প্রিয় বন্ধুরা, চীনের হোনান প্রদেশ হুয়াংহো নদীর নিম্ন অববাহিকায় অবস্থিত।হুয়াংহো নদীকে চীন জাতির মাতৃ নদী বলে ডাকা হয়। অনেক চীনা লোকের স্মৃতিতে হোনান এমন একটি জায়গা যেখানের প্রাকৃতিক পরিবেশ তেমন সুন্দর নয়। গত এপ্রিল মাসে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা হোনানের একটি ছোট্র শহর---চিওজু শহর সফর করতে গিয়েছেন। ওখানে তিনি হোনানের স্ববৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পেয়েছেন।আজকের এই আসরে আপনারা আমাদের সংগে একত্রে চিওজুর সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।আজকের চলো না ঘুরে আসি নামে বিশেষ অনুষ্ঠানে আপনারা শুনতে পারবেন আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতার লেখা একটি রেকডিংভিতিক রিপোর্ট । অনুষ্ঠান উপস্খাপন করবেন আপনাদের বন্ধু চিয়াং চিন ছেন।
চিওজুর পাহাড়পর্বত অত্যন্ত সুন্দর।এ সব পাহাড় খুব উচু নয় , তবে এগুলোর চূড়োয় ওঠা মোটেই সহজ কাজ নয়।সেনলন পাহাড় এসব পাহাড়ের মধ্যে একটি।সেনলন পাহাড়ের স্বৈশিষ্ট্য হলো, এর পাশাপাশি আর কোনো ছোট-বড় পাহাড় নেই। এই পাহাড় এত খাড়া যে , মনে হয় সরাসরি মাটি থেকে আকাশের দিকে ছুটে গেছে। সুতরাং সেনলন পাহাড়ে ভ্রমণ করতে-আসা পযর্টকদের মধ্যে বেশির ভাগ কেবল কারে চেপে পাহাড়ের শৃংগে যান, যাতে খাড়া পাহাড়ের চূড়ো থেকে আকর্ষনীয় দৃশ্য সম্পূর্ণভাবে চোখে পড়ে ।কিন্তু যদি আপনি পাহাড়ে উঠতে অভ্যস্ত, তাহলে পাহাড়ের উপরে ওঠার পাশাপাশি সহস্রাধিক গাছপালার সৌন্দর্য উপভোগ করাও মন্দ নয়।কারন পাহাড়ে আরোহণের সংগে মানুষের মানসিক আনন্দলাভের একটা সম্পর্ক আছে।
কয়েক ঘন্টা পর সংবাদদাতা সেনলন পাহাড়ের শৃংগে পৌছে গেলেন।এই শৃংগের নাম জিচিয়ান শৃংগ।সংস্লিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, প্রাচীন কালে সম্রাট সেনলন এক সময়ে ওখানে এসে শস্য নির্ণয় করতেন এবং নানা ধরনের ঘাস আস্বাদন করতেন।এর পর চীন কৃষি সমাজে উন্নীত হয়।সম্রাট সেনলনের স্মৃতিতে স্থানীয় লোকেরা এই পাহাড়কে সেনলন পাহাড় নাম দিয়েছেন।
সেনলন পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্র-সমতলের চেয়ে ১০০০ মিটারের বেশি। এই জিচিয়াং শৃংগে দাঁড়িয়ে বাতাস হুঁ হুঁ করে সংবাদদাতাটির কানের পাশে বয়ে যাচ্ছে। সুমহান পাহাড়পর্বত এবং ছুরি দিয়ে কেটে ফেলার মত পাহাড়ের ফেলি পুরোপুরি সংবাদদাতার নজড়ে পড়ে।তখন গ্রীষ্মকালের প্রাম দিকে।দূরের শৃংগে হাল্কা আর কাল সবুজ রংয়ের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সাদা সাদা রংয়ের ফল দেখা যাচ্ছে।জানা গেছে, শরতকালে পাহাড়ের গাছপালায় যেন লাল রং মাখানো হয়।তখন গোটা পাহাড় আগুনের সমুদ্রের মত দেখায়।জিচিয়াং শৃংগে ছবি তুলছেন এক জন পযর্টক।তিনি আবেগের সংগে সংবাদদাতাকে বললেন,
কিংবদন্তি অনুযায়ী, সেনলন পাহাড় নাকি চীনা জাতির জম্মস্থানগুলোর অন্যতম।এখানকার দৃশ্য দেখার পর , আমি বুঝতে পেয়েছি আমার এখানকার এই সফর বিফল হয় নি।আমার জাতীয় আত্মগৌরব বেড়েছে। উপরন্তু এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যি খুব চমতকার।
জিচিয়াং শৃংগের কাছে সাদা পাইন গাছের বণ। এই বণের প্রশস্ত জায়গা দু থেকে তিন মিটার,সরু জায়গা মাত্র এক মিটারেরও কম।এই এবড়োখেবড়ো বণের দুই পাশে অতল গহ্বর।নীচের দিকে তাকালে গা শিউরে উঠে।
জানা গেছে, শুধু সেনলন পাহাড় এবং চীনের উতর-পূর্ব জাইনবাই পাহাড়ে এই ধরনের সাদা পাইন গাছ আছে।যে সব গাছের বয়স ৪০০ বছরের বেশি হয়েছে, সে সব গাছের গায়ের রং সাদা হয়ে গেছে। সেনলন পাহাড়ে মোট ১৬০০০টি সাদা পাইন গাছ আছে। গাছগুলোর মধ্যে বেশীর ভাগের বয়স সহস্রাধিক। গাছের পাতাগুলো বেশ বড় নয়,তাই রুপালী গাছের গুঁড়িগুলো খুব আকর্ষনীয়। এ সব সাদা পাইন গাছ পাথরের মাঝখানে জম্ম আর বড় হয়েছে। গাছের শিকড় পাথরের নিচে দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়েছে।গাছগুলোর চেহারা ভিন্ন রকমের।কোনো কোনো গাছ দেখে মনে হয় অথিতিদের স্বাগত জানাচ্ছে , কোনো কোনো গাছ দেখে মনে হয় ময়ুরের পাখার মত বিস্কৃত হয়েছে । আরো মজার ব্যাপার হলো,সংবাদদাতা লক্ষ্য করেছেন,অজস্র লাল কাপড় আর লাল সুতা এ সব সাদা পাইন গাছের গায়ে বাঁধা হয়েছে। স্থানীয় জনগনের কাছে জানা গেছে, শুভ কামনার প্রতিক হিসেবে এ সব সাদা কাপড় আর সুতা গাছগুলোর গায়ে বাঁধা হয়েছে। লি চিয়ে ফেন নামে এক জন মেয়ে সংবাদদাতাকে বললেন,
প্রাচীন কাল থেকে পাইন গাছ তো দীর্ঘায়ুর প্রতীক বলে মনে করা হয়।গাছের গায়ে লাল কাপড় আর লাল সুতা বাঁধার মাধ্যমে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দীর্ঘায়ু কামনা আর শিশুদের সুস্বাস্থ্য কামনা করার আশা-আকাংখা প্রকাশিত হয়।
সেনলন পাহড় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পযার্য়ের রীস্যাস বানর প্রাকৃতিক সংরক্ষণ অঞ্চল।প্রত্যেক দিন ৯০০০টিরও বেশী রীস্যাস বানর গাছে উঠে খেলতে খেলতে আনন্দে মেতে উঠে।নি:সন্দেহে এ সব বানর পাহাড়ে উপস্থিত থাকায় পযর্টকরা আরো মজা পান। আরো মজার ব্যাপার হলো,এই দর্শনীয় এলাকার কর্মচারীদের নির্দেশে তিন শটিরও বেশী বানর পর্যটকদের সংগে খেলতে আসে।
পাহাড় থেকে নীচে নেমে যাওয়ার পথে , সংবাদদাতা কয়েকটি বানরের সংগে কিছু ক্ষণের জন্যে খেললেন। এই অঞ্চলের কর্মচারীদের পরিচিত কন্ঠ শুনে শতাধিক বানর চোখের পলকে উপর থেকে নীচে ছুটে আসছিল।যখন সংবাদদাতাটি সংগে নেওয়া বাদাম, বিস্কূট ইত্যাদি খাবার তাদের মধ্যে ছুড়ে দিলেন , তখন ছোট বড় বানররা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে জড়োসড়ো হয়ে খাবারগুলো ছিনিয়ে নিচ্ছিল। এ দৃশ্য্ দেখে দারুণ মজা লাগে!
চিওজুতে জলের অভাব নেই।হয়তো বিশুদ্ধ পানি এই মাটির উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর, কেবলমাত্র এ ধরনের সুন্দর দৃশ্যের জম্ম হতে পারে। সেনলন পাহাড়ের পাশে একটি নদী আছে, নাম ছিনলন নদী।এই নদীর দিকে যাওয়ার সময়ে দূর থেকে পানি প্রবাহিত হওয়ার শব্দ ভেসে আসছে। জাগা গেছে, ছিনলন নদীর দর্শনীয় স্থানের সুন্দর শৃংগ আর অদ্ভুত পাথর বিখ্যাত।এগুলোর মধ্যে ডাশিয়ের হ্রুদের দৃশ্য সবচেয়ে মনোরম।সংবাদদাতাটি একটি নৌকায় চেপে ডাশিয়ে হ্রুদে চার দিকের দৃশ্য উপভোগ করলেন।উদাসীনতার মধ্যে হ্রদের মাছ সংবাদদাতাটির নজরে পড়ে।জানা গেছে, এই হ্রদের দৈর্ঘ্য সাত কিলোমিটার, চওড়া প্রায় ৯০ মিটার।হ্রদের পানির গভীরতা ৬০ মিটারের বেশী। জলে নানা ধরনের মাছ আছে। সুতরাং ডাশিয়ে হ্রদ মাছ-ধরা অনুরাগীদের পক্ষে একটি আদর্শ জায়গা।
নৌকায় বসে বসে নদীর দুই তীরের দৃশ্য দেখে শেষ করা যায় না। এ সব অদ্ভুত পাথরের দৃশ্য উপভোগ করতে চাইলে মানুষের যথাসাধ্য অবসর থাকা উচিত।গাইড হো ইউ হন পযর্টকদের জন্যে এক গুচ্ছ পাথরের অর্থ ব্যাখ্যা করলেন।
ডান দিকের তীরের সবচেয়ে উচু জায়গায় একটি ছোট উপত্যকা আছে। এই উপত্যকায় চারটি ছোট পাথর ।তারা মুথোমুখি বসে আছে।দক্ষিণ দিকে যে বুড়ো মহিলা বসে আছেন তার পরনে চীনের ঐতিহ্যিক পোশাক। মাথার চুল বাঁধা। তার নাম সেনিন। তার সামনে তিনটি পাথর যথাক্রমে তার তিন জন ছেলের প্রতিনিধিত্ব করে।তিনি নিজের তিন ছেলেকে শিক্ষাদান করছেন।এই দর্শনীয় স্থানকে সেননিন সন্তানের শিক্ষাদান বলে ডাকা করা হয়।
এই হ্রদে এক দল বিশেষ অধিবাসী আছে। তারা হলো বন্য হাঁস। জানা গেছে, এই হ্রদের একটি নদীর মোড়ে কয়েক ডজন বন্য হাঁস জড়ো হয়। দিনের বেলায় তারা ঝাঁকে ঝাঁকে এই হ্রদে এসে তাদের এক দিনের জীবন শুরু করে, সন্ধ্যার পর তারা নিজেদের মনো্রম বাসায় ফিরে যায়।
প্রিয় বন্ধুরা, চিওজুয়ের সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে দিন ফুরিয়ে যায়, দেখা শেষ হয়না। যেন ছোট গল্পের মতো। রবী ঠাকুরের ভাষায় : "শেষ হইয়াও ইহলনা শেষ।"
|