Web bengali.cri.cn   
জাপানের সুমো খেলা ও সুমো কুস্তিগিরদের জীবন
  2015-06-15 16:59:03  cri


সুমো জাপানের ঐতিহ্যবাহী জাতীয় খেলা হিসেবে পরিচিত। প্রতিযোগিতামূলক ও পূর্ণাঙ্গরূপে সংস্পর্শযোগ্য খেলা হিসেবে দু'জন প্রতিযোগী একে-অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। খেলার সময় একজন কুস্তিগির (রিকিশি) জোরপূর্বক অন্য কুস্তিগিরকে বৃত্তাকার চক্র বা দোহাইও'র বাইরে ফেলতে কিংবা ভূমি স্পর্শ করানোর চেষ্টা করে থাকেন।

সুমো জাপানে খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা। বিভিন্ন স্তরের স্কুলে বা বিদ্যালয়ে সুমো ক্লাব আছে। কিছু কিছু শিক্ষার্থী হয়তো লেখাপড়ায় ততটা আগ্রহী নয়, তবে তারা স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর সুমো খেলায় যোগ দিতে পারে।

প্রাক-ইদো শাসনামলে জাপানে সুমো খেলার উত্পত্তি হয়। সনাতন জাপানি খেলাধুলা হিসেবে সুমো খেলার উত্পত্তি মূলত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। পৃথিবীর একমাত্র দেশ হিসেবে জাপানেই পেশাদারী পর্যায়ে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়।

সাধারণত এটি 'জেন্দাই বুদো' নামে পরিচিত যা জাপানের আধুনিক মার্শাল আর্ট নামে বিবেচিত। এই সংজ্ঞাটি ভুল হলেও সুমো প্রাচীন কলাবিদ্যা হিসেবে তার জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রেখেছে স্ব-মহিমায়। তাছাড়া, আধুনিক যুগের প্রচার মাধ্যমেও এটি বহুল প্রচার পেয়েছে।

অনেক প্রাচীন সংস্কার সুমো খেলায় শিন্তো ধর্মীয় বিশ্বাসে আবদ্ধ। এমনকি এখনও লবণ ছিটানোর মাধ্যমে পরিশুদ্ধিকরণ এ খেলার আচার ও উপাদানের অন্যতম। এ সংস্কারটি শিন্তো ধর্মাবলম্বীতে প্রচলিত রয়েছে। অধিকাংশ সুমো কুস্তিগিরকে সমাজে অবস্থানের পাশাপাশি সুমো প্রশিক্ষণের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। জাপানে এটি 'হেয়া' নামে পরিচিত। সেখানে তাদেরকে দৈনিক জীবনধারণের জন্য খাদ্য গ্রহণ থেকে শুরু করে একই ধরণের পোশাক পরিধান করতে হয়। এগুলো সবই অবশ্যপালনীয় নির্দেশমালা ও কঠোর সংস্কার হিসেবে পালিত হয়।

যোগ্যতা অর্জনের জন্য ব্যক্তিকে নমুনা ও প্রাথমিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শক্তিমত্তা যাচাই করতে হয়। প্রচলিত সংস্কার অনুযায়ী বেশ কিছু সুমো খেলা সত্যিকার অর্থেই ধর্মীয় বিধি-বিধানে পরিচালিত যা শিন্তোদের মন্দিরে নাচ প্রদর্শনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কুস্তিগিরকে কামি (শিন্তো স্বর্গীয় আত্মা) নামে অভিহিত করা হয়। কিছু খেলা ভবিষ্যত কথন বা ভবিষ্যতবাণী হিসেবে বিবেচ্য। যেমন, একজন কৃষক এবং জেলের মধ্যকার খেলায় যদি জেলে জয় লাভ করে তাহলে ঐ বছর অনেক মাছ পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করা হয়। জাপানের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হিসেবে আখ্যায়িত। প্রতিটি রাজ্যের প্রতিনিধিকে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ-পূর্বক লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। অবশ্য, কুস্তিগিরকে যাতায়াত বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করা হয়। এ প্রতিযোগিতা সুমাইন নো সেচি বা সুমাই পার্টি নামে পরিচিত।

সুমো খেলোয়াড় হতে চাইলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। জাপানের সুমো কমিশন হলো সুমো প্রতিযোগিতা আয়োজনের সরকারি সংস্থা। তা জাপানের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের আওতায় কাজ করে।

কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, সুমো খেলোয়াড় হতে চাইলে দেশটির বাধ্যতামূলক শিক্ষা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং বয়স হতে হবে ২৩ বছরের নিচে। শারীরিক অবস্থা সম্বন্ধে এর নিয়ম হলো দৈহিক উচ্চতা ১৬৭ সেন্টিমিটার বা ৫.৫ ফিট, ওজন ৬৭ কেজির বেশি।

এখন প্রশ্ন হলো, যাদের ওজন ৬৭ কেজি হয় নি, কিন্তু সুমো খেলোয়াড় হতে চায়, তাদের পক্ষে কি তা হওয়া সম্ভব?

হ্যাঁ, সম্ভব, শারীরিক পরীক্ষার আগে কিছুদিন বেশি বেশি তৌফু খেতে হবে এবং পানি পান করতে হবে। এর মাধ্যমে অনেক তাড়াতাড়ি ওজন বাড়ানো সম্ভব।

এবার হয়তো জিজ্ঞেস করবেন, যদি দৈহিক উচ্চতা যথেষ্ট না হয়, তাহলে কি কোনো উপায় আছে? হ্যাঁ, আমি আপনাদেরকে বলতে চই, তারও সত্যি উপায় আছে। কিছু কিছু লোক খুব মজার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যেমন শারীরিক পরীক্ষার আগে নিজেকে লম্বা করানোর জন্য জোরে শরীরকে প্রসারিত করা। আরো মজার উপায় হলো, কাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত হানা, যাতে মাথা ফুলে ওঠে।

হ্যাঁ, যদি একজনের দৈহিক উচ্চতা মানদণ্ডের সঙ্গে সামান্য পার্থক্য সৃষ্টি করে তাহলে উপরোক্ত উপায়ের মাধ্যমে তা সমাধান করা সম্ভব।

কিন্তু যদি একজনের দৈহিক উচ্চতা মানদণ্ডের তুলনায় ৩ বা ৪ সেন্টিমিটার কম, তাহলে একটু ঝামেলা হবে, তা সমাধানের জন্য দরকার অস্ত্রোপচার। এ উপায়ে পায়ের নিচে অথবা মাথার খুলিতে মোটা কিছু জিনিস লাগানো হয়, তবে শারীরিক পরীক্ষার পর আবার শরীর থেকে তা খুলে ফেলা হয়।

সকল কুস্তিগির শিকোনা নামে কুস্তিগিরের নতুন নাম গ্রহণ করেন, যা তাদের প্রকৃত নামের সাথে সম্পৃক্ত নয়। কুস্তিগিররা তাদের পছন্দের নাম বাছাইয়ের সুযোগ খুব কমই পেয়ে থাকেন। তাদের প্রশিক্ষক (স্টেবলমাস্টার) বা সমর্থক বা পরিবারের সদস্যগণ তাদের নতুন নামে ডাকেন ও খেলায় অনুপ্রবেশে উদ্বুদ্ধ করেন। তবে একজন সুমো কুস্তিগির তার খেলোয়াড়ি জীবনে বেশ কয়েকবার নাম পরিবর্তন করতে পারেন।

সম্পূর্ণরূপেই সুমো কুস্তি খেলা কঠোরভাবে শৃঙ্খলিত খেলাধুলার শক্ত মানদণ্ডে আবদ্ধ। কুস্তিগিররা ইদো শাসনামল থেকে প্রচলিত শত-শত বছরের পুরনো পদ্ধতিতে শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে পরিগণিত হন। পুরো বছরব্যাপী ৬টি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও যথাযথ দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে কুস্তিগিরকে উত্তরণ অথবা অবনমিত করা হয়। খুবই সতর্কতার সাথে তালিকা প্রস্তুত করা হয়। প্রতিটি সুমো প্রতিযোগিতা শুরুর দুই সপ্তাহ পূর্বে প্রধান যাজক কর্তৃক তা প্রকাশ করা হয়।

সুমো খেলোয়াড় হতে চাইলে প্রথমে সুমো কমিশনের আওতায় একটি প্রশিক্ষণ সংস্থায় যোগ দিতে হয়। প্রশিক্ষণ সংস্থায় যোগ দেয়ার পর কঠিন প্রশিক্ষণ ও চর্চার জীবন শুরু হয়। এসময় সব সুমো খেলোয়াড়কে একসাথে থাকতে হয় এবং কোনোভাবেই বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না।

এ মহলের মর্যাদা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নতুন খেলোয়াড়কে ভোর পাঁচ বা ছয়টায় বিছানা থেকে উঠতে হয়। উচ্চ পর্যায়ের খেলোয়াড় সকাল ৮টার পরে উঠতে পারেন। দুপুর বারোটার দিকে সুমো খেলোয়াড়রা খেতে শুরু করেন। নতুন খেলোয়াড় সবার জন্য খাবার রান্না করেন।

এবার প্রশ্ন, তাহলে এসব খেলোয়াড় কি খেয়ে থাকেন বা কি খান?

হ্যাঁ, তারা 'তয়ানকো' নামে এক রকমের হটপট খান। মানে মাংস, মাছ, শাকসবজি সবকিছু একটি পটে রান্না করা হয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে খাবারের পরিমাণ অনেক বেশি, পুষ্টি বেশি, এমনকি ফ্যাটও অনেক বেশি। যাতে সহজেই ওজন বাড়ানো যায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন সুমো খেলোয়াড় প্রতিদিন 'তয়ানকোর' মাধ্যমে ১৯ হাজার ক্যালরি অর্জন করেন। তার স্ট্যান্ডার্ড মিলের মধ্যে রয়েছে, ৫ শ কিলোগ্রামের গরুর মাংস, তিনটি বড় বাটির ভাত, তেলে ভাজা দু'টি মাছ, দুই বা তিনটি তেলে ভাজা মুরগির পা, ৫শ কিলোগ্রামের মাখন বিস্কুট, এক লিটার বিয়ার এবং জাপানের ঐতিহ্যিক মদ ইত্যাদি। হটপট শেষে তারা আরো খাবার খেয়ে থাকেন, যেমন ক্রিম কেক জাতীয় মিষ্টি খাবার। খাওয়া শেষে কোনো দেরি না করে সরাসরি ঘুমাতে যান তারা।

সুমো খেলোয়াড় খুব কঠোরভাবে নিয়ম অনুসরণ করেন। খাবার খাওয়া, ওয়াশরুমে যাওয়া এবং স্নান করার ক্ষেত্রেও কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয় তাদের।

উচ্চ পর্যায়ের খেলোয়াড়রা আগে এসব কাজ করতে পারেন, আর নিম্ন বা নতুন খেলোয়াড়রা পরে যান। এ ছাড়া আরো অনেক কাজ করতে হয়, যেমন কাপড় ধোয়া এবং ঘর পরিস্কার করা। তাই কেবলমাত্র যাদের গভীর ধৈর্য এ তীব্র আকাঙ্ক্ষা আছে তারাই শেষ পর্যন্ত এসব প্রশিক্ষণ লাভ করে সুমো খেলোয়াড় হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হন বা পরিচিতি পান। (ফেইফেই/টুটুল)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040