

লু স্যুনও শোকসভায় সক্রিয়ভাবে যোগ দেন, কিন্তু তিনি যে বিপ্লবের পথ বেছে নিলেন তা ছিল স্যু সিলিন অনুসৃত পথের সম্পূর্ণ বিপরীত। লু স্যুন বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে গুপ্ত হত্যার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি চাইলেন দীর্ঘকালীন ধৈর্যসহকারে সংগ্রামের মাধ্যমে ঝিমিয়ে পড়া জাতির আত্মার পরিবর্তন ঘটাতে এবং শিল্প ও সাহিত্য দিয়ে এই ঝিমিয়ে পড়া জাতির মনের তেজ ফিরিয়ে আনতে।
জনগণের সচেতনতাবোধকে জাগিয়ে তুলতে লু স্যুন যে বিপ্লবী পন্থা গ্রহণ করলেন তা হল সাহিত্য আন্দোলন।
স্যু সিলিন এবং তার অনুগামীদের হত্যা করার পর যে আলোড়ন সৃষ্ট হয়েছিল তা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল। লু স্যুন আগের মতো তার বোর্ডিং হাউসে জীবনযাপন করতে লাগলেন। শরতের সন্ধ্যায় নৈশভোজ শেষ করে মাঝে মাঝে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে নদীর পাড়ে পায়চারী করতেন। রুশ ভাষা শিখবার জন্য তিনি ম্যারিয়া কোন্ডে নামে রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা একজন বিপ্লবীর কাছ থেকে রুশ ভাষার পাঠও গ্রহণ করতেন। কিন্তু, কিছুদিনের মধ্যে তা বন্ধ করতে হল। তার সহপাঠীদের মধ্যে ছেন জিইং সর্বপ্রথম রুশ ভাষা পড়া ছেড়ে দেন, তারপর খাও ওয়াংছাও গোপনে গোলবারুদ তৈরী করা শিখতে ওসাকায় চলে যান। লু স্যুন টোকিও শহরে থেকে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে নিজেদের কাজে নিয়োজিত থেকে একটি সাহিত্যিক পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।
তখনকার টোকিও শহর যে শুধু চীনের বিপ্লবীদের ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রস্থল ছিল তা নয়, কোনো কোনো রক্ষণশীল ব্যক্তি ও প্রতি বিপ্লবীদেরও কার্যকলাপের উন্মুক্ত স্থানও ছিল এই শহর। এখানে , প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল এবং বিপ্লবী ও প্রতিবিপ্লবী শক্তিদের মধ্যে তীব্র সংগ্রাম শুরু হল। সুন চোংশানের নেতৃত্বে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পন্থীরা প্রবাসী যুবক ও ছাত্রদের মনে গভীর বিশ্বাস উত্পন্ন করেছিলেন। বিপ্লবী সাহিত্য আন্দোলনের শুরু থেকে লু স্যুন অটল এবং পুরাদস্তুর বিপ্লবী গণতান্ত্রিকপন্থীতে পরিণত হয়েছিলেন।
সাহিত্য আন্দোলন সৃষ্টির পরিকল্পনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে লু স্যুন চেয়েছিলেন একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে। সমমনোভাবাপন্ন কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে পত্রিকার নাম, প্রচ্ছদপট, রেখাচিত্র সব স্থির করার পর পরিকল্পিত পত্রিকা দিনের আলো দেখতে পেল না। ' লড়াইয়ের ডাক'-এর ভূমিকাতেই লু স্যুন লিখলেন: " আলোচনার পর ঠিক হল, আমাদের প্রথম কাজ হবে একটি পত্রিকা বের করা যার নাম থেকে বোঝা যাবে এটা নতুন জন্ম। তখন প্রাচীনের পক্ষপাতী ছিলাম বলে এর নাম দিলাম নব জীবন। পত্রিকা বের হবার সময় ঘনিয়ে আসতেই কয়েকজন লেখক পিছিয়ে গেলেন, তারপর কেউ চাঁদা প্রত্যাহার করে নিলেন। শেষ পযন্র্ত রয়ে গেলাম আমরা কপর্দকহীন তিনজন। কুক্ষণে পত্রিকার কাজ শুরু করেছিলাম বলেই কারো কাছে অভিযোগ করতে পারি নি। এরপর আমরা তিনজনও আলাদা হয়ে পড়লাম। রঙ্গীন ভবিষ্যতের কল্পনাও শেষ হয়ে যায়। এভাবেই নব জীবনের অপমৃত্যু ঘটে। "
সাহিত্য আন্দোলন সৃষ্টি করার প্রথম প্রচেষ্টা এভাবে ব্যর্থ হওয়াতে লু স্যুন খুব আঘাত পেলেন। তারপর থেকে বেশ কিছুদিন লু স্যুন ' নি:সঙ্গ' বোধ করতে থাকেন। কিন্তু তার প্রথম পদক্ষেপ কার্যকরী না হওয়াতে তিনি একেবারে মুষড়ে পড়লেন না। শুরু হল তার দ্বিতীয় পদক্ষেপ ; রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের সাহিত্য অনুবাদ। তা ছাড়া তিনি হোনান প্রদেশ থেকে আগত চীনা ছাত্রদের দ্বারা প্রকাশিত ' হোনান' নামক সাময়িকী পত্রিকার জন্য প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলেন। আর এই প্রবন্ধগুলো হত খুব দীর্ঘ, কারণ লু স্যুনের কথায়: ' সম্পাদক মহাশয় ছিলেন অদ্ভুত মেজাজের লোক। প্রবন্ধগুলো হওয়া চাই খুব দীর্ঘ এবং যত দীর্ঘ হবে লেখকের পারিশ্রমিকও হবে তত বেশী। আর তিনি পছন্দ করতেন প্রাচীন শব্দের প্রয়োগে অদ্ভুত অদ্ভুত বাক্য সৃষ্টি। এ ছিল ' মিনপাও'-এর প্রভাব"।
' হোনান' পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় লু স্যুন ' লিং ফেই' ছ্দমনামে 'মানুষের ইতিহাস' নামে একটি প্রবন্ধ লিখলেন। এই প্রবন্ধে প্রকাশ পায় লু স্যুনের জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি।
সাহিত্য আন্দোলনে ব্রতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লু স্যুন বিশ্বের প্রগতিশীল এবং বিপ্লবী সাহিত্যিকদের সৃস্ট সাহিত্যের দিকে দৃষ্টি দিলেন বেশী। তিনি জাপনী এবং জার্মান ভাষায় প্রকাশিত বই এবং সাময়িক পত্রিকা থেকে অনুবাদ ও প্রচারের যোগ্য উপজীব্য সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। পকেটে কিছু পয়সা থাকলেই তিনি বইয়ের দোকানে চলে যেতেন। পুরনো বই ও সাময়িক পত্রিকা অপেক্ষাকৃত সস্তা দামে বিক্রী হত। তাই তিনি একবার বইয়ের দোকানে গেলে কখনো খালি হাতে ফিরে আসতেন না। সাময়িক পত্রিকায় রাশিয়ার সাহিত্য সম্বন্ধে প্রকাশিত নতুন কিছু দেখলে তিনি তা কিনে নিতেন। পত্রিকা পড়া শেষ হলে তার মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগুলি কেটে আলাদা করে রেখে দিতেন। জার্মান ভাষা এবং ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত পুস্তক তালিকা দেখে তিনি রাশিয়া, পোল্যান্ড , চেক প্রজাতন্ত্র , হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, ফিনল্যান্ড ইত্যাদি দেশগুলির বই কিনবার চেষ্টা করতেন। এই সব দেশের লেখকদের মধ্যে লু স্যুনের সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন রুশ লেখক গোগোল। তার লেখা' মৃত আত্মা' , ' রাজকীয় দূত' , পাগলের ডায়েরী ' লু স্যুনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করল। তিনি পোল্যান্ডের লেখক সিয়েনখোগুইস-এর একজন ভক্ত হয়ে উঠলেন। তার লেখা ' তুমি কোথায় যাচ্ছ' বইটি লু স্যুনের একটি প্রিয় পাঠ্যপুস্তক ছিল।
যুবক লু স্যুন এখন হয়ে উঠলেন একজন বিপ্লবী ও চিন্তাবিদ। তাতেও দেখা গেল তার স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য । চীনের ভূখন্ডে জাতীয় বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ঢেউয়ে জনসাধারণ, বিশেষ করে কৃষকজনতার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী , সামন্ততন্ত্রবিরোধী সংগ্রামের দাবী সোচ্চার হয়ে উঠল। এই সংগ্রামীদের চিন্তা ও মনোভাব লু স্যুনের চিন্তায় ও সাহিত্য আন্দোলনের মধ্যে গভীরভাবে প্রকাশ পেল। সাহিত্য সৃষ্টিতে যুবক সাহিত্যিক লু স্যুনের যে একটি বিশেষত্ব আমরা দেখতে পাই তা হল তিনি শুরু থেকেই আদর্শগত সংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামকে সাহিত্যের সঙ্গে এক করে নিলেন। তার চিন্তায় বাস্তব অবস্থার প্রতিফলনের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর ইঙ্গিতও পাওয়া গেল। লু স্যুন সাহিত্য আন্দোলনে ব্রতী হবার শুরু থেকেই বিপ্লবী সাহিত্যের উদ্দেশ্যর সঙ্গে চীনা জনগণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও সামন্ততন্ত্রবিরোধী সংগ্রামকে এক করে দেখলেন। তাই, 'হোনান' সাময়িক পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যায় জীবন পণ করে দেশমুক্তির সংগ্রামে যোগদান করার আহ্বান জানালে লু স্যুন সেই বিপ্লবী আমন্ত্রণে সাড়া দিলেন এবং নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলেন। দেখা গেছে যে, কোনো বিপ্লবী পরিস্তিতির সম্মুখীন হলে লু স্যুন কখনো নির্বাক দর্শকের ভুমিকা গ্রহণ করেন নি। তিনি হতেন তার একজন সক্রিয় সংশীদার। তার হাতিয়ার ছিল সাহিত্য। আর এই হাতিয়ার দিয়ে তিনি চাইলেন তার নিপীড়িত জাতির মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতে যাতে জনগণ সচেতন হয়ে উঠে নিপীড়িকদের বিরোধিতা করে এবং দুর্দশাগ্রস্ত মাতৃভূমি ও জাতিকে উদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়। সমাজের অগ্রগতি ও জনগণের মুক্তির উদ্দেশ্যে বিপ্লবী সাহিত্যের মাধ্যমে সেবা করার জন্য যুবক চিন্তাবিদ লু স্যুন চিন্তার দিক থেকে নিজের এবং তখনকার সব অপকৃষ্ট বুর্জোয়া শ্রেণীভূক্ত সংস্কারপন্থী চিন্তাবিদ এবং ' দেশকে সম্পদশালী ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি'র প্রবক্তা অজ্ঞ তাত্বিকদের মধ্যে একটি সীমারেখা টেনে নিয়েছিলেন। এই সব চিন্তাবিদ ও তাত্বিকদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন যারা দুমুখো নীতি অবলম্বন করতেন। তারা মুখে বলতেন দেশকে সম্পদশালী করার কথা, দেখাতেন যেন তারা পরম দেশভক্ত, কিন্তু আসলে তারা যে কাজ করতেন তা দেশের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনত। তাদের মুখের ভাষা শুনে মনে হত যে তারা এমন দেশহিতৈষী যেন দেশের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত, কিন্তু তারা মনেপ্রাণে ছিলেন বিদেশীদের ভক্ত ও দাস। দেশ সত্যিকারের দুর্দশার মধ্যে পড়লে তারা যে শুধু তাদের নিজেদের চামড়া বাচিয়ে চলতেন তাই নয় এই পরিস্থিতি থেকে তারা কিছু ফায়দাও তুলে নিতেন। অজ্ঞ ও নিরক্ষর জনতার সামনে তারা নিজেদের ' বীর' বলে জাহির করতেন, কিন্তু বিদেশী আক্রমণের সম্মুখীন হলে অথবা তাদের টাকার থলি দেখলে তারা সব কিছু ভুলে গিয়ে নমনীয়ভাব অবলম্বন করতেন। এই শ্রেণীর লোকদের থেকে জন্ম নিয়েছিল চীনের মুত্সুদ্দিশ্রেণী। লু স্যুন এই ধরণের লোকদের চরিত্র বেশ ভালোভাবেই চিনতে পারলেন। তাই ' হোনান' সাময়িক পত্রিকায় ১৯০৭ ও ১৯০৮ সালে যে-সব প্রবন্ধ তিনি লিখলেন তাতে ব্যক্ত হল এই ধরণের লোকেদের প্রতি তার বিদ্রুপ ও আক্রমণ।
বাস্তব এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টি গ্রহণ করলে দেখা যাবে যে, তত্কালীন চীনের সংস্কারপন্থীরা যে মত ব্যক্ত করছিলেন তা প্রকৃতপক্ষে ছিল সামন্ততান্ত্রিক শাসকশ্রেণীর পক্ষপাতী। তারা অন্যায় শাসনকে সম্পূর্ণ উত্খাত করতে চান নি। তাদের বক্তব্য ছিল যে, দেশকে সমৃদ্ধিশালী এবং সাময়িক দিক থেকে শক্তিসম্পন্ন করে তুলতে পারলে, এবং দেশে শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তবেই হবে দেশের উন্নতি। এই উপায়েই তারা চেয়েছিলেন মুর্মুঘু সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে, আর এই পুরনো ব্যবস্থা বজায় রেখে সমাজে নিজেদের স্বার্থ কায়েম করতে । এই রুপ পরিস্থিতির কথা মনে রেখে লু স্যুন ' হোনান' পত্রিকায় ' সাংস্কৃতিক পক্ষপাতিত্ব' নামে একটি প্রবন্ধ লিখলেন।
১৯০৭ সালের আগ্যস্ট মাসে প্রকাশিত এই প্রবন্ধে লু স্যুন মূলত: পাশ্চাত্যকরণ আন্দোলন এবং সংস্কারপন্থীদের বিরুদ্ধে মত ব্যক্ত করলেন। তিনি বললেন, সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন হল জনগণকে জাগিয়ে তুলে সামন্ততান্ত্রিক শাসক ও বুর্জোয়া সংস্কারপন্থীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা।




