উত্তর চীনের অন্তর্মঙ্গোলিয়া অঞ্চলের উছুয়েন জেলায় একটি সত্যিকারের কাহিনী প্রচলিত হয়েছে যে, স্থানীয় যুবককৃষক ফান ফুশো মঙ্গোলিয়াদেশের মেয়ে জুলিয়াকে বিয়ে করে ধাপে ধাপে গাভি পালন করে ধনী হতে পেরেছেন।
আমাদের সংবাদদাতা অন্তর্মঙ্গোলিয়ার উছুয়েন জেলায় গিয়ে ফান ফুশৌর সাক্ষাত্কার নেয়ার সেই দিন ফান ফুশৌ মঙ্গোলীয় স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে মঙ্গোলিয়াদেশে আত্মীয়স্বজনদের দেখতে যাওয়ার জন্য উপহার ইত্যাদি জিনিসপত্র গুছাচ্ছিলেন । ফান ছিপছিপে সতেজস যুবক , তাঁর হাবভাব থেকে তার সরলতার প্রতিফলিত হয় । তাঁর স্ত্রী জুলিয়া হলেন মংগোলিয়ার রাজধানী উলানবাটরের অধিবাসী ,দীর্ঘ দেহী, ফর্সা , লম্বা কালো চুল, দেখতে বেশ সুন্দরী । তাঁর কোলে নাদুসসুদুস শিশু খুশীতে অবিরাম চীত্কার করছে ।
জুলিয়ার সংগে নিজের বিয়ে প্রসংগে ফান ফুশৌ বলেছেন , এটা হাজার কিলোমিটার দূরের বিবাহবন্ধন । তিনি বলেছেন, পাঁচ বছর আগে আমি উলানবাটরে মজুরি করার সময়ে কারখানার কাছে এক সেলুনে চুল কাটতে গিয়ে জুলিয়ার সংগে পরিচিত হলাম, জুলিয়া নাপিতের কাজ করতেন । অবসর সময়ে আমি জুলিয়ার সেলুনে গিয়ে তার সংগে আলাপ করতাম । প্রথম দিকে আমি মংগোলীয় ভাষা জানতাম না । জুলিয়া অনেক কাজে আমাকে সাহায্য করেছে । আড়াই বছর ধরে এমনি চললো আমাদের প্রেমের আলাপ । উলানবাটরে আমরা রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেছি । সেটা ছিলো নিছক আবুষ্ঠানিকতা । তারপর আমি জুলিয়াকে সংগে নিয়ে দেশে ফিরে ধুমধাম অনুষ্ঠান আয়োজন করেই এখানে বিয়ে করলাম।
ফান ফুশৌর বাড়ি চীনের অন্তর্মংগোলিয়ার মধ্য অঞ্চলে । সেখানে বৃষ্টি খুব কম , খরা প্রায়ই হয় ,জমি অনুর্ব্বর । স্থানীয় কৃষকরা বংশপরম্পরায় চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন । ফানফুশৌ-র পরিবার প্রায় আড়াই হেকটর জমি চাষ করে । সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করে যা ফসলের ফলন পায় তাতে আয় হয় শুধু ৫ থেকে ৮ হাজার ইউয়ান বা ৭০০ মার্কিন ডলারের মতো ।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার সেই এলাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নতির জন্যে আবাদী জমিতে পুপূন: বনায়ন বা সবুজায়ন প্রকল্প কার্যকরী করেছে এবং স্থানীয় জনগণ আগেকার জীবিকার একমাত্র পদ্ধতি--জমিচাষ কমিয়ে দিয়ে অন্যান্য উপায়ে বহুমুখী অর্থনৈতিক তত্পরতা চালাতে শুরু করেছেন ।
ফান ফুশৌর পরিবারের এক হেক্টর জমিতে আবার বনায়ন বা সবুজায়ন হবে । তিনি ভেবেছেন, জমিতে ঘাস রোপন করে গরু চরাবেন , তাতে প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নতি তো হবেই,উপরন্তু দুধ বিক্রী করে আয়ও বাড়াবেন ।জুলিয়ার সংগে পরামর্শ করার পর দুজনের সব টাকা বের করে এবং ব্যাংক থেকে কিছু ঋণ নিয়ে দশটি সাদা-কালো গাই কিনে আনলেন । রোজ ফান ফুশৌ
বাইনে জমি চাষ করেন, আবার ঘাস কেটে গাইগুলোকে খাওয়ান । জুলিয়া ঘরের ভেতরে ও বাইরে তাঁকে সাহায্য করেন । তাদের আশা,জীবন আরও সুখী হোক !
জুলিয়া তার মাতৃভাষা মংগোলিয় ভাষায় বলেছেন, আমি এখানকার সব কিছু পছন্দকরি ,কারণ আমি ফার ফুশৌকে ভালবাসি । তার সংগে একত্রে আমাদের সংসার আরও সুন্দর করবো । এখানকার সবাই আমাকে ভালবাসে, শশুড়ী-শশুড়ী আর বড় বোনরা আমাকে খুব আদর-যত্ন করেন ,আমি মোটেই মনে করি না যে , আমি বিদেশিনী ।
জুলিয়া বাড়িতে সব কিছু করেন ,তিনি খুবই পরিশ্রমী । সংবাদদাতা তাদের বাড়ীতে দু ঘন্টা থাকাকালে তিনি কখনও প্যান্টের পাড় গুটিয়ে নিয়ে রবারের জুতা পরে গাইগুলোকে ঘাস আর পানি খাওয়াচ্ছেন , গাইগুলোর গোবর সাফ করছেন , দুধ দোহন করছেন,কখনও আবার রান্না ঘরে গিয়ে রান্না করতে শাশুড়ীকে সাহায্য করছেন । এতো ভালো বৌমা দেখে শাশুড়ীর আনন্দের আর সীমা নেই, ভাঁজ-পড়া মুখে লেগেই আছে হাসির ছোঁয়া ।
এতো কর্মঠ বিদেশিনী ভ্রাতৃবধূকে দেখে স্বামীর তিন জন বড় বোন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ । মেজ বোন সংবাদদাতাকে জানালেন, জুলিয়া কখনো হাত গুটিয়ে আরামে থাকতে চায় না , চটপট কাজ করতে থাকে । সেজ বোনও জুলিয়ার প্রশংসা করতে গিয়ে আর থামতে চান না ।
আমার ছোট ভাইয়ের মেজাজ অতো ভাল না । তার বউ সবকিছুতেই তাকে সুবিধা দেয়, তাকে খুবই ভালবাসে । আমাদের বাড়ির লোক বিশেষ করে মা-বাবা তাকে এতোই স্নেহ-আদর করে থাকেন যে , তা দেখলে আমারো ঈর্ষা লাগে ।
কর্মঠ সুন্দরী জুলিয়া সংবাদদাতাকে জানালেন,তিনি আর তাঁর স্বামঢর কঠোর পরিশ্রমের সুফল খুব দ্রুত পেয়েছেন। এই দু বছর তাদের পরিবার গরুর দুধ বিক্রী করে প্রচুর আয় উপার্জন করেছে । অতীতে তার স্বামী তার জন্যে ফল কিনতে গেলে প্রত্যেক বার শুধু আধা কেজিয় মতো কিনতেন , আজকাল কিন্তু বড় বড় ঝুড়িতে করে কিনে নিয়ে আসেন । শুধু জুলিয়া কেন ! সবাই যত খুশী খেতে পারেন ।
ফান ফুশৌ বলেছেন, সরকারের অনুকূল নীতির সুবিধা পেয়ে তাঁরা নমনীয় পদ্ধতিতে জীবিকা অর্জনকরে স্বচ্ছল হবার পথে এগিয়ে চলেছেন ।
আমরা গাইগুলোকে পোষি, নিজেরা কিছু টাকা জোগাড় করেছি, সরকারী ব্যাংক থেকেও কিছু ঋণ নিয়েছি । শুধু গাই পালন থেকেই বছরে আমাদের আয় হয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার ইউয়অন অর্থাত্ ৫ থেকে ৬ হাজার মার্কিন ডলার ।
বর্তমানে, ফান ফুশৌর বাড়িতে ২০টি গাই আর ৪০টি ভেড়া পোষা হচ্ছে । ট্রাক্টর ,ঘাস কাটার মেশিন কেনা হয়েছে এবং ঘাস মজুদ রাখার গুদাম নির্মাণ করা হয়েছে ।জুলিয়া ঘরের ভেতরে ও বাইরে সবকিছু গুছিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন ,অবসর সময়ে পাশ্চাত্য ধরনের সালাদ ইত্যাদি তরকারী রান্না করে পরিবারের সবাইকে ভিন্নজাতীয় স্বাদের রান্না খাওয়ান । তাদের নাদুসনুদুস আর ফর্সা খোকাছেলেটি জুলিয়ার ভাষায় ছোট দেবদূতের মতো সুন্দর । সে যে-কোনো লোককে দেখলেই হাসতে শুরু করে, বিশেষ করে নিজেদের গাই দেখলেই হাত পা নেড়ে নেচে উঠে । বোঝা যাচ্ছে , গো-পালকের গাইগুলোর প্রতি গো-পালকের ছেলেরও টান আছে । জুলিয়ার মা চীনে এসেছিলেন , যখন দেখলেন , মেয়ে আর জামাই মিলে-মিশে সুখী-স্বচ্ছল জীবন কাটাচ্ছে, তখন তিনি মহা খুশী হলেন । তাঁর চোখ দুটো থেকে পড়তে লাগলো আনন্দের অশ্রু । মংগোলিয়ায় ফিরে যাওয়ার আগে তিনি মেয়েকে বললেন, তোমাদের স্বচ্ছলতা ও সুখশান্তি দেখে মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারলাম ।
ফান ফুশৌ বললেন, তার পরিবারের সুখী জীবনের মাত্র শুরু । এ বছর সরকারের নতুন নীতি হয়েছে , কৃষকদের কর কমবে ,বোঝা লাঘব হবে , আগের বছরঘুলোতে বছরে আট নয় শো ইউয়ান জমা দিতে হতো নানা কর বা ফি হিসেবে । এ বছর শুধু তিন শো ইউয়ানদিতে হচ্ছে । কৃষি জমিকে আবার জংগল হতে দেয়ার সরকারী নীতি প্রবর্তন হবার পর সরকার কৃষকদের ক্ষতি পূরণের জন্য ভাতা বন্টন করেছে, পাহাড়ে গিয়ে গাছ লাগাতে পারলে আরও টাকা পাওয়া যায় । এখন ঠিক মতো খাটতে পারলেই দিন দিন আরও স্বচ্ছল সুখী জীবন হবে । ফান ফুশৌ জুলিয়ার সংগে পরামর্শ করে স্থির করলেন আরও বেশী গরু পালবেন । তিনি সংবাদদাতাকে বলেছেন ,
আমরা পরামর্শ করার পর সিন্ধান্ত নিয়েছি,গাই পালনের কাজ আরো বড় করবো । আমি আরও কিছু টাকা জোগাড় করে ৪০ ,৫০ টি গাই পালবো । পান ফুশৌ আর তার বিদেশিনী স্ত্রীর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ধনী হবার ঘটনা স্থানীয় জনতার মধ্যে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে । তাদের গ্রামে লোকেরা আগে শুধু শুধু জমি চাষ করতে অভ্যস্ত ছিলেন । এখন তারা গাই ও ভেড়া পালতে শখছেন । ফান ফুশৌ আনন্দের সংগে সংবাদদাতাকে জানালেন , এখন তাদের গ্রামের শতকরা ষাট জন লোক গাই ও ভেড়া ছাগল পালতে শুরু করেছে । গ্রামবাসীদের দিন আগের চেয়ে স্বচ্ছল হতে শুরু করেছে ।
|