চীনের অন্যতম সংখ্যালঘুজাতি-- শিব জাতির একটি পুরানো লোকসংগীত্ আছে। এতে বলা হয়েছে , দুজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নদীর তীরে মাছ ধরেন আর বাড়িঘর নির্মান করেন, তারা এক সাথে পরিশ্রম আর জীবনযাপন করেন । গায়কের নাম ছিছেসান , তিনি শিব জাতির একজন পন্ডিত । তিনি মনে করেন, তাদের পূর্বপুরুষরা গানের বর্ণনার মতোই উত্তর -পূর্ব চীনের পাহাড় ও নদ-নদীর তীরে বাস করতেন আর আরামের সংগে জেলে ও শিকারীর জীবনযাপন করতেন । তবুও বর্তমানে ছিছেসান ও তার পরিবার-পরিজন উত্তর পশ্চিম চীনের সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্ত্ব শাসিত অঞ্চলে থাকেন । ওখানে বসবাসকারী শিব জাতির লোকসংখ্যা ৪০ হাজার।
তাহলে কেন এত বেশী শিব জাতির লোকেরা সিনচিয়াংয়ে থাকেন? ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, ২৪০ বছর আগে উত্তর পশ্চিম সিনচিয়াংয়ের সীমান্ত প্রতিরক্ষার শক্তি সুসংবদ্ধ করার জন্য ছিং রাজবংশ সরকার উত্তর-পূর্ব চীন থেকে শিব জাতির তিন হাজার সামরিক ও বেসামরিক লোক পাঠায়। ১৭ মাস ধরে পথের নানা রকম বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে' তারা সিনচিয়াংয়ে এলেন এবং ই লি নদীর দক্ষিণ তীরে বসবাস শুরু করেছেন। জল-সম্পদের অভাবের দরুণ তারা ছ'বছর ধরে দু'শো কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল খনন করেছেন । এতে ই লি নদীর পানি ব্যবহার করে আবাদী জমি তৈরী করা হয়েছে । শিব জাতির ভাষায় "ছাবুজার" নামক এই খালের অর্থ "খাদ্যশস্য ভান্ডার।" তখন থেকে পরিশ্রমী শিব জাতির লোকেরা বংশপরম্পরায় ই লি নদীর তীরে বাস করে আসছেন এবং নিজেদের গ্রামের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
শিব জাতির পূর্বপুরুষরা চীনের তখনকার সীমান্ত প্রতিরক্ষার জন্য মহানকীর্তি স্থাপন করেছেন। এই ইতিহাস সিনচিয়াংয়ে বসবাসকারী শিব জাতির গৌরব । এখন সিনচিয়াংয়ে শিব জাতির লোকসংখ্যা ৪০ হাজারেরও বেশী হয়েছে । তাদের নিজেদের স্বায়ত্ত শাসিত জেলা--ছাবুজার শিব স্বায়ত্ত্ব শাসিত জেলাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । প্রতি বছর চান্দ্র বর্ষের চতুর্থ মাসের ১৮ তারিখ , সিনচিয়াংয়ের উদ্দেশ্যে উত্তর পূর্ব চীন থেকে তাদের পূর্বপুরুষের রওয়ানা দিবস উপলক্ষে সিনচিয়াংয়ে বসবাসকারী সকল শিব জাতির লোকের উত্সবের পোষাক পরে' উদযাপনী তত্পরতা আয়োজন করেন।
হয়তো জন্মস্থলের স্মৃতি চারণের কারণে সিনচিয়াংয়ের শিব জাতি এখনো শিব জাতির পুরানো রীতি নীতি আর ভাষার রেওয়াজ বজায় রাখছে । শিব জাতির ভাষা আর লিপি বিষয়ক গবেষণা কাজে নিয়োজিত ছিছেসান বলেছেন, এখন চীনে প্রায় ২ লক্ষ শিব জাতির লোক উত্তর পূর্ব চীনে থাকেন । শুধু শতকরা ২০ ভাগ শিব লোক সিনচিয়াংয়ে থাকেন । সিনচিয়াংয়ে বহু শিব লোক উইগুর ভাষা , কাজাখ ভাষা , রুশ ভাষা , হান ভাষা ইত্যাদি ভাষা জানেন। এখন শিব জাতির ভাষা আর লিপি শুধু সিনচিয়াংয়ে বসবাসকারী শিব লোকদের মধ্যে বজায় রয়েছে। শিব জাতি এমন একটিমাত্র জাতি , যারা মান জাতির ভাষা পড়তে পারে । এখন শিব জাতির ভাষা ও লিপি উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করার জন্য প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে ।
জনাব ছিছেসান বলেছেন , সিনচিয়াংয়ের শিব লোকেরা শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেন । তারা একাগ্রচিত্তে পড়েন । বহু শিব লোক প্রচেষ্টা চালাবার মাধ্যমে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছেন । তাদের মধ্যে আছেন টেলিভিশনের জনপ্রিয় উপস্থাপক উপস্থাপিকা , ছিছেসান সাহেবের মতো পন্ডিত , প্রসিদ্ধ শিল্পপতি আর খেলোয়াড় ।
শিব জাতি অশ্বারোহণ আর তীরন্দাজে পারদর্শী। ছিং রাজবংশ আমলে তাদের এই দক্ষতার দরুণ সীমান্ত প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে তাদেরকে সিনচিয়াংয়ে পাঠানো হয়েছিল। তখন সৈনিক হিসেবে অশ্বারোহণ আর তীরন্দাজ দুটোই প্রয়োজনীয় যোগ্যতা । সুতরাং বহু শিব পুরুষ ছোট বেলা থেকেই ভারোত্তলন , মুষ্টিযুদ্ধ ইত্যাদি শরীর চর্চা করেন । তীরন্দাজ তো তাদের অন্যতম কঠিন প্রশিক্ষণের কাজ ।
এ পর্যন্ত সিনচিয়াংয়ের বুরজার শিব স্বায়ত্তশাসিত জেলায় তীরন্দাজই এখনো একটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রীড়া দফা বলে মনে করা হচ্ছে । শীত্কালে যখন কৃষিকর্ম কম , তখন মাঝে মাঝে তীরন্দাজ প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়।
বসন্ত উত্সব , মধ্য শরত্কালীন উত্সব আর শিব পূর্বপুরুষদের পশ্চিম স্থানান্তর উত্সবের মতো শিব জাতির গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যিক উত্সব পালিত হয় , তখন সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ তীরন্দাজ প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয় ।
ই লি কাজাখ স্বায়ত্ত শাসিত বিভাগে অবস্থিত জাবুজার শিব স্বায়ত্ত শাসিত জেলা চীনের একটিমাত্র শিব জাতিভিত্তিক বহুজাতি অধ্যুষিত স্বায়ত্ত শাসিত জেলা । এবছর এই জেলার ৫০তম জন্ম বার্ষিকী । এখন এই জেলায় একটি অত্যন্ত সুন্দর শিব জাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বাগান নির্মান করা হয়েছে । এই বাগানে শিব জাতির লোক নৃত্য সংগীত আর তীরন্দাজদের চিত্তাকর্ষক অভিনয় উপভোগ করা যায় । পর্যটকরাও স্বহস্তে তীরন্দাজের চর্চা করতে পারেন । জেলার পর্যটন বিভাগের পরিচালক ছিউ ইউ চুয়াং বলেছেন , এই বাগানে শিব জাতির ইতিহাস , পশ্চিমে স্থানাস্তরের ইতিহাস , শিব জাতির সংস্কৃতি ও তাদের দেশপ্রেমিক মনোবল জীবন্ত হয়ে উঠেছে ।
|