0704
|
এ দৃশ্যটি প্রতি বছর ভারতের বিভিন্ন স্থানের পরীক্ষা হলগুলোর নকলের দৃশ্য।
নিউজিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জৌ তার ব্যক্তিগত ব্লগে বেশ সস্তির সঙ্গে লিখেছেন, এখন বিভাগগুলোর বৈঠকে আমার মুখ আগের মত লাল হয়ে ওঠে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি নকল করার ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।
বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর লেখা চুরি খুব স্বতন্ত্র বিষয়। অধ্যাপক জৌ'র বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় নকল করা ছাত্রছাত্রীর মধ্যে চীনা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি। এ কারণে সহকর্মীদের কাছে তিনি খুব লজ্জা পান। কিন্তু ভারতীয় ছাত্র ছাত্রীরাও লেখা চুরি করতে পছন্দ করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় অধ্যাপক জৌ'র লজ্জা কিছুটা কমেছে।
ভারতের উন্নত শহর হোক, অথবা ধর্ম ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী প্রভাবিত রুদ্ধদ্বার গ্রাম হোক, নকল বা পরীক্ষার সময় চুরি করে লেখার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ভারতের দরিদ্র গ্রামে নকল লেখা কাগজ ব্যবহার এমনকি শিক্ষক অথবা পরিদর্শকের সামনেই আরো বিপুল উদ্যোমে তার ব্যবহার খুবই সাধারণ বিষয়।
পাশাপাশি ভারতের সবচেয়ে আধুনিক শহর মুম্বাই-এ পরীক্ষায় লেখাচুরি করার উপায় আরো চতুরতাপূর্ণ ও ব্যয় বহুল। মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বছরের ছাত্র সঞ্জয় জানিয়েছেন যে, বর্তমানে ওয়্যারলেস হেডসেট ও মোবাইলসহ বিভিন্ন পোর্টেবল ডিভাইস দিয়ে নকল করছে অনেক ছাত্র।
সঞ্জয়ের কথা অনুযায়ী, যখন পরীক্ষার সময় হয়, তখন ইন্টারনেটে নকল করার হেডসেট বিক্রি হয়। সাধারণ টেলিফোনে অন্য দিকের বিক্রেতা বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, তাদের নকল করার যন্ত্রপাতি এখনও আবিষ্কার হয়নি।
সে ধরনের তথাকথিত "মাস্টার নকলের যন্ত্রপাতি" আসলে সুচের চেয়ে কিছুটা বড় ওয়্যারলেস হেডসেট ও মোবাইল ফোন সংযুক্ত করা একটি বস্তু।
সঞ্জয় সাংবাদিককে এসবের ব্যবহার ব্যাখ্যা করেছেন। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা হলের ভেতরের প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে মাল্টিমিডিয়া মেসেজের মাধ্যমে পরীক্ষা হলের বাইরে বন্ধুকে পাঠায়। এরপর বন্ধু উত্তরগুলো আবার মোবাইলের মাধ্যমে মধ্যবর্তী জনের কাছে দেয়। মধ্যবর্তী জন আবার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরীক্ষা হলে সংকেত পাঠায়। ওয়্যারলেস হেডসেট পড়া পরীক্ষার্থী প্রশ্নের উত্তর শুনতে পায়।
এ ধরনের ওয়্যারলেস হেডসেট প্রায়ই বিদেশ থেকে বেশ সস্তায় কেনা হয়। কিন্তু ইবেতে এর দাম কম না। প্রত্যেকটির দাম ৪০ মার্কিন ডলার। বিক্রেতা সাংবাদিককে জানিয়েছেন, যদিও দাম কম না, তবুও এর বাজার খুবই ভালো। এক সপ্তাহে ৩ / ৪টা বিক্রি হয়।
ঠিক এ কারণে অন্য মানুষকে নকলে সাহায্য করা ভারতে বেশ ভালো "ব্যবসা"য় পরিণত হয়েছে। সাধারণ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষা বা সরকারি কর্মকর্তা পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বড় পরীক্ষায় নকলের জন্য সাধারণত ৫ কোটি রুপি বা প্রায় ৯ লাখ মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ দিতে হয়। টাকার লোভে অনেকেই এ পথ বেছে নেয়।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৫ বছর ভারতের প্রায় প্রত্যেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে কমপক্ষে একবার ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৪ সালে ভারতের একটি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় নকল করার জন্য এক ছাত্র ১৫ হাজার মার্কিন ডলার ব্যয় করে।
ভারতীয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত ব্যুরোর একজন পুলিশ অফিসার বলেছেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার আগে বহু সংখ্যক অবৈধ নকল বিনিময় হয়। অর্থের লোভে কিছু তৃণমূল পর্যায়ের বিদ্যালয় কর্মী পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর নির্দিষ্ট সময়ের আগে ফাঁস করে। এছাড়া কিছু প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও অপরাধ সংস্থাও এতে জড়িত। চলতি বছরের মার্চ মাসে এলাহাবাদের দু'জন কর্মী নকল করা এক ছাত্রকে ধরার কারণে বোমা হামলার শিকার হয়।
ভারতে পরীক্ষায় নকল হওয়াটা খুবই সাধারণ ঘটনা হয়েছে। ভারতের মতো ধনী-গরীব ব্যবধানে পরিপূর্ণ একটি দেশে শুধুমাত্র পরীক্ষার ফলাফলে যখন একজনের ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়, তখন নকলের ঘটনা বেড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক।
একটি ছাত্র যদি ভারতের জাতীয় পর্যায়ের দশম ও দ্বাদশ পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে, তাহলে সে সুষ্ঠুভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। বিশেষ করে চিকিত্সাবিদ্যা ও প্রকৌশলসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় কোর্সে লেখাপড়া, নিঃসন্দেহে 'দারিদ্র্য মুক্ত' ও 'ধনী' হবার শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে ব্যর্থ ছাত্রদের জন্য পরীক্ষার ফলাফল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনের জন্য ভালো ফলাফল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যোগ্যতাসম্পন্ন না হলেও চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাজীবনের ভালো ফলাফলকে মূল্যায়ন করে। আর ভালো চাকরি উন্নত জীবনের দিকে নিয়ে যায়।
এছাড়া হিন্দু ধর্ম অনুসারীদের আত্মসম্মান খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দৈনন্দিন জীবনযাপনে "সম্মান"-এর ওপর বেশ গুরুত্ব দেয় তারা। যদি নিজের সন্তান বিখ্যাত বা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে, প্রতিবেশীদের মধ্যে তাদের সম্মান বেড়ে যায়।
কোন কোন বিশেষজ্ঞর মতে, ভারতের সমাজে নকলের প্রতি 'লজ্জার অভাব' এ ধরনের অবৈধ আচরণকে নমনীয় করে তুলেছে।
ভারতে কিছু সময় জীবনযাপন করার পর সাংবাদিক আবিষ্কার করেছেন যে, অনেক ভারতীয় মনে করে, নকল করা ভুল নয়। শিক্ষার্থী নকল করার জন্য সঠিকভাবে বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে 'বিজয়' অর্জন করেছে। প্রতারিত মানুষেরা স্বেচ্ছায় এটা করেছে।
তারা এটা ব্যাখ্যা করেছে যে, কেন অনেক বিদেশী ভারতে বার বার প্রতারিত হয়েছে বা টাকার লোকসান দিয়েছে। ভারতীয়রা খুব কম নিজেদের সমালোচনা করে। এ ধরনের সামাজিক মনস্তত্ত্বে নকল এক ধরনের বঞ্চিতের আচরণ হিসেবে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য। এটা কল্পনার বাইরে কিছু নয়।
মাঝে মাঝে বেশি পরিমাণ পাশের হারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। এক ভারতীয় ছাত্র জানান, ৩ বছর আগে তিনি মুম্বাইয়ে দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। কয়েক ডজনের পরীক্ষার্থীর হলে মাত্র একজন পরীক্ষক ছিলেন। বেশিরভাগ সময়ই তিনি পরীক্ষা হলে থাকতেন না। পরীক্ষা হলে খুব শব্দ হতো এবং প্রচুর কাগজ উড়ত।
এছাড়া ভারতের শিক্ষানীতির কিছুটা খুঁত রয়েছে। ২০১০ সালে প্রণয়ন করা নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী, ভারতে বাধ্যতামূলক শিক্ষার বয়স ১৪ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীর নিচের ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত পরবর্তী ধাপে যেতে পারে না। অন্যদিকে দশম শ্রেণীতে বাধ্যতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাশ করতে হয় বলে নকলের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।
এধরনের ব্যাপকহারে নকল করায় ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে ভারত সরকার নতুন ধরনের প্রশ্নপত্র চালু করেছে। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের পর প্রশ্নপত্র ডিজিটাল ফর্ম ও কোডে পরিণত হয়। পরে পিডিএফ আকারে ই-মেইলে গ্রহণ করা হয়। শুধুমাত্র পরীক্ষা হলের বিশেষ প্রিন্টারকে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত করার পর ই-মেইলটি ডাউনলোড ও ডিকোডেড হয়। কেবল তারপরই প্রশ্নপত্রটি প্রিন্ট করা সম্ভব হয়।
এধরনের তত্ত্বাবধান জোরদার করার পরও, তবুও তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং নেতিবাচক সামাজিক প্রভাবের কারণে অনেক ছাত্রছাত্রীই অবৈধ পথ বেচে নেয়। ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকৌশল ইন্সটিটিউটে প্রতি বছর কোটিরও বেশি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ছাত্রছাত্রীর মধ্যে থেকে মাত্র ৩ লাখ চমৎকার ফলাফলকারী ভর্তি হতে পারে। চূড়ান্ত তালিকাভুক্তির হার ২ শতাংশেরও কম। এমনকি তা মার্কিন হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ শতাংশ তালিকাভুক্তির হারের চেয়েও অনেক কম। এ ধরনের একটি শক্তিশালী যুদ্ধ জয়ের মানসিকতা ভারতের বিদ্যালয়গুলোতে নকল করার দুরারোগ্য রোগ সৃষ্টি করেছে।