুব অনুগতভাবে উপাসনা করলেন । ভবনে কেউ কেউ দ্রুতবেগে চলতে চলতে উপাসনা করছিলের । এটা হল উপাসনার এক ধরনের পদ্ধতি । জানা গেছে , ভবনে তাদের কমপক্ষে ৩ হাজারবার প্রদক্ষিণ করার কথা । প্রবল কৌতুহলের আকর্ষণে সংবাদদাতাও তাদের সংগে একবার ঘুরে আসলেন। কয়েকজন লামা সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে সংবাদদাতাকে শুভেচ্ছা জানালেন । বোধ হয় তারা খুব শান্ত ছিলেন ।
লাবলেন মন্দির এমন একটি কলেজ , যেখানে সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধ ধর্মের জ্ঞান অর্জন করতে পারে । মন্দিরের শিল্পকলা প্রসংগে জাসি বলেছেন, লাবলেন মন্দিরে তিনটি ধরনের মূল্যবান শিল্পকলা আছে : দেয়াল চিত্র , মাখন ফুল আর রঙিণ বালি দিয়ে তৈরী হস্তশিল্প। এর মধ্যে শেষের দ্রব্যটা মন্দিরে ধর্মক্রিয়া চালাবার সময়ই প্রস্তুত হয় । এটা তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের এক ধরনের দেয়ালচিত্র , হান জাতির দেয়াল চিত্রের সংগে চেয়ে তার তফাত আছে ।
মন্দিরেরজীবিত বুদ্ধতেওয়াছান লম্বা, কৃষ্ণকায়, দেখতে খুব স্বাস্থ্যবান। তিনি মন্দিরটি প্রসংগে বলেছেন , লাবলেন মন্দির চীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি সংরক্ষণ ইউনিট । প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক মন্দিরে আসেন। তারা মন্দিরের মূল্যবান পুরাকীর্তির উপর খুব গুরুত্ব দেন । এখানে প্রতিবছর বিরাটাকারের ধর্মীয় আচারনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । বেশীর ভাগ সময়ে সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধ ধর্মের গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন ।
মন্দির থেকে চলে যাওয়ার সময় সংবাদদাতা দেখলেন , লামারা মন্দিরের সামনের পাহাড়ের দিকে বসে আছেন । বোধ হয় বনভোজন আয়োজন করা হচ্ছিল । পথপ্রদর্শক জাসি বলেছেন , বিরতির সময়ে সন্ন্যাসীরা বেরিয়ে এসে এখানে বিশ্রাম করেন । ফিরে আসার সময় সংবাদদাতা একজন প্রৌঢ় সন্ন্যাসী তুজুয়ানইননিয়েনের সংগে দেখা করলেন । তার বয়স চল্লিশাধিক, এখন মন্দিরের শিক্ষকে পরিনত হয়েছেন । তিনি বলেছেন, মন্দিরে ছাত্রাবাসেটেলিফোন ও কম্পিউটার আছে । ছাত্ররা মোবাইফোন ব্যবহার করে । মন্দিরটির এই বিস্তীর্ণ জায়গায় গভীর আর বিস্ময়কর অনুভূতি বিরাজ করে ।
|