Web bengali.cri.cn   
জাপানিরা কেন অবসর নিতে চান না?
  2014-08-18 18:37:19  cri

 



আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, আমাদের এই এশিয়া মহাদেশে এমন একটি দেশ আছে যে দেশটিকে সূর্যোদয়ের দেশ বলা হয়। কি বন্ধুরা, মনে পড়েছে দেশটির কথা? হ্যাঁ, দেশটির নাম হলো জাপান।

শুরুতেই আমরা জাপানের একজন সাধারণ কর্মীর মনের কথা শুনবো। হিজিমি হলেন জাপানের রাজধানী টোকিওর একটি ছাপাখানার একজন কর্মী। অবসর বিষয়ে তিনি বলেন, যদি কাজ না করতাম, তাহলে অনেক আগেই আমি মারা যেতাম। অবসরের পরও আমি আরো কাজ করতে চাই। কারণ কাজ করলেই বেঁচে থাকতে পারবো আমি।

আসলে হিজিমি ছাড়াও জাপানের অধিকাংশ নাগরিকের মতামত একই। সম্প্রতি জাপান সরকার দেশটির ৩৫ বছর থেকে ৬৪ বছর বয়স্কদের কাজের ইচ্ছা নিয়ে একটি জরিপ করেছে। ফলাফল থেকে জানা গেছে, ৩১.৪ শতাংশ লোক ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত কাজ করতে চান এমন ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আর ২০.৯ শতাংশ লোক আশা করেন তারা ৭০ বছর বয়সে অবসর নেবেন। ২৫.৭ শতাংশ লোক বলেন, তারা সারা জীবনই কাজ করতে চান। এই শতাংশ লোক আরো বলেন, যেদিন সত্যি সত্যি তাদের কাজ করার কোনো শক্তি থাকবেনা এবং কিছুই করতে পারবেন না, সেদিন তারা অবসর নেবেন।

এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, প্রায় অধিকাংশ জাপানিই ৬৫ বছর বয়সের পরও কাজ করতে চান।

খবর শুনে কেমন লাগছে আপনাদের? আমার কিন্তু একটু ভয়ই লাগছে আর মনে মনে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, তাদের কাজের ইচ্ছা এত দৃঢ়? এর পিছনে নিশ্চয়ই অনেক কারণ রয়েছে।

অধিকাংশ মানুষই অবসরের পর সুখে, শান্তিতে, আরামে জীবন কাটাতে চান। তারা চান আর যেন কোন কাজ না করতে হয়, এবার বিশ্রাম নেবেন। কিন্তু অধিকাংশ জাপানি সত্যিই কাজ করতে চান। এটি জাপানিদের চরিত্র এবং সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে জড়িত। আর এ থেকে আমরা জাপানের বয়স্ক সমাজের আসল অবস্থাও আরো ভালভাবে জানতে পারি।

অধিকাংশ জাপানি বলেন, তারা কেন অবসরের পরও কাজ করতে চান? কারণ তাদের উদ্বেগ হলো, অবসরের পর জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই, তারা মনে করেন জাপানের অবসর ভাতা ব্যবস্থা নির্ভরযোগ্য নয়। জাপানে বয়স্কদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবসর ভাতার বিষয়টিও সরকারের কাছে একটি চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। কারণ সরকার যে ভাতা প্রদান করেন তার পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। যা সরকারের কাছে একটি বোঝার মত।

সরকারের গণ অর্থ সম্ভবত এর কারণে দেউলিয়া হতে পারে। এ ছাড়া অবসর ভাতার ব্যবস্থার প্রতি লোকজনের আস্থাও হারিয়ে যাচ্ছে। জাপানে এখন অবসর ভাতার একটি অভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা হল, অবসর নেয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তাই তাদের ভাতা দেয়ার পরিমাণও বাড়ছে।

তাই জাপানিদের উদ্বেগ, ভবিষ্যতে কি যথেষ্ট অবসর ভাতা পাওয়া যাবে? এজন্য জাপানের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আশা করেন, যখন তাদের শারীরিক অবস্থা ভালো, তখন তারা অবসর নেবেন না এবং কাজ করার মাধ্যমে আরো বেশি টাকা উপার্জন করবেন।

খ: এছাড়া আরেকটি কারণ আছে। তাহলো জাপানিদের চরিত্র। তাদের মতে কাজ বা কর্ম খুব পবিত্র একটি ব্যাপার। জাপানিরা কাজের জন্য অনেক পরিশ্রম করেন, একথা বিশ্ববাসী সবাই জানেন। কাজের ক্ষেত্রে 'যত বেশি বেতন পাবে তত বেশি কাজ করবে', একথা জাপানিরা মানতে পারেন না। তারা শুধুই খেয়াল রাখেন যে, কাজের জন্য সব প্রচেষ্টা তারা চালিয়েছেন কিনা? কাজ ভালো হলে তারা অনেক গর্ব বোধ করেন, আর যদি কাজ ভালো না হয়, তাহলে তারা মনে মনে অনেক বিব্রত ও লজ্জিত হন।

জাপানিরা বয়স্ক হলেও বৃদ্ধ হিসেবে অন্যের যত্ন পেতে চান না। তারা আসলে স্বীকার করতে চান না যে, তাদের বয়স হয়েছে।

এমন একটি উদাহরণ আছে। যেমন জাপানের সাবওয়ে বা মেট্রোরেলে কিছু কিছু বিদেশি দেখেছেন যে, তাদের কাছে বয়স্ক জাপানিরা দাড়িয়ে আছেন এবং তাদের কোনো সিট নেই। বিদেশিরা হয়তো নিজের সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে বয়স্কদের বসতে বলবেন। কিন্তু জাপানিরা এর জন্য কৃতজ্ঞ হবেন না এবং বসবেনও না। তাদের মনের কথা এমন, কি হয়েছে, আমি কি অনেক বৃদ্ধ হয়েছি? আমি এত দুর্বল হয়েছি? এখন কি কেউ আমার জন্য সিট ছেড়ে দেবেন?

এ ছাড়া অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাজে যুক্ত থাকার আরেকটি কারণ আছে, তা হলো তারা একা থাকতে চান না, তারা কাজের মাধ্যমে পরিচিত মানুষ বা বন্ধুর সঙ্গে থাকতে চান।

জাপানিরা কেন অবসর নিতে চান না, সে সম্পর্কে আমরা এ পর্যন্ত দু'টি প্রধান কারণ উল্লেখ করেছি। একটি হলো জাপানের অবসর ভাতা ব্যবস্থা, আরেকটি হলো জাপানিদের চরিত্র। আসলে আরেকটি কারণও আছে, তা হলো বিবাহিত জীবন।

অবসরের পর জাপানিদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার অনেক বেশি । এটি জাপানের ঐতিহ্যিক পরিবারিক অবস্থার সঙ্গেও জড়িত।

জাপানের পুরুষরা অবসরের আগে সবসময় কাজের জন্য ব্যস্ত থাকেন, আর এজন্য অনেক রাতে বাসায় ফেরেন তারা। যাদের স্ত্রী চাকুরি করেন না, তারা দিনে পরিবারের কাজ করেন এবং স্বামী ও শিশুর যত্ন নেন। স্ত্রীর কাছে তার একমাত্র স্বাধীন সময় হলো স্বামীর অফিসে যাওয়া এবং শিশুর স্কুলে যাওয়ার পর প্রতিবেশির সঙ্গে কিছু আড্ডা মারা।

তাই স্বামীর কর্ম জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর, অনেক স্ত্রীই বাসায় স্বাধীনতা অনুভব করতে পারন না। 'হঠাত বাসায় একজন লোক বেশি হয়েছে, যিনি সবসময় বাসায় থাকেন', এমন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না এবং এমন জীবন এড়িয়ে চলার জন‍্য অনেক স্ত্রী‌ই স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

এ ছাড়া জাপানের রীতি অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদের পর অবসর ভাতা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হয়।

সারা জীবন কাজের জন্য পরিশ্রম করেছেন, পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, এমন জাপানি পুরুষদের অবসরের পর পরিশ্রমের মাধ্যমে পাওয়া অবসর ভাতা যদি বিবাহবিচ্ছেদ হলে স্ত্রীর সাথে অর্ধেক শেয়ার করতে হয়, তা জাপানি পুরুষদের জন্য অনেক দুঃখের ব্যাপার। আরো দু:খের ব্যাপার হলো বিবাহবিচ্ছেদের পর এসব পুরুষদেরকে আবর্জনা হিসেবে বাসা থেকে ফেলে দেয়া।

অনেক জাপানি পুরুষ আছেন যাদের অবসরের পর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে এবং তাদেরকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তারা পরিবারে কোনো কাজ করতে পারেন না এবং নিজেরও যত্ন নিতে পারেন না।

এর কারণে অনেক সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে। যেমন জাপানের তথ্য মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, নি:সঙ্গতার কারণে জাপানে প্রতি বছর আত্মহত্যা করা বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি।

অবসর নিতে ভয় লাগে, এটি শুনতে বেশ হাস্যকর। কিন্তু এর পিছনে অনেক সামাজিক কারণ রয়েছে। যা সমাধান করা সমাজ ও সরকারের যৌথ দায়িত্ব। আশা করি ভবিষ্যতে জাপানিদের অবসর জীবন সত্যি অনেক সুখের এবং আরামের হবে। সারাজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমের সুখ তারা উপভোগ করবেন অবসর জীবনে, পরিবারের সাথে, স্ত্রীর সাথে এই প্রার্থনা আমরা করি। সুখের হোক জাপানিদের অবসর জীবন, সুখে থাকুক স্বামী-স্ত্রী হাসিখুশিতে, শান্তিতে। আর মুচকি হেসে তারা বলুক, হাই, এই তো আমরা বেশ ভাল আছি।

(শুয়েই/টুটুল)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040