আজকের চলো না ঘরে আসি বিশেষ অনুষ্ঠানে সুযৌ শহরের বিখ্যাত মন্দির---হ্যানসান মন্দিরের কিছু পরিচয় তুলে ধরবো।চীনে যাদের প্রাথমিক ইস্কুলের শিক্ষার জ্ঞান আছে তারা সুযৌ শহরের হ্যানসান মন্দির সম্বন্ধে ভালোভাবে জানেন। চীনের প্রাথমিক ইস্কুলের পাঠ্য বইতে হ্যাসান মন্দির সম্বন্ধে এক হাজারেরও বেশি বছরের আগের চীনের থাং রাজবংশের বিখ্যাত কবি জেন চির লেখা কবিতা সংগৃহীত হয়েছে।তার কবিতা হলো: "পশ্চিম আকাশে ডুবে যাচ্ছে চাঁদ, শীতকালের আকাশ কাকের ডাকে মুখরিত।নদীর পাশের ম্যাপল গাছ আর নদীতে মাছ-ধরা নৌকায় উজ্জ্বলআলো দেখে মন বিষন্ন হয়, ঘুম আসে না।রাত দুপুরে সুযৌ শহরের উপকন্ঠের বিখ্যাত হ্যাসান মন্দির থেকে ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে আমার যাত্রীবাহী জাহাজে।" দীর্ঘকাল ধরে চীনের অজস্র লোক এই কবিতার মাধ্যমে হ্যাসান মন্দির সম্বন্ধে জেনে ফেলেছেন।কবিতায় এই মন্দির সম্বন্ধে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।এই মন্দিরের সুন্দর চেহারা নিজের চোখে দেখার জন্য দেশ-বিদেশী পর্যটকরা সুযৌতে জড়ো হন।
সুযৌ শহরের কেন্দ্র স্থান থেকে পশ্চিম দিকে গেলে একটি ছোট নদী মানুষের চোখে পড়ে। হ্যানসান মন্দির ঠিক এই নদীর তীরে অবস্থিত ।হ্যানসান মন্দির হলো।বৌদ্ধ ধর্মের একটি মন্দির।এই মন্দিরের ইতিহাস ১৪০০ বছরের বেশী দীর্ঘ।মন্দিরের দরজা পশ্চিম দিকে খোলা থাকে।এই মন্দির দশ হাজার বর্গ কিলোমিটারের আয়তন অধিকার করে।মন্দিরের প্রধান হলঘরে বৌদ্ধ ধমের প্রতিষ্ঠাতা লুলাই বৌদ্ধের মূর্তি স্থাপিত আছে।এই বৌদ্ধ মূর্তির দুই পাশে স্থাপিতআটজন আহ্যাটের মূর্তি। তাদের নানা ধরনের ভংগীমা। মন্দিরের প্রধান হলের দু পাশে দুটো বড় আকারের ধন্টা বসানো হয়।প্রত্যেক নব বর্ষ উপলক্ষে লোকেরা এই মন্দিরে ঘন্টার আওয়াজ শুনতে যায়, যাতে দু:খ, উদবেগ, দুশ্চিন্তা,দুর্ভোগ দূর করা যায় এবং সুন্দর ভবিষ্যত কামনা করা যায়।হ্যাসান মন্দির প্রসংগে বিভিন্ন ধারণা আছে।তবে এমন একটি ধারণা সবসময় লোক মুখে প্রচলিত আছে।সে প্রসংগে গাইড টেনটেন ব্যাখ্যা করে বলেছেন,
কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে, অনেক অনেক দিন আগে হ্যানসান আর সিদে নামে দুজন সন্যাসী এই মন্দিরে থাকতেন।দুজনই এই মন্দিরে পরিচালনা করতেন।কিন্তু ব্যাপার হলো এই যে, যখন কোনো ব্যাপার নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন দুজনের মধ্যে কেউই দায়িত্ব নিতে চাইতেন না।এক দিন মন্দিরের সামনে একজন বৃদ্ধার সংগে দুজনের দেখা হল।এই বৃদ্ধা দু জনকে বললেন, যে লোক মন্দিরপারিচালনা করেন সাধারনত: তার জাদুর ক্ষমতা থাকা উচিত।এখন তোমাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দিতা চালাতে হবে।তারপর মন্দিরের নাম এবং এই মন্দিরের পরিচালক স্থিরকরবো ।তার কথা শেষ করে বৃদ্ধা মন্দিরের সামনের নদীর দিকে লক্ষ্য করে বললেন, দেখুন না এই নদীর উপর সেতু নেই।স্থানীয় লোকেরা যাতায়াত করলে ফেরির উপর নির্ভর করতে হয়।এটা স্থানীয় লোকেদের পক্ষে খুব কষ্টকর।এখন আপনারা দুজন নিজ নিজ জাদু ব্যবহার করে একটি সেতু বানিয়ে দিন।দেখি কার যোগ্যতা বেশী ? বৃদ্ধার কথা শেষ হতে না হাতে সিদে তার জাদু দেখাতে শুরু করেন।তিনি গায়ের কোর্ট খুলে নদীতে ছুঁড়ে দিলেন।সংগে সংগে নদীর উপরে একটি সেতু দেখা দিল। কিন্তুদু:খের ব্যাপার হলো, তিনি যে সেতু বানিয়েছেন তার স্তম্ভ নেই।তাই যে কোনো মহুর্তে সেতুটি ধসে পড়তে পারে।হ্যাসান শীঘ্রই হাতের লাঠি নদীতে স্থাপন করলেন। তার যাদুতে সংগে সংগে তা একটি গাছে পরিণত হয়েছে ।গাছটা নদীর বিপরীত পাশের দিকে পৌছে গিয়ে একটি সেতু স্থিতিশীলভাবে নদীর উপরে বসানো হয়।দু জন সন্যাসীর জন্য যে বৃদ্ধা প্রশ্ন তুলেছেন তিনি হাসতে হাসতে বললেন, আমার মনে হয় দু জনের মধ্যে হ্যাসানের যোগ্যতা বেশী।তারপর হ্যাসান নামে সন্যাসী এই মন্দিরের পরিচালক হয়ে গেছেন ।তখন থেকে এই মন্দিরের নাম হচ্ছে হ্যাসান মন্দির। সেই লাঠি ম্যাপল গাছের তৈরী বলে সেতুটিকে নি:সন্দেহে ম্যাপল সেতু বলে ডাকা হয়।চীনের ছোট বড় মন্দিরগুলোর মধ্যে সন্যাসীর নাম দিয়ে মন্দির নাম রাখা হয়েছে এমন মন্দির আর নেই।এ পর্যন্ত হ্যানসান মন্দিরে হ্যানসান আর সিদে দু জন সন্যাসীর মূর্তি আছে।তারা দুজন খালি পায়ে আর বুক ফুলিয়ে হাসি মুখে বসে আছেন। তাদেরকে দেখে মনে হয় যেন দুজন দুষ্ট ছেলে । একজনের হাতে সাপলা ফূল , আরেকজনের হাতে একটি থালা ধরা আছে ।কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে, তাদের গুরু মৃত্যু বরন করার আগে এ দুটো জিনিস তাদের দিয়েছেন। গুরুটি তাদের বলেছেন, তাদের পরষ্পরের সংগে সহবস্থানে থাকা উচিত।হ্যানসান আর সিদে পরবর্তীকালের সন্যাসীদের জন্য ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সুতরাং তাদের কাহিনীর আলোকে এই মন্দির গত হাজার বছরে ভালভাবে সংরক্ষিত হয়েছে।আজকে এই মন্দিরে সন্যাসীরা পর্যটকদের সংগে সহাবস্থান করেন।গুওহন নামে সন্যাসী হ্যানসেন মন্দিরে ১২ বছর ধরে আছেন।সংবাদদাতার সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন,
এ বছর আমার বয়স ৫৮।বর্তমানে তার মতো সন্যাসি পাঁচ ছয় জন আছেন। সবচেয়ে বয়স্ক জনের বয়েস ৮৪, যার নাম শিনখং মাস্টার । কনিষ্ঠজনের বয়েস মাত্র ২০ বছর।তিনি বলেছেন, এখন ছিওশান মাষ্টার হ্যানসান মন্দিরের পরিচালক।তার বয়স ৩৮ যিনি পেইচিং বৌদ্ধ ধর্ম ইনস্টিটিউটের স্নাতক।
হ্যানসান মন্দিরের ভিতরে হেঁটে চললে আপনি ঘনঘন সাংস্কৃতিক পরিবেশ অনুভব করতে পারেন। মন্দিরের উদ্যানে একটি পাথরের করিডরে খচিত আছে বিভিন্ন রাজবংশের প্রসিদ্ধ কবিদের কবিতা।চীনে সুযোর হ্যানসান মন্দির নাম উল্লেখ করা হলে এই মন্দিরের ঘন্টার কথা না বললে চলবে না।কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে এই ঘন্টার সংগে এই মন্দিরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।এই প্রসংগে গাইডা টেনটেন বলেছেন,
কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে, এক বছর বিরাট বন্যা হয়েছিলো। সিদে কানে ভেসে যাওয়া ঘন্টা উদ্ধার করার জন্য নিখোঁজ হয়ে গেছেন।হ্যানসান ভাবছিলেন সিডে হয়তে মারা গেছেন।তাই হ্যানসান মর্মাহত হলেন।আসলে সিডে এই ঘন্টা নৌকা হিসেবে ব্যবহার করে জাপান পাড়ি দিয়েছিলেন। সুতরাং জাপানে সিডে নামে একটি মন্দির আছে । কিংবদন্তিতে বলা হয়, এর পর ঘন্টার মধ্যে হ্যানসান আর সিডের মধ্যে পারষ্পরিক চিন্তা ব্যাখ্যা করা হয়। প্রত্যেক বছরে অনেক জাপানী পর্যটক হ্যানসান মন্দির দেখতে আসেন।প্রত্যক নব বর্ষে হ্যানসান মন্দিরে ঘন্টা শ্রবন আসর আয়োজিত হয়।প্রায় সকল পর্যটক এখানকার ধন্টা বাজাতে পছন্দ করেন।
|