নানা কারণে লাল পতাকা ব্র্যান্ডের প্রথম মোটর গাড়ি উত্পাদন করেছে চীনের প্রথম গাড়ি উত্পাদন কারখানা এবং পরে সেটার উত্পাদন বন্ধ করেছে। ১৯৭৮ সালে চীনের শাংহাইয়েই কেবল গাড়ির ব্যাপক উত্পাদন হতো। তবে শাংহাইয়ের বার্ষিক উত্পাদন ক্ষমতাও ছিল তিন হাজারের কম। তখন গাড়ি উত্পাদন কারখানা এবং খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দপ্তরগুলো ছিল সংকীর্ণ গলিতে। ১৯৭৮ সালের আগস্টে চীনের যন্ত্রপাতি শিল্প মন্ত্রণালয় ও শাংহাই পৌর সরকারের 'মোটর গাড়ি প্রযুক্তি আমদানি' এবং 'শাংহাই মোটর গাড়ি কারখানা সংস্কার' সংক্রান্ত প্রস্তাব চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের অনুমোদন পায়। দু'মাস পর শাংহাই, সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে, বিশ্বের সেরা দশটি গাড়ি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে আমন্ত্রণ জানায়। শাংহাইয়ের আমন্ত্রণে সবার আগে সাড়া দেয় মার্কিন জেনারেল মোটরস। জেনারেল মোটরসের চেয়ারম্যান থমাস আকিনাস মার্ফি তখন চীন সফরে আসেন।
এ প্রসঙ্গে চীনের গাড়িশিল্প বিশেষজ্ঞ চিয়া সিন কুয়াং বলেন, "জেনারেল মোটরস চীনের গাড়িশিল্পের উন্নয়নে বিরাট অবদান রেখেছে। শুরুতে আমরা ভেবেছিলাম, গাড়ির বিভিন্ন অংশ আমদানি করার পর আমরা তা সংযোজন করবো, তারপর বিক্রি করবো। কিন্তু জেনারেল মোটরস যৌথ-মালিকানার ভিত্তিতে চীনে কোম্পানি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে। প্রস্তাব অনুসারে, দু'পক্ষ যৌথভাবে দায়িত্ব বহন করবে এবং লাভক্ষতির সমান অংশীদার হবে।"
১৯৭৮ সালের শেষের দিকে চীনের তত্কালীন রাষ্ট্র নেতা তেং সিয়াও পিং যৌথ-মালিকানায় কোম্পানি প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন। তিনি এ ব্যবস্থায় শুধু মোটর গাড়ি নয়, অন্যান্য ভারি যানবাহন তৈরির বিষয়টিও অনুমোদন করেন।
চিয়া সিন কুয়াং বলেন, "যৌথ-মালিকানার আইনি ভিত্তি কী? যদি আইনি ভিত্তি না থাকে, তাহলে এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি কার্যকর হবে না। তাই জেনারেল মোটরস চীনের সাথে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট আইনি ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করে। তখন চীনে যৌথ-মালিকানা আইন ছিল না। ফলে সরকার যৌথ-মালিকানা আইন বিষয়ে গবেষণা করার জন্য দ্রুত একটি বিশেষ কার্যগ্রুপ গঠন করে। তারপর এক সময় চীনে যৌথ-মালিকানা আইনও প্রণীত হয়।"
১৯৮৪ সালের ১০ অক্টোবর দীর্ঘ মেয়াদে আলোচনার পর চীন-জার্মান যৌথ-মালিকানা মোটর গাড়ি প্রকল্প --- 'শাংহাই ভক্সওয়াগন' প্রতিষ্ঠার চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয়। এরপর পেইচিং জিপ, কুয়াংচৌ পিয়জিয়টসহ বিভিন্ন যৌথ-মালিকানা প্রতিষ্ঠান একে একে প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনের আধুনিক গাড়িশিল্প তখন থেকেই গড়ে উঠতে শুরু করে।
শাংহাইয়ে উত্পাদিত ওক্সওয়াগন গাড়ি
প্রথম দিকে শাংহাই ভক্সওয়াগনের মূল গাড়ি 'সান্টানা'-র স্থানীয়করণের হার ছিল ৩ শতাংশেরও কম। যৌথ-মালিকানা আলোচনার সবচেয়ে বড় বিষয়ও ছিল 'স্থানীয়করণ' বা স্থানীয়ভাবে উত্পাদন। সে সময় ইউরোপের খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী ব্যবসায়ীরা চীনে আসতে চাইতো না। চীনের অনুন্নত উত্পাদনব্যবস্থা এবং অনুন্নত খুচরা যন্ত্রাংশ উত্পাদন কারখানাগুলো তখনও জার্মান ভক্সওয়াগনের উত্পাদন-মানে পৌঁছাতে পারেনি। তখনকার স্মৃতি স্মরণ করে জার্মান ভক্সওয়াগন কোম্পানির পেইচিং কার্যালয়ের মুখ্য প্রতিনিধি লি ওয়েন পো বলেন, "তত্কালে কারখানায় হাত দিয়ে গাড়ির কাঠামো তৈরি করা হতো; তারপর চুন মাখানো ও রং লাগানো হতো। পুরোপুরি হাত দিয়েই গাড়ি তৈরি করা হতো। উত্পাদন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বর্জ্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো। সেটিকে আর যা-ই হোক, আধুনিক গাড়ি উত্পাদন কারখানা বলা যাবে না।"
'সান্টানা' গাড়ি স্থানীয়ভাবে উত্পাদনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য, চীনের খুচরা যন্ত্রাংশ উত্পাদন কারখানাগুলো জার্মান ভক্সওয়াগনের মানে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। অবশেষে চীনের গোটা গাড়িশিল্পের মান উন্নত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ব্যবসা পত্রিকার গাড়ি সংস্করণের প্রধান সম্পাদক হো লুন বলেন, "এ প্রক্রিয়ায় কেবল চীনের গাড়িশিল্প উপকৃত হয়েছে তা নয়, পাশাপাশি বস্ত্রবয়ন, ইলেকট্রনিক্স, রাবার, ইস্পাতসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্পের মানও উন্নত হয়েছে। এর লক্ষণীয় তাত্পর্য রয়েছে। জার্মান ভক্সওয়াগন নিজস্ব ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য চীনে এসেছিল। তারা চীনের গাড়িশিল্পের উন্নয়নে অবদান রেখেছে এবং পাশাপাশি নিজেরাও লাভবান হয়েছে। আমি মনে করি, এটা ছিল দু'পক্ষেরই জয়ী হবার সুযোগ।"
শাংহাই ভক্সওয়াগনের যৌথ-মালিকানা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চীনে সংশ্লিষ্ট আইন ও নিয়মকানুনের জ্ঞান সাথে করে নিয়ে এসেছিল। পাশাপাশি তারা সাথে করে এনেছিল গাড়ি উত্পাদনের মানদণ্ড এবং স্থানীয়ভাবে গাড়ি উত্পাদন ও সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বিক্রয়োত্তর সেবার ধারণা। এর ফলে চীনের গোটা গাড়িশিল্পের মান উন্নত হয়েছে এবং চীনের অর্থনীতির দ্রুত বিকাশে তা রেখেছে ইতিবাচক ভূমিকা।
অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মানদণ্ড প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় চীনের প্রস্তাবও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে অডি'র উদাহরণ দেওয়া যায়। চীনের বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাব করেছিল যে, অডি মোটর গাড়ির পিছনের আসন আরো চওড়া হওয়া উচিত। কারণ, তখন চীনে অডি গাড়ি যারা ব্যবহার করতেন, তারা ড্রাইভার রাখতেন। তার মানে মালিক বসতেন পেছনের আসনে। বিশেষজ্ঞরা বললেন, পেছনের আসন আরামদায়ক করলে, চীনা ভোক্তারা তা পছন্দ করবেন। প্রস্তাবটি গৃহীত হয় এবং অডি গাড়ির পেছনের আসন আরামদায়ক করার জন্য গাড়ির আকার আগের তুলনায় লম্বা করা হয়। দৈর্ঘ্য বাড়ার পর অডি গাড়ি চীনে আরো অধিক জনপ্রিয়তা পায়। এরপর অন্য ব্র্যান্ডের গাড়ির ক্ষেত্রেও এ ধারণা অনুসরণ করা হয়েছে।
১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৪তম জাতীয় গণ কংগ্রেসের অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, দেশের গাড়িশিল্পকে জাতীয় অর্থনীতির একটি অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হবে। এ সিদ্ধান্ত গাড়িশিল্পের কাঠামোগত উন্নতি ও দ্রুত বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে। যৌথ-মালিকানা গাড়ি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চীনে বিকাশ লাভ করার পাশাপাশি, চীনের স্বতন্ত্র ট্রেডমার্ক গাড়িও দ্রুত বিকশিত হয়েছে। যেমন চিলি, চেরি, বিয়াডি, মহাপ্রাচির, জেডটিই সহ চীনের নানা স্বতন্ত্র ট্রেডমার্ক দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে; ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হয় এবং দুর্বল থেকে হয়ে ওঠে শক্তিশালী। এভাবেই চীন গাড়ি আমদানিকারক দেশ থেকে পরিণত হয় গাড়ি রপ্তানিকারক দেশে। চীনের গাড়িশিল্প সমিতির উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১২ সালে চীন ১০ লাখের বেশি গাড়ি রপ্তানি করেছে।
যেমনটি শুরুতেই বলেছি, চীনে বিশ্বের যে-কোনো দেশের তুলনায় বেশি গাড়ি উত্পাদিত হয় এবং এখানে গাড়ি বিক্রির হারও বিশ্বের যে-কোনো দেশের চেয়ে বেশি। এই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তারা বলছেন, চীন গাড়িশিল্প উন্নয়নের পথে অনেক দূর এগিয়েছে এবং আরো বহুদূর এগিয়ে যাবে। (ইয়ু/আলিম)